Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Start-up business

স্টার্ট-আপ ব্যবসা কি সঙ্কটে? এ দেশের অর্থনীতিতে কি তারা সুবিধা করে উঠতে পারছে না?

বাইজ়ু’জ়-এর মতো সংস্থা এই মুহূর্তে মুখ থুবড়ে পড়েছে। পেটিএম বা ওয়োর পরিস্থিতিও খুব ভাল বলা যায় না। ভারতীয় স্টার্ট-আপ ব্যবসার ভবিষ্যৎ কি অন্ধকারে?

What is the future of the start-up business in India

—প্রতীকী চিত্র।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৩ ১৪:৫৭
Share: Save:

ভারতে এক সময়ে ফুলেফেঁপে ওঠা স্টার্ট-আপ ব্যবসার জগতে ‘এডুটেক’ সংস্থা বাইজ়ু’জ় সম্প্রতি বেশ সঙ্কটে। এ দেশে স্টার্ট-আপ সেক্টরে নথিভুক্ত সংস্থার সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। যার ৭০ শতাংশই শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতে পারে না। অন্য দিকে, মেরেকেটে ১০০টি সংস্থা ‘ইউনিকর্ন’ মর্যাদা পায় বা বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করে উঠতে পারে। এদের মধ্যে বাইজ়ু’জ় আকার-আকৃতিতে সব থেকে বড়, সব থেকে দ্রুত উত্থিত এবং একইসঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বিতর্কিত সংস্থা। বিভিন্ন চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে এই মুহূর্তে বাইজ়ু’জ় এমন এক অবস্থায় রয়েছে, যাকে প্রায় ধরাশায়ী দশা বলা যেতে পারে। যদি সংস্থাটি টিকেও যায়, তা হলে সেটি টিমটিমে অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকবে। গত কয়েক সপ্তাহে এবং কয়েক মাসে এই কোনও মতে দশাটি লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

বাইজ়ু’জ়-এর ক্ষেত্রে তার ২২ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের আকাশচুম্বী আর্থিক মূল্যমান (টাটা মোটরস-এর থেকে খুব কম নয়) স্পর্শ করা ছাড়াও আর একটি বিষয় সকলের নজর কেড়েছিল— এই সংস্থার অতি-আগ্রাসী বিপণন কৌশল, এর প্রায় বিষাক্ত কর্মসংস্কৃতি, হিসেবনিকেশের ব্যাপারে আলো-আঁধারি ইত্যাদি। সেই সঙ্গেই এ বিষয়ে সন্দেহ থেকে গিয়েছিল যে, এই সংস্থা তার শিক্ষার্থীদের যে পরিষেবা দেওয়ার অঙ্গীকার করছে, তা শেষ পর্যন্ত দিচ্ছে কি না। ২০২১-এর মার্চ মাসে বেশ দেরি করেই সংস্থাটি তার রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায় তার সার্বিক ক্ষতির পরিমাণ ৪,৫৮৮ কোটি টাকা। এই অঙ্কটি তাদের অনুমিত আয়ের প্রায় দ্বিগুণ। ২০২২-এর মার্চ মাসের ফল এখনও জানা যায়নি। জানা গিয়েছে, সংস্থার অডিটর হাল ছেড়ে দিয়েছেন, নন-প্রোমোটার পরিচালকরা সংস্থা ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছেন এবং সংস্থার হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই হয়েছেন। সংস্থার বিনিয়োগকারীদের একজন তাঁর লগ্নির পরিমাণ ৪০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছেন। আর এক জন তাঁর হিসেবের খাতায় সংস্থার মূল্যমানই ৭৫ শতাংশ হ্রাস করে দেখিয়েছেন। এর সঙ্গে আবার জুড়েছে সংস্থার সঙ্গে ঋণদাতাদের আইনি লড়াই। এ সব ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও সংস্থার তরফে বলে যাওয়া হচ্ছে, শীঘ্রই তারা এক বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের সংস্থান করতে সমর্থ হবে। সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা বৈজু রবীন্দ্রন ক্রমান্বয়ে বলে চলেছেন, দ্রুত সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।

ধস নামার বিষয়টি স্টার্ট-আপ ব্যবসার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ (‘এডুকম্প’-এর উদাহরণ মনে রাখা প্রয়োজন)। আর এই কারণেই স্টার্ট-আপ সংস্থাগুলি তাদের উড়ানের প্রাথমিক পর্বে ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের অবহেলা করে। লগ্নি হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় তারা লভ্যাংশের চাইতে ব্যবসা বাড়ানোর বিষয়টিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে জাহির করে। তাদের অতিরিক্ত লোভ এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগও ওঠে। সংস্থাগুলির দুর্বল পরিচালন নীতি নিয়েও সমালোচনা হয়। অবশ্য ভারতে এখনও পর্যন্ত আমেরিকার ‘থেরানোস’-এর মতো ঘটনা ঘটেনি (২০১৮ সালে আমেরিকার এই চিকিৎসাপ্রযুক্তি সংস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছিল)।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংস্থার মূল্যায়নে নতুন প্রবণতা দেখা দেয়। প্রকাশ্যে আসা হিসেবনিকেশগুলির মধ্যে দেখা যায়, জ়োম্যাটোর শেয়ারের দাম প্রথমে দ্রুত বেড়ে গেলেও পরে তা পড়তে শুরু করে। এখন আবার এই সংস্থার শেয়ারের দর তার প্রাথমিক দামে ফিরে গিয়েছে। পেটিএমের ক্ষেত্রে আবার শেয়ারের দামে বৃদ্ধি দেখা না গেলেও তা পড়তে শুরু করে। নাইকা এবং পলিসিবাজারের ক্ষেত্রে চড়াই-উতরাই দেখা গেলেও পরে আংশিক উত্থান দেখা যায়। বিনিয়োগের অঙ্ক কমতে শুরু করলে বহু সংস্থা তাদের ধারাবাহিকতা এবং লভ্যাংশের দিকগুলি দেখাতে শুরু করে। নিশ্চিত ভাবে এমন প্রবণতা সংস্থার উড়ানপর্বের ব্যয় হ্রাস-বৃদ্ধির শ্লথতা এবং ব্যবসার সঙ্কোচনের দিকগুলিকে তুলে ধরে। সেই সঙ্গে শুরু হয় কর্মী ছাঁটাই।

বেশ কিছু পরিচিত স্টার্ট-আপ সংস্থা এই মুহূর্তে রক্তাল্পতায় ধুঁকছে। তাদের মধ্যে নাইকা এবং পেটিএমের অবস্থা বেশ সঙ্গিন। ওয়ো-ও দু’এক বছরের মধ্যে এই অবস্থার সম্মুখীন হবে বলে মনে হয়। বাইজ়ু’জ়-এর মতো বহু সংস্থারই প্রতিশ্রুত পুনরুত্থানের বিষয়টি দ্রুত ঘটবে বলে মনে হয় না। অনেকে আবার অন্তর্বর্তী পর্বে লাভের মুখ দেখার আশা দেখায়। এ সব থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, তাদের রসদ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তা সত্ত্বেও বাইরে থেকে আসা লগ্নির দিক থেকে সরে গিয়ে সংস্থার ধারাবাহিকতার প্রতি গুরুত্ব আরোপের বিষয়টি কিন্তু স্টার্ট-আপ ব্যবসার বাস্তব ছবিটি কেমন, তা খতিয়ে দেখার ব্যাপারে ইঙ্গিত রাখে।

বিষয়টিকে আংশিক ভাবে দেখলে চলবে না। এই ধরনের বেশ কিছু উদ্যোগের সঙ্গে বৃহত্তর অর্থনীতির যোগ রয়েছে। এগুলির মধ্যে থেকেই বেশ কিছু সংস্থা বৃহদাকার নিয়েছে এবং বিপুল সংখ্যায় কর্মী নিয়োগ করেছে। নিযুক্ত কর্মীদের মধ্যে প্রচুর আংশিক সময়ের কর্মী রয়েছেন, যাঁদের যথাযোগ্য পারিশ্রমিকের ব্যাপারে আইনি সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। বৃহত্তর স্টার্ট-আপ সংস্থাগুলি ভারতীয় বাজারের চেহারায় বদল এনেছে, ছোট ব্যবসার পরিচালনগত ক্ষেত্রে এবং ভোক্তার অভ্যাসে পরিবর্তন ঘটিয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন ডিজিটাল লেনদেনের বাইরে অন্য কিছু ভাবতেই পারেন না। দৈনন্দিন জীবনে তাৎক্ষণিক পরিষবা লাভের বিষয়ে তাঁরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ডায়াল-আপ ক্যাব পরিষেবা অনেকের কাছেই গাড়ি কেনার বিষয়টিকে অবান্তর করে দিয়েছে। কম দামে ওষুধপত্র কেনা, সহজ পন্থায় অর্থ বিনিয়োগ ইত্যাদি এখন আমাদের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে নৈমিত্তিক ব্যাপার।

আমেরিকা বা অন্য দেশের স্টার্ট-আপ মডেলকে ভারতের মতো দেশে অনেক সময়েই হুবহু অনুসরণ বা অনুকরণ করা হয়। তা সত্ত্বেও বেশ কিছু উদ্যোগের মধ্যে প্রযুক্তিগত দূরদর্শিতা বা ভাবনার গভীরতা যে নেই, তা বলা যাবে না। বাইজ়ু’জ় বা তাদের মতো অনেক সংস্থারই হয়তো গণেশ ওল্টাবে, কিন্তু সেই সঙ্গে এ-ও মনে রাখতে হবে যে, স্টার্ট-আপ অর্থনীতির অভিমুখ অনেকাংশেই বদলে দিয়েছে। তাদের ছাড়া অর্থনীতি এতটা প্রাণচঞ্চল হত না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Start-up business Byju’s Paytm
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE