Advertisement
১১ মে ২০২৪

পরীক্ষার ফলাফল কখনও শেষ কথা বলে না

একটা বোর্ডের পরীক্ষা কি কোন কিশোর বা কিশোরীর ভবিষ্যৎ জীবনকে নির্ধারিত করে দেয়? ঠিক করে দিতে পারে সে ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে? এত বছরের শিক্ষাকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলে দিতে পারি, নিশ্চয়ই নয়। লিখছেন সৈয়দ তানভীর নাসরীন আজকের দিনের ছাত্র-ছাত্রীদের টেনশন, পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে থরহরি কম্প আমি কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারি।

ফল প্রকাশের দিনে । ফাইল ছবি

ফল প্রকাশের দিনে । ফাইল ছবি

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৯ ০১:৩৩
Share: Save:

মাধ্যমিকের ফল যে দিন বেরোচ্ছিল, সেই দিন স্কুলে না থেকে, কলেজ স্ট্রিট ধরে বীণা প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখতে চলে গিয়েছিল সে। টেনশন কাটাতে ওটাই ছিল নাকি সেই সময়ের সেরা দাওয়াই। আর উচ্চ মাধ্যমিকের ফল বেরোনোর দিন বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে চলে গিয়েছিল। যখন রেজাল্ট দেখতে স্কুলে ফিরেছিল, তখন স্কুলের টাঙানো বোর্ডে দেখে তার রেজাল্ট ‘ইনকমপ্লিট’। তার পরে সাত দিনের অপেক্ষা, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদে অনেক দৌড়দৌড়ির পরে মার্কশিট হাতে পাওয়া।

প্রেসিডেন্সি কলেজের আমার ফিচেল বন্ধুটি যখন রসিয়ে রসিয়ে আমায় গল্পটা বলছিল, তখন নিউ ইয়র্কে সন্ধ্যা নামছে। কফিতে চুমুক দিতে দিতে, সে আমায় উপহাস করেই বলেছিল, ‘‘মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল নিয়ে এত টেনশনের কী আছে? এই যে আমি রেজাল্টের দিন দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, তাতে আমার জীবনে কিই বা এসে গিয়েছে?’’

আমার প্রেসিডেন্সি কলেজের বন্ধুটি হয়তো দুঃসাহসী। নাকি স্বাভাবিক ছিল বলেই কলেজ স্ট্রিট ধরে গুটি গুটি পায়ে গিয়ে বীণা প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখেছিল। হয়তো আজ থেকে ৩০ বছর আগে সেটা অকল্পনীয় ছিল না। কিন্তু আজ যখন আমার নিজের কিশোরী কন্যা একের পর এক পরীক্ষার বেড়া ডিঙোচ্ছে, তখন আজকের দিনের ছাত্র-ছাত্রীদের টেনশন, পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে থরহরি কম্প আমি কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারি। যে দিন পরীক্ষার ফলাফল বের হয়, সে দিন মা-বাবারাও কেন দুরুদুরু বুকে প্রতীক্ষা করেন, তা বুঝতে পারি।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের মতো যে সব পরীক্ষার সঙ্গে কয়েক লক্ষ পরীক্ষার্থীর ভাগ্য জড়িয়ে থাকে, তাই নিয়ে উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তা যে থাকবে, সেটা বুঝতে পারি। এবং যেহেতু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ২০ বছর পড়ানো হয়ে গেল, তাই পরীক্ষা এবং তার ফলাফলকে কেন্দ্র করে ছাত্র-ছাত্রীদের মানসিক উদ্বেলতার সঙ্গেও আমার নিত্যদিনের সহাবস্থান। কিন্তু তবু বলব, একটা মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল এক জন ছাত্রছাত্রীর জীবনে কখনও শেষ কথা বা শেষ পরিচয় হতে পারে না। এই কিছু দিন আগেই যখন ছত্তীসগঢ়ের রায়গড়ের এক জন ১৮ বছরের ছাত্র বোর্ডের পরীক্ষায় খারাপ ফল করার জন্য যখন আত্মহত্যা করেছিল, তখন ছত্তীসগঢ়েরই কবীরধাম জেলার জেলাশাসক ফেসবুকে এসে নিজের দশম শ্রেণি এবং দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ডের পরীক্ষার ফলাফল পোস্ট করে সব ছাত্রছাত্রীদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, এই দু’টি পরীক্ষায় ব্যর্থ হলেই জীবনে তুমি বাতিল হয়ে যাবে এমন মনে করার কোনও কারণ নেই।

কবীরধামের জেলাশাসক অবনিশকুমার শরণ পরিষ্কার লিখেছিলেন, ‘‘তিনি দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় ৪৪.৫ শতাংশ এবং দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ড পরক্ষীয় ৬৫ শতাংশ পেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে তাঁর ভবিষ্যতের পড়াশোনা কিংবা আরও পরে পরীক্ষা দিয়ে আইএএস হতে কোনও অসুবিধা হয়নি।’’

আসলে এ ভাবে ভাবতে হয়তো আমরা নিজেরাও শিখিনি বা আমাদের পরের প্রজন্মকেও শেখাতে পারিনি। সে জন্যই প্রতি বার যখন মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশিত হয়, কিংবা আইসিএসই বা সিবিএসই-র মতো বোর্ড পরীক্ষার ফলাফল সামনে আসে, তখন ছাত্রছাত্রীদের হতাশায় ভুগতে দেখা যায়। কেউ কেউ হয়তো গভীর মানসিক অবসাদে আত্মহননের মতো চরম পন্থা বেছে নেন। কিন্তু এই সবই তো মস্ত বড় ভুল। একটা বোর্ডের পরীক্ষা কি কোন কিশোর বা কিশোরীর ভবিষ্যৎ জীবনকে নির্ধারিত করে দেয়? ঠিক করে দিতে পারে সে ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে? এত বছরের শিক্ষাকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলে দিতে পারি, নিশ্চয়ই নয়। আসলে আমাদের জীবনের চলার পথে আরও অসংখ্য পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। এবং সেই প্রতিটি পরীক্ষার ফলাফলই ঠিক করে দেয় আমরা কোথায় পৌঁছব বা দাঁড়িয়ে থাকব।

তা হলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা বোধহয় সমাজের। বা আমরা যাঁরা আজ অভিভাবক, তাঁদের। বিরাট কোহলির ভারতীয় ক্রিকেট দলকে যেমন ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলতে নামতে হবে প্রত্যাশার গগনচুম্বী চাপ মাথায় নিয়ে এবং গোটা দেশবাসী ক্রমাগত ভেবে যাবে এ বারও ভারতীয় দলকে চাম্পিয়ন হতে হবে, তেমনই আমরা আমাদের সন্তানদের পরীক্ষা দিতে পাঠাই প্রত্যাশার পারদ মাথায় চাপিয়ে দিয়ে। আমরাও তাদের কানের কাছে ক্রমাগত বলে যেতে থাকি, তোমাকে পয়লা নম্বর হতেই হবে। যেন পরীক্ষায় সেরা না হতে পারলে জীবনই বৃথা। আমরা কত জন দিল্লিবাসী বন্দনা সুফিয়া কাটোচ-এর মতো ‘মা’ হয়ে উঠতে পেরেছি যে, ফেসবুকে গর্ব ভরে পোস্ট করতে পেরেছি, ‘‘আমার ছেলে দশম শ্রেণির পরীক্ষায় ৬০ শতাংশ নম্বর পেয়েছে। এবং এর জন্য আমি চরম আনন্দিত।’’ মনে রাখবেন, বন্দনা সুফিয়া কাটোচ-এর এই পোস্টটি সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমত ঝড় তুলে দিয়েছিল। পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ যেমন তা শেয়ার করেছিলেন, তেমনই বারো হাজারের বেশি মানুষ সেই পোস্টে এসে বিভিন্ন মন্তব্য করে গিয়েছিলেন।

আসলে আমাদের অনেকেরই জীবনের গল্প তো বন্দনার মতো। কিংবা তাঁর ছেলে আমীরের মতো। বন্দনার কথা অনুযায়ী, আমীর আসলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চরম মানসিক যন্ত্রনায় ভুগছিল। অনেক বিষয়ই তার পছন্দ না হওয়া সত্ত্বেও তাকে সেই বিষয়গুলি পড়তে হচ্ছিল। এক সময় সে মানসিক অবসাদে দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষা আর দেবে না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই কিশোর, আমীর দশম শ্রেণীর পরীক্ষা দেয় এবং ৬০ শতাংশ নম্বর পায়। বন্দনা তাঁর সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে চমৎকার লিখেছিলেন, ‘‘আমি জানি একাদশ শ্রেণি থেকে আমীর হয়তো নিজের পছন্দ মতো বিষয় পড়বে। এবং ওর জীবন নিজের ছন্দে এগিয়ে যাবে।’’ সেটাই তো স্বাভাবিক। সেটাই তো চলমান জীবনের ছন্দ। কিন্তু আমরা অবিভাবকরাই বোধহয় ছাত্র-ছাত্রীদের এক দৃশ্য এবং অদৃশ্য প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দিই, যা সবসময় তাকে অন্য কারও স্বাপেক্ষে তুলনায় বাধ্য করে।

আমরা যদি একটু অন্যরকম ভাবতে পারতাম? যদি আমরা সম্তানদের ক্রমাগত না বোঝাতাম দশম শ্রেণি কিংবা দ্বাদশ শ্রেণির এই পরীক্ষাই জীবনের চূড়ান্ত পরীক্ষা? তা হলে হয়তো এই প্রজন্ম, যারা পরীক্ষা দিচ্ছে তারা একটু সহজ ছন্দে জীবনে চলতে পারত। এত মানসিক অবসাদ, এত হতাশার মুখোমুখি এই নবীন প্রজন্মকে হতে হত না।

আসলে এই যে জীবনের সব কিছুতে, চাকরিতে, প্রেমে আমরা পরীক্ষার মার্কশিটকেই একমাত্র পাসপোর্ট হিসেবে ভাবতে শিখিয়েছি বা নিজেরাও শিখেছি, তাতেই বোধহয় বেশি গোলমাল হয়ে গিয়েছে। আমাদের যৌবনে, শাহরুখ খান যখন সত্যিই আমাদের হৃদয় জুড়ে, তখন কুন্দন শাহ তাকে নিয়ে একটা অসাধারণ ছবি বানিয়েছিলেন। সেই সিনেমায় শাহরুখ এক জন নেহাতই ছাপোষা ছাত্র, কিন্তু সেও বেচারি প্রেমে পড়ে। আর প্রেমে পড়লে তো পরীক্ষায় সেরা ফলাফল করতেই হবে। তাই ‘কভি হা কভি না’ ছবির নায়কও ভাল ফলের জন্য এক জন দোর্দণ্ডপ্রতাপ মাফিয়ার শরণাপন্ন হয়। রবীন্দ্র কপূর ওরফে গোগা কপূর অভিনীত সেই মাফিয়া চরিত্রটি অসহায় শাহরুখকে সব বিষয়ে একেবারে একশো শতাংশ নম্বরওয়ালা মার্কশিট জোগাড় করে দেয়।

আশা করা যাক, এই সময়ে আর কোনও ছাত্রছাত্রীকে কোন কারণেই কোনও রবীন্দ্র কপূরের মতো চরিত্রের শরণাপন্ন হতে হবে না নিজের মার্কশিটকে একটু ভাল দেখানোর জন্য। বরং সে জানবে তার জীবনের চলার পথই ঠিক করে দেবে তার ভবিতব্য।

(বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE