Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Water Logged Kolkata

Kolkata Water Logging: বাইপাসেই সর্বনাশ! কলকাতার জলযন্ত্রণার কারণ লুকিয়ে পূর্ব দিকের নগরায়নে

কলকাতা একা নয়... লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, ভেনিস, নিউ ইয়র্ক, সেন্ট পিটার্সবার্গ, ওয়াশিংটনও তৈরি হয়েছিল জলা বুজিয়েই।

বৃষ্টিতে জলমগ্ন কলকাতার রাস্তা।

বৃষ্টিতে জলমগ্ন কলকাতার রাস্তা। ফাইল ছবি

মোহিত রায়
মোহিত রায়
শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২১ ১২:২২
Share: Save:

কলকাতা গড়ে উঠেছিল জলা-বাদা বুজিয়েই। রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেবের বর্ণনায় আছে, ‘যে সকল স্থান বর্তমান সময়ে শিয়ালদহবউবাজার বলিয়া প্রসিদ্ধ, সে সমস্ত স্থান পর্যন্ত লবণ জলের হ্রদটি বিস্তৃত ছিল।’ লবণ জলের হ্রদটি ছিল কলকাতার পূর্ব প্রান্ত জুড়ে। ছিল বিশাল জলা, খাল আর নদীর এক সমাহার। জোয়ার-ভাটার টানে নোনাজলের বিদ্যাধরী নদীর প্লাবনভূমি হিসাবে এই জলা অঞ্চল কাজ করত। অর্থাৎ জল উপচে এলে তা ধারণ করত এই জমি। সেই জমির সঙ্গেই ধীরে ধীরে সংযোগ হারাল তিলোত্তমা। সবটা না হলেও, সেই বিচ্ছিন্নতাই আজকের শহরের জলমগ্নতার অন্যতম কারণ। আসলে ছিল গোড়ায় গলদ, পরিকল্পনার অভাব। কী ভাবে পূর্ব পাড়ের প্লাবনভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল কলকাতা? সেই যোগের সন্ধানেই এই লেখার যাত্রা। এখানে বলে রাখা ভাল, জলা বুজিয়ে শুধু কলকাতারই বিস্তার হয়েছে এমনটা কিন্তু নয়। পৃথিবীর বিখ্যাত শহরগুলির অনেকগুলিই গড়ে উঠেছে জলা বুজিয়ে। উদাহরণ হিসাবে ধরা যায় লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, ভেনিস, নিউ ইয়র্ক, সেন্ট পিটার্সবার্গ, ওয়াশিংটনের কথা।

কলকাতার পশ্চিমে রয়েছে গঙ্গা নদী। ফলে পূর্ব দিকেই তার বিস্তার ছিল স্বাভাবিক। বেশ কিছু জলা-জঙ্গল বুজিয়েই মাথা তুলেছিল শহর। কিন্তু সেই বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যাধরী নদী চলে গেল অনেক দূরে। এর পরেই পাল্টে গেল জোয়ার-ভাটাহীন জলা-বাদা এলাকা। যার এক দিকে এখন মিষ্টি জলের মাছের ভেড়ি আর অন্য দিকে চোখ ধাঁধানো গগণচুম্বী আধুনিক আবাসন। তবু তিন শতাধিক বছর পরেও শহরের পূর্ব দিকে সেই জলাজমির কিছুটা এখনও রয়ে গিয়েছে। যার আধুনিক নাম ‘পূর্ব কলকাতার জলাভূমি’। কলকাতায় জলমগ্নতার সঙ্গে এই জলাভূমির নিবিড় যোগাযোগ।

 কলকাতার পশ্চিমে রয়েছে গঙ্গা নদী। ফলে পূর্ব দিকেই তার বিস্তার ছিল স্বাভাবিক।

কলকাতার পশ্চিমে রয়েছে গঙ্গা নদী। ফলে পূর্ব দিকেই তার বিস্তার ছিল স্বাভাবিক। নিজস্ব চিত্র

এই জলাভূমি প্রথম কোপের মুখে পড়ে ১৯৯২ সালে। তখন এটি আপাত ভাবে রক্ষা পেয়েছিল ‘পাবলিক’ নামক একটি পরিবেশ সংগঠনের মামলায় দেওয়া কলকাতা হাই কোর্টের আদেশের সৌজন্যে। এর পর এই ১২ হাজার ৫০০ হেক্টরের জলাভূমি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে ‘রামসার জলাভূমি’ হিসাবে। এর সবটা জলা নয়, এতে চাষের ক্ষেত, আবর্জনাক্ষেত্র, বসতি রয়েছে। তবে এই জলাভূমির মানচিত্র এবং তাতে চাষ ও বসতি জমির অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বিতর্কও তৈরি হয়েছে দিনের পর দিন। এটা এখন সর্বজ্ঞাত যে কলকাতা মহানগরের মধ্য অংশ নিচু, অর্থাৎ ডোঙার মতো। আর শহরের সাধারণ ঢাল পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে। সুতরাং প্রাকৃতিক নিয়মেই শহরের বৃষ্টির জল গড়াবে পূর্ব দিকে, সে জল ধরবে পূর্ব কলকাতার জলা-বাদা। সুতরাং সেই জলা বোজাতে থাকলে যে শহরে জল জমবে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ১৯৯০ সালে কলকাতার তথাকথিত তিনশো বছর পূর্তিতে শহরের পরিকল্পনার দায়িত্বে থাকা ‘কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ (কেএমডিএ) পরবর্তী পঁচিশ বছর, অর্থাৎ ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কলকাতার উন্নয়নের জন্য একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্টে বলা হয়– ‘ডায়মন্ড হারবার রোড ও রাজা সুবোধ মল্লিক রোডের প্রশস্তকরণ এবং ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসের নির্মাণ দক্ষিণ ও পূর্ব অঞ্চলের যোগাযোগকে সহজ করেছে। জমির হস্তান্তর ও উন্নয়ন কার্যও শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে এর মধ্যেই যথেচ্ছ ভাবে সবুজ এলাকা, জলাশয়, জলাভূমি দখল হয়ে যাচ্ছে। এই ঝোঁকটিকে রুখতে হবে এবং উন্নয়নকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ইতিমধ্যে পূর্ব কলকাতার ৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি সম্পর্কে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। উন্নয়নের গতিমুখকে পাল্টে উত্তর ও পশ্চিমমুখী করতে হবে।’

১২ হাজার ৫০০ হেক্টরের জলাভূমি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে ‘রামসার জলাভূমি’ হিসাবে।

১২ হাজার ৫০০ হেক্টরের জলাভূমি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে ‘রামসার জলাভূমি’ হিসাবে। নিজস্ব চিত্র

কিন্তু সরকার নিজেই এই সব নীতিকথা মানেনি। এত কথার পরেও সায়েন্স সিটি তৈরি হয় ধাপার একটি অংশ বুজিয়ে। আদালতের আদেশে কিছু জলাভূমি বাঁচে ঠিকই, কিন্তু ১৯৯৬ সালে পূর্ব কলকাতার জমি ব্যবহারের পরিকল্পনায় (ল্যান্ড ইউজ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট কন্ট্রোল প্ল্যান বা এলইউডিসিপি) একটি গ্রামাঞ্চলের মানচিত্রে কলকাতা শহরের জমি ব্যবহারের পরিকল্পনাই টুকে বসিয়ে দেওয়া হয়। নতুন পরিবেশ বাঁচানোর ভাবনা তাতে কিছু থাকে না। ফলে এই প্রান্তিক পূর্ব কলকাতায় গড়ে ওঠে আবাসনের সারি, কিছু শিল্প এলাকাও। একে ইএম বাইপাস পূর্বদিকে যাওয়া জলের স্বাভাবিক গতিপথ অনেকটাই রুদ্ধ করেছে, এর পর অপরিকল্পিত নতুন শহরতলি কলকাতার বর্ষার জলধারা ধারণের উন্মুক্ত ক্ষেত্র গ্রাস করল। ওয়েস্ট রিসাইক্লিং রিজিয়ন (ডব্লিউআরআর) বলে যে জলাভূমি ও কৃষিক্ষেত্র রইল, তাকেও রক্ষা করা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠল।

২০১৯-এর অক্টোবরে ন্যাশানাল গ্রিন ট্রাইবুনাল তাদের রিপোর্টে জানায় যে পূর্ব কলকাতার জলাভূমির অনেক জায়গায় জলা বুজিয়ে বাড়িঘর তৈরি হয়েছে। ২০০২ সালের এবং ২০১৬ সালের উপগ্রহ মানচিত্র তুলনা করে এই রিপোর্টে তা দেখানো হয়। এই সব দখল নিয়ে ৩৫৭টি অভিযোগ থানায় নথিভুক্তও হয়েছে। মাঝে মাঝে সরকার সক্রিয় হয়, কিন্তু তা সাময়িক। নড়াচড়া পড়ে এই জলাভূমির ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের পরিবেশ মন্ত্রী, মুখ্যসচিব-সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিকদের নিয়ে গঠিত আয়োগে। তবু সদিচ্ছা ও বাস্তবের মধ্যে অনেক ফারাক থেকেই যাচ্ছে। এই জলাভূমি শুধু প্রাকৃতিক উপায়ে গড়িয়ে আসা জলই ধারণ করে না, কলকাতা শহরের নিকাশি খালের বৃষ্টির জল ও ময়লা জলের একাংশ এই জলাশয়গুলি মাছ চাষের জন্য নেয়। সব মিলিয়ে এই জলাভূমি কলকাতা মহানগরের বর্ষার জলের কিছুটা গ্রহণ করে শহরের সমস্যাকে লাঘব করে। তাই পূর্ব কলকাতার জলা, কৃষিজমি, উন্মুক্ত স্থান— এই সব কিছুর উপযুক্ত ব্যবহারের জন্য কলকাতা পুরসভাকে সক্রিয় হতেই হবে। না হলে জলযন্ত্রণা থেকে মু্ক্তি আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

 পূর্ব কলকাতার জলা, কৃষিজমি, উন্মুক্ত স্থান— এই সব কিছুর উপযুক্ত ব্যবহারের জন্য কলকাতা পুরসভাকে সক্রিয় হতেই হবে।

পূর্ব কলকাতার জলা, কৃষিজমি, উন্মুক্ত স্থান— এই সব কিছুর উপযুক্ত ব্যবহারের জন্য কলকাতা পুরসভাকে সক্রিয় হতেই হবে। নিজস্ব চিত্র

তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে কলকাতা শহরের বর্ষার সময়ে অতিবৃষ্টিজনিত জলমগ্নতা কেবল পূর্ব কলকাতার জলা বাদার প্রাকৃতিক উপায়ে সমাধান করা যাবে না। কলকাতা শহরের বর্ষার ও ময়লা জলের বেশিরভাগটাই বেরিয়ে যায় পূর্ব দিকের বাগজোলা খাল, বেলেঘাটা খাল, কেষ্টপুর খাল, পঞ্চান্নগ্রাম খাল ইত্যাদি দিয়ে। সব জল ফেলা হয় কুলটি গাঙ্গে, যা শেষ পর্যন্ত মেশে বিদ্যাধরীতে। এই খালগুলিতে জল ফেলার জন্য প্রয়োজন যে পাম্পিং ব্যবস্থা, তা সব সময় যথেষ্ট নয়। এ ছাড়া সংস্কারের অভাবে খালগুলির জল ধারণ ও বহন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় অতিবৃষ্টি হলে সব জল বেরতে পারে না। তাই এখন উপায় কলকাতার খাল ব্যবস্থার উপর জোর দেওয়া। কলকাতার খাল ব্যবস্থা শুধু জল নিকাশি ব্যবস্থা নয়, তা ছিল নৌ-পরিবহনের পথও। কলকাতাকে জড়িয়ে থাকা এই খাল ব্যবস্থাকে উন্নত করলে শুধু কলকাতার বন্যা নিয়ন্ত্রণই নয়, ব্যাঙ্ককের মতন কলকাতার নৌকা ভ্রমণ রোজকার পরিবহণ হয়ে উঠতে পারে। তাই খাল সংস্কার করলে, শহর মুক্তি পাবে জলযন্ত্রণা থেকে, পাবে যোগাযোগের নতুন মাধ্যম।

(লেখক পরিবেশবিদ। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE