ধারাবাহিক বৃষ্টি ও তার ফলে কলকাতার বিস্তীর্ণ অংশ জলের তলায়— এ-হেন ‘জলছবি’ বিগত দশ বছরে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি আরও একটি ‘মর্মান্তিক’ খবর গত ৭ সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকা-য় বেরিয়েছিল— “বেআইনি দখলদারির চোটে আন্তর্জাতিক মর্যাদা হারানোর আশঙ্কা পূর্ব কলকাতা জলাভূমির।” যত দূর মনে পড়ে, এ নিয়ে কোনও হইচই হয়নি।
কলকাতা বিশ্বের সেই বিরল কয়েকটি শহরের অন্যতম, যার কেন্দ্রীয় অংশে কোনও কৃত্রিম জলশোধন ও নিকাশি ‘প্লান্ট’ নেই। বহু শহরে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে যে কাজ করতে হয়, কলকাতায় সেই কাজ হয়ে যায় সকলের অলক্ষ্যে, একটি পয়সাও খরচ না করে। পূর্ব কলকাতার জলাভূমি হল সেই রহস্যময় জলশোধক। আশির দশকে এই রহস্যভেদ করেছিলেন তৎকালীন রাজ্য সরকারের ইঞ্জিনিয়ার ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুবিদ্যায় পিএইচ ডি এই ইঞ্জিনিয়ারের কার্যত একার চেষ্টায় জানা যায় যে, কলকাতার পূর্ব প্রান্তে বিপুল জলাজমি, চলতি কথায় ‘ভেড়ি’, আসলে কলকাতার ভৌগোলিক ‘কিডনি’। প্রতি দিন প্রায় সাতশো মিলিয়ন লিটার বর্জ্য জলকে সূর্যালোকের অতিবেগুনি রশ্মির সহায়তায় প্রাকৃতিক উপায়ে জলজ বাস্তুতন্ত্রের শৈবাল ও মাছেরা নিজেদের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করে শোধন করে ফেলে এই জলাভূমিতে। ফলে আমাদের অজানতেই কলকাতা বেঁচে যায় জলদূষণ থেকে। পাশাপাশি, মাছের প্রাত্যহিক জোগানের ২০% আসে এই জলাভূমি থেকে। সবচেয়ে বড় কথা, নিম্ন গাঙ্গেয় অববাহিকার নিচু শহর কলকাতা বন্যার হাত থেকে বেঁচে যায়। বা, এত দিন তা-ই যেত।
নিজের সারা জীবন এই জলাভূমির সংরক্ষণে উৎসর্গ করেছিলেন ধ্রুবজ্যোতিবাবু। করেছেন গবেষণা, চালিয়েছেন অনুসন্ধান। তত দিনে সেই জলাভূমির প্রায় অর্ধেক ভরাট হয়ে গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক সল্টলেক সিটি। সেটি ছিল পরিকল্পিত নগরায়ণ। কিন্তু পরবর্তী বামফ্রন্ট সরকারের জমানায় জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে যে নগরায়ণ ও ‘প্রোমোটার বিপ্লব’ শুরু হয়, তাতে বিজ্ঞানের চেয়ে বৈপ্লবিক চেতনা ও নেতাদের থালায় একমুঠো ভাতের ব্যাপারটাই বেশি ছিল। প্রতিবাদ জারি রেখেছিলেন ধ্রুবজ্যোতিবাবু। লাভ হয়নি। কলকাতা হাই কোর্টের রায় থাকা সত্ত্বেও ক্রমশ আরও সঙ্কুচিত হতে শুরু করে এই জলাভূমি। অন্য দিকে, কেষ্টপুর খাল ও বাগজোলা খাল অবরুদ্ধ হতে থাকে। ধ্রুবজ্যোতিবাবু লড়াই ছাড়েননি। আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকায় লেখালিখি করেছিলেন। তারই ফল আসে ২০০২ সালে। ‘পূর্ব কলকাতা জলাভূমি’ ইউনেস্কো অনুমোদিত আন্তর্জাতিক ভাবে মান্য ও সংরক্ষিত জলাভূমি বা ‘রামসার সাইট’ বলে স্বীকৃতি লাভ করে। গুরুত্বে যা প্রায় ‘ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর মতোই। শোনা যায়, এই স্বীকৃতির জন্য সাইট খতিয়ে দেখতে এসে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরাও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সম্ভবত সারা পৃথিবীতে এ রকম প্রাকৃতিক জলনিকাশি ব্যবস্থা বিরল।
পশ্চিমবঙ্গের দু’টি রামসার সাইট আছে। অন্যটি সুন্দরবন। সুন্দরবনের গুরুত্ব বহু আলোচিত। কিন্তু শীতকালে নলবন ও নুনের ভেড়িতে পিকনিক করতে যাওয়া বাঙালিও বোধ হয় জানেন না, তাঁরা একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাস্তুতন্ত্রে এসে পড়েছেন। এই বিস্মৃতি সাংঘাতিক। বাম জমানার পর জোড়াফুল জমানাতেও প্রোমোটার বিপ্লব শত গুণে বেড়েছে, ক্রমশ বিপাকে পড়ছে এই জলাভূমি। নানা ভাবে ভরাট করা হচ্ছে, প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রে বিষাক্ত ধাতব অবশেষ বা রাসায়নিক ইত্যাদি মিশে শৈবাল ও মাছেদের ক্ষতি করছে। গভীরতাও ক্রমশ কমছে।
পুরসভার পাম্প চালানো, লকগেট খোলা— এ সবই হচ্ছে আসলে ‘ডায়ালিসিস’। যন্ত্রের সাহায্যে কৃত্রিম ভাবে রক্ত পরিশোধন করে কিডনির কাজ চালানো— আসল কিডনি বিকল হওয়ার পরের ক্ষণস্থায়ী সমাধান। পাশাপাশি আমাদের নিজেদের ভূমিকাকেও এড়িয়ে গেলে চলবে না। ‘প্লাস্টিক দূষণের প্রতিকার’ নিয়ে স্কুলে-কলেজে পড়ানো হচ্ছে; বিক্ষিপ্ত ভাবে কোথাও কোথাও প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো বা ‘রিসাইক্লিং’ হচ্ছে। কিন্তু সার্বিক ভাবে দেখলে আজও যত্রতত্র প্লাস্টিক ফেলে নিকাশি নালাগুলির নাভিশ্বাস তুলে দেওয়ার স্বভাব নেতা থেকে সাধারণ মানুষ— সবার মধ্যেই বিদ্যমান।
জলাভূমি নিয়ে একাধিক বইপত্র লিখেছিলেন ধ্রুবজ্যোতিবাবু, যার মধ্যে অন্যতম ইকোলজি অ্যান্ড ট্র্যাডিশনাল ওয়েটল্যান্ড প্র্যাকটিস। বেশি কেউ ধ্রুবজ্যোতিবাবুর নাম মনে রাখেনি। যদিও আন্তর্জাতিক মহলের কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন বহু সম্মান, স্বীকৃতি। ২০০৫ সালে প্রকাশিত সেই বইয়ের মুখবন্ধে এক প্রবাদপ্রতিম কৃষিবিজ্ঞানী লিখেছিলেন, “অমর্ত্য সেনের ‘ওয়েলফেয়ার ইকনমিক্স’-এর মতোই ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের এই আন্দোলনের নাম দেওয়া যেতে পারে ‘ওয়েলফেয়ার ইকোলজি’...।” তিনি ভারতের সবুজ বিপ্লবের জনক, এম এস স্বামীনাথন। ধ্রুবজ্যোতিবাবু তাঁর যুদ্ধ থামিয়ে চলে গিয়েছেন ২০১৮ সালে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy