Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Gummadi Vittal Rao

বিপ্লবের গান শোনাতেন তিনি

ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি আন্দোলনের অভিঘাত পথে টেনে এনেছিল গদরকে, যেমন এনেছিল তাঁর সহমর্মী কবি ভারাভারা রাওকেও।

তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০২৩ ০৪:১৩
Share: Save:

তীব্র রোম্যান্টিকতা, আবেগ আর পাগলামি ছাড়া কি গুম্মাড়ি ভিট্টল রাও বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতে পারতেন? গোটা দেশ তাঁকে পরে চিনেছে গদর নামে (ছবি)। চরমপন্থায় বিশ্বাসী বামপন্থী। জীবনের অনেকটা সময় জঙ্গলের অন্তরালে থাকা সেই চারণকবির শেষকৃত্য সম্পন্ন হল রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়! হল, কারণ তেলঙ্গানা সরকার জানে, পৃথক তেলঙ্গানা রাজ্য গঠনে গদরের ভূমিকা কতটা ছিল।

সাদা চুল-দাড়ি, আদুড় গা, গলায় পেঁচানো লালপাড় চাদর, হাঁটু পর্যন্ত সাদা ধুতি, কখনও তাতে লাল পাড় বসানো, হাতে ধরা বাঁশের লাঠিতে লাল পতাকা— গান গাইতে গাইতে, নাচতে নাচতে গদর চলেছেন মিছিলে। সহযোদ্ধারা কেউ দিনমজুর, কেউ চাষি বা শ্রমিক। সমাজের প্রান্তিক মানুষজনকে নিয়ে গদরের সেই পরিক্রমা ছিল অত্যন্ত পরিচিত ছবি। গ্রামের পর গ্রাম, জনপদের পর জনপদে হেঁটে চলেছেন, গেয়ে চলেছেন চারণকবি, জনতাকে জোগাচ্ছেন লড়াইয়ের রসদ, স্বপ্ন দেখার অঙ্গীকার, জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন প্রান্তিক মানুষকে— এই ছবি দেখতে কোনও রাষ্ট্রই পছন্দ করে না। গদরও তাই কোনও দিন রাষ্ট্র বা মূলধারার শক্তির কাছে প্রিয় ছিলেন না। তা হওয়ার চেষ্টাও করেননি। যদিও পরের দিকে রাজনৈতিক লাইন নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে। বিপ্লবের পথ ছেড়ে তিনি মূলধারার রাজনীতিতে আসেন।

ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি আন্দোলনের অভিঘাত পথে টেনে এনেছিল গদরকে, যেমন এনেছিল তাঁর সহমর্মী কবি ভারাভারা রাওকেও। সেই স্ফুলিঙ্গ চারিয়ে গেল শ্রীকাকুলামের কৃষক বিদ্রোহে। লাঙল ফেলে চাষিরা হাতে তুলে নিলেন লাঠি। লেখক, শিল্পীরাও ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেই আন্দোলনে। গদর বা ভারাভারা রাওয়ের মতো সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের মানুষরা কেউই চাননি নিরাপদ দূরত্বে বসে সাংস্কৃতিক চর্চা করতে। তাঁদের গানে-কবিতায়-ছবিতে ভরে উঠেছিল শ্রীকাকুলামের কৃষক বিদ্রোহের আঙিনা। সেকেন্দ্রাবাদের চলচ্চিত্র নির্মাতা ও নির্দেশক বি নরসিংহ রাও ১৯৬৮ সালে শিল্পী ও বিদ্বজ্জনদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। নাম দেওয়া হয় ‘আর্ট লাভার্স’। এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন গদর। মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী ছিল এই সংগঠন। সে সময়েই তেলঙ্গানার সশস্ত্র আন্দোলনের উপর গৌতম ঘোষের নির্দেশনায় মাভূমি (১৯৭৯) নামে যে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, তাতে গান গাওয়ার পাশাপাশি অভিনয়ও করেছিলেন গদর। বিপ্লবী আন্দোলনে সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের যে অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে, গদর ও তাঁর সহমর্মীরা তা সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন।

রাজনৈতিক ইতিহাসের বিশ্লেষকরা অনেকেই গদরকে মনে করেন শেখ নজরের যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে। অবিভক্ত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শেখ নজর অন্ধ্রপ্রদেশে বামপন্থী আদর্শের বীজ বপণ করেছিলেন। গদর অবশ্য বিশ্বাসী হয়ে পড়েন অতিবামপন্থী আদর্শে। শুধু অন্ধ্রপ্রদেশেই গদরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল না। মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গেও গদর তাঁর কাজের ছাপ রেখেছেন।

১৯৭২-এ ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী ছাত্রনেতা জর্জ রেড্ডি খুন হন ক্যাম্পাসের মধ্যেই। অভিযোগের আঙুল ওঠে দক্ষিণপন্থীদের দিকে। জর্জের মৃত্যুর পরে ‘আর্ট লাভার্স’ যে ‘স্মৃতি সপ্তাহ’ পালন করে সেই উপলক্ষে গানের বই প্রকাশ করা হয়। প্রচুর বিক্রি হয়। পরের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বিপুল ভাবে জনসমাদৃত হয়। গদর এখানে খুব বড় ভূমিকা নেন। জনগণের সাংস্কৃতিক চেতনার মধ্য দিয়ে বিপ্লবের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল ‘আর্ট লাভার্স’। এর পরেই ১৯৭৩-এ গদর ও তাঁর সহযোদ্ধারা তৈরি করলেন জননাট্যমণ্ডলী। লোকশিল্পের বিভিন্ন রূপকে জনতার ঘরের আঙিনায় এনে ফেললেন তাঁরা। হয়ে উঠলেন জনতার গায়ক, চারণকবি, বিপ্লবের মুখ।

ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে আশির দশকে জননাট্যমণ্ডলীর সর্ব ক্ষণের কর্মী হয়েছেন গদর। জননাট্যমণ্ডলী ছিল তৎকালীন সিপিআই এমএল (জনযুদ্ধ গোষ্ঠী)-এর সাংস্কৃতিক শাখা। প্রকাশ্য জীবন থেকে সে সময়েই অন্তরালে গেলেন গদর। চলে গেলেন জঙ্গলে। গ্রামে গ্রামে ঘোরার সময় গদর নেচেগেয়ে বিপ্লবের কথা শোনাতেন। গানের কথা উঠে আসত প্রান্তিক মানুষের জীবন থেকেই।

ফের প্রকাশ্যে এলেন ১৯৯০-এ। জননাট্যমণ্ডলীর কাজকর্ম করতে থাকেন। বাড়িতেই তাঁর উপর প্রাণঘাতী হামলা হয় ১৯৯৭-এ। দেহে মোট পাঁচটি বুলেট ঢোকে। চারটি বার করা গেলেও শিরদাঁড়ায় আটকে থাকা একটি বুলেট বার করা যায়নি শারীরিক কারণে। অভিযোগ ছিল, অন্ধ্রের বিশেষ পুলিশ ফোর্স ‘গ্রে হাউন্ড’ এই হামলা চালায়।

২০০৪-এ অন্ধ্র সরকারের সঙ্গে নকশালপন্থীদের আলোচনায় জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর দূতের কাজ করেছিলেন গদর, ভারাভারা এবং কল্যাণ রাও। পরে পৃথক তেলঙ্গানা রাষ্ট্রের দাবিতেও লড়াকু ভূমিকা ছিল তাঁর। কিন্তু জীবনের শেষ পর্বে বিপ্লবের পথে আর আস্থা রাখতে পারেননি গদর। সংসদীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস রেখে ২০১৮-য় জীবনে প্রথম বার ভোট দেন তিনি। নতুন দল গঠনের কথাও ঘোষণা করেন।

গুম্মাড়ি ভিট্টল রাওকে ইতিহাস গদর হিসাবে ঠাঁই দেবে কি না, জীবদ্দশায় তা নিয়ে একেবারেই ভাবিত ছিলেন না তিনি। কারণ জানতেন, গদরদের জন্য ইতিহাস তার বর্ণময় অধ্যায়ের দরজা খুলে দেয়। নিজের তাগিদেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Revolutionary Telengana
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE