Advertisement
E-Paper

সংঘর্ষ নয়, সংলাপ

প্যালেস্টাইন নিয়ে লুসি নুসিবে-র মুখোমুখি শিবাজীপ্রতিম বসু। দর্শন ও কালচারাল স্টাডিজ়-এর অধ্যাপক, এবং প্যালেস্টাইনের নাগরিক সংগঠন ‘মিডল ইস্ট নন-ভায়োলেন্স অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসি’র প্রতিষ্ঠাতা। দীর্ঘ দিন ধরে শান্তির পথে প্যালেস্টাইন-ইজ়রায়েল সংঘাতের সমাধান খুঁজছেন।

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
রণভূমি: গাজ়া সীমান্তে ইজ়রায়েলি সেনার সঙ্গে সংঘর্ষে টিয়ার গ্যাসের সামনে প্যালেস্টাইনি মানুষ। এএফপি

রণভূমি: গাজ়া সীমান্তে ইজ়রায়েলি সেনার সঙ্গে সংঘর্ষে টিয়ার গ্যাসের সামনে প্যালেস্টাইনি মানুষ। এএফপি

লুসি নুসিবে। দর্শন ও কালচারাল স্টাডিজ়-এর অধ্যাপক, এবং প্যালেস্টাইনের নাগরিক সংগঠন ‘মিডল ইস্ট নন-ভায়োলেন্স অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসি’র প্রতিষ্ঠাতা। দীর্ঘ দিন ধরে শান্তির পথে প্যালেস্টাইন-ইজ়রায়েল সংঘাতের সমাধান খুঁজছেন। ১৯৭৩ সালে, অক্সফোর্ডের প্রখ্যাত ভাষা-দার্শনিক, জে এল অস্টিন-এর এই কন্যার প্রেম ও বিবাহ প্যালেস্টাইনের পরিচিত বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক, সারি নুসিবে-র সঙ্গে, যাঁদের পরিবার ১৩০০ বছর ধরে জেরুসালেমের বাসিন্দা, এবং যে চোদ্দোটি জনগোষ্ঠী নিয়ে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাদের অন্যতম গোষ্ঠীর মানুষ। ১৯৭৮ থেকে জেরুসালেমের বাসিন্দা লুসি সম্প্রতি ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ (সিআরজি) আয়োজিত শরণার্থী বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক অধিবেশনে কলকাতায় এসেছিলেন।

প্রশ্ন: অক্সফোর্ড দর্শনচর্চার উচ্চ পরিবেশে বড় হয়ে চার দশকেরও বেশি সময় প্যালেস্টাইনে থাকা। প্রায়-বিপরীত এই দু’রকম জীবনের অভিজ্ঞতা কেমন?

লুসি নুসিবে: এটা ঠিকই, অক্সফোর্ড দর্শনচর্চার গজদন্তমিনার থেকে প্যালেস্টাইনের বিদ্যাচর্চার পরিবেশ অনেকটাই আলাদা, কোনও তুলনাই চলে না। কিন্তু আমার স্বামী, সারি নুসিবে ওখানকার অন্যতম বুদ্ধিজীবী। তাই সংসারে বিদ্যাচর্চার পরিবেশ যথেষ্ট আছে। এবং বিষয় হিসেবে ‘দর্শন’ সব সময় ‘প্রশ্ন করতে’ শেখায়, ‘যা আছে’ তাকেই মেনে নিতে দেয় না, বিরুদ্ধ পরিবেশেও সমাধানের রাস্তা খোঁজায়। এই প্রসঙ্গে জানাই, ২০১৮-র ২৯ নভেম্বর প্যালেস্টাইনের ‘সংহতি দিবস’-এর একাত্তর বছর পূর্ণ হল। ১৯৪৭-এর এই দিনে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় জেরুসালেমকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়ে প্যালেস্টাইনে ইহুদি ও আরবদের জন্য দু’টি রাষ্ট্রের প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্যালেস্টাইনের আরব অধিবাসীদেরও নিজের রাষ্ট্রে ‘ফিরে আসা’র অধিকার দেওয়া হয়। এটা অনেকেই ভুলে যান। অথচ এটা প্যালেস্টাইনের লক্ষ লক্ষ ঘরছাড়া মানুষের প্রতি গত সাত দশক ধরে যে ধারাবাহিক অন্যায় হয়ে চলেছে, তা মনে রাখারও দিন।

প্র: প্যালেস্টাইন-ইজ়রায়েল তীব্র দ্বন্দ্বে প্রতিনিয়ত অস্থির ওই অঞ্চলে আপনি অহিংস উপায়ে সমাধানের পথ খুঁজছেন। এক দিকে ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, অন্য দিকে আরবদের ‘হামাস’। তার মধ্যে এটা কি আদৌ সম্ভব?

উ: কঠিন প্রশ্ন। তবু বলি, প্রতি শুক্রবার গাজ়ায় অসংখ্য মানুষ কিন্তু সম্পূর্ণ অহিংস ভাবে জমায়েত হন তাঁদের ‘ঘরে ফেরা’র দাবি নিয়ে। অসহিষ্ণুতা দু’পক্ষেই আছে, এবং দু’পক্ষই চায় নিজের লোকেদের একে অন্যের প্রতি অসহিষ্ণু করে রেখে ইহুদি–আরবদের মেরুকরণ জিইয়ে রাখতে। এর জেরে মানুষ আর ‘মানুষ’ থাকে না, একে অন্যের শত্রু হিসেবেই বেঁচে থাকেন। আমি অহিংস সমাধানের কথা বলি, কারণ অ-মানবীকরণের ছক ভেঙে তাঁদের ‘মানুষ’ হিসেবে দেখি। চাই, যাতে একে ‘অপর’কে মানুষ হিসেবে গণ্য করেন, যেন তাঁরা না ভাবেন যে— কেবল নিজেরাই ঠিক, অন্যরা ভুল। মুশকিল হল, বেশির ভাগ সময় সংঘর্ষের কথাই প্রচার পায়।

অথচ দু’পক্ষেই বহু সুভদ্র মানুষ আছেন, যাঁরা এর অবসান চান, তাঁরা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক প্রচারের আলোয় আসেন না।

প্র: আপনি অন্য এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কেবল শীর্ষ সম্মেলনে নেতাদের মধ্যে চুক্তিতে কিছু হবে না, প্রয়োজন দু’পক্ষের মানুষের মধ্যে, বিশেষত মেয়েদের মধ্যে সৃষ্টিশীল বার্তালাপ চালানো। এটাও কি সম্ভব?

উ: এক সময় কিন্তু এই পরিবেশ অনেকটাই ছিল। সব মানুষেরই— নিছক একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর নয়— অজস্র রকম পরিচয় থাকে। এই নানা পরিচয়ের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তোলা বা বার্তালাপ চালানো যায়। যেমন, এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যেই মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে, অনেক সময় বঞ্চনা, অত্যাচারের শিকার। এই ‘সাধারণ’ অভিজ্ঞতায় তাঁরা কাছাকাছি আসতে পারেন। এখন অবশ্য পরিস্থিতি অনেকটাই প্রতিকূল, বিশেষ করে ২০০০ সালের পর ‘ক্যাম্প ডেভিড’ (ইজ়রায়েল ও মিশরের মধ্যে ১৯৭৯-এর শান্তি চুক্তি) চুক্তির ব্যর্থতার পর থেকে। অথচ, গাজ়া আর ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে (জর্ডন নদীর পশ্চিম কূল) ইজ়রায়েলের বেআইনি দখলদারির বিরুদ্ধে সংগঠিত আরবদের প্রথম অভ্যুত্থান— প্রথম ‘ইন্তিফাদা’ তো (১৯৮৭) শান্তিপূর্ণ আইন-অমান্য আন্দোলন হিসেবেই গড়ে উঠেছিল।

লুসি নুসিবে

কিন্তু এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে সংঘাতের ছবিটাই বড় হয়ে ওঠে। ইজ়রায়েলি ট্যাঙ্কের দিকে বালক ও শিশুদের পাথর ছোড়ার পুরনো ছবি নতুন প্রজন্মের কাছেও অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে, যার পাল্টা ইজ়রায়েলি সেনা ছোটদের কপাল তাক করে গুলি ছোড়ে।... ইজ়রায়েলে এমন প্রচার অব্যাহত যে আসলে প্যালেস্টাইনের মায়েরা তাঁদের শিশুদের ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করে প্রতিরোধ করছেন। অর্থাৎ, তা অনৈতিক ও জঘন্য। যদিও, বাস্তবে তেমনটা ঘটছে না— ছোটরা নিজেরাই পথে নামছে। এই ভাবে, আরব মায়েদের ‘অমানবিক’ ইমেজ নির্মাণ চলেছে, যা শান্তিপ্রিয় ও সহানুভূতিপূর্ণ ইহুদি মায়েদের মনেও আরব মায়েদের এক বিকৃত ছবি তৈরি করছে। ফলে, মেয়েদের মধ্যে বার্তালাপের পরিবেশ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

প্র: যে সব শিশু-কিশোর আহত হচ্ছে তারা কি ঠিকমতো চিকিৎসা পাচ্ছে?

উ: কোথাও কোথাও পাচ্ছে, কোথাও নয়। এর মধ্যে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের অবস্থা কিছুটা ভাল, সেখানে চিকিৎসার কিছু ব্যবস্থা হচ্ছে, কিছু ইজ়রায়েলি হাসপাতালেও, কিন্তু গাজ়া-র অবস্থা করুণ। পূর্ব জেরুসালেমের প্যালেস্টাইনীয় হাসপাতালে কিছু ব্যবস্থা আছে, তবে সেখানে বাচ্চাদের সঙ্গে বাবা-মাকে যেতে দেওয়া হয় না, কেবল দাদু-ঠাকুরমাই ভেতরে যেতে পারেন।

প্র: গাজ়া আর ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, এই যে পরস্পর থেকে স্বতন্ত্র প্যালেস্টাইনের দু’টি টুকরো, এখানকার মানুষজনের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম কী? একে অন্যের খবর পায়?

উ: খবরের প্রণালী মানুষ তৈরি করে নেয়। এ যুগে বিশেষ করে ফেসবুক মারফত। কিন্তু তাঁদের মধ্যে যে শারীরিক দূরত্ব, তা এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সৃষ্টি করছে। দেখুন, জেরুসালেমের বাসিন্দা হলেও যে হেতু এখনও আমার ব্রিটিশ পাসপোর্ট, আমার চলাচলের আইনি স্বাধীনতা আছে, তবু গত বিশ বছর আমি গাজ়ায় ঢুকতে পারিনি। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের মানুষও জেরুসালেমে ঢুকতে পারেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা গাজ়ায় ঢুকতে পারেন না, গাজ়ার মানুষ তার সীমানার বাইরে বেরোতে পারেন না। এ এক অসহনীয় অবস্থা!

প্র: রাজনীতির প্রসঙ্গে আসি। আপনার স্বামী প্যালেস্টাইনি রাজনীতিতে ‘মধ্যপন্থী’ বলে চিহ্নিত। কিন্তু এমন কণ্ঠস্বরকেও তো থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাঁকে জেলে পুরে, যার বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ হয়েছিল, আইসায়া বার্লিন-এর মতো নামী বুদ্ধিজীবীও তাতে যোগ দিয়েছিলেন।

উ: ঠিকই। এ ভাবে ইজ়রায়েল হয়তো শান্তির কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছিল। এবং তাতে দু’পক্ষের চরমপন্থীরাই উৎসাহিত হয়েছেন। কিন্তু সারা বিশ্বে নানা জায়গায় বসবাসকারী প্যালেস্টাইনের মানুষ সত্যিই সমাধানের অন্য রাস্তাও খুঁজছেন। বিশেষত, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতায় ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার নানা দেশে যে ভাবে শরণার্থীদের ঢল নেমেছে, তার সঙ্গে লেবানন, প্যালেস্টাইনের মানুষ কেবল ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকায় নয়, দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতেও যে ভাবে ঢল নামিয়েছে, তা নতুন করে প্যালেস্টাইনের সমস্যা সামনে নিয়ে এসেছে এবং আজ অনেককেই অন্য পথে, কেবল সংঘর্ষের বদলে, সমাধানের কথা ভাবাচ্ছেন।

প্র: এই সংঘর্ষের বাতাবরণে ওখানকার দু’পক্ষের মানুষ আপনার শান্তির উদ্যোগকে কী চোখে দেখে?

উ: দেখুন, আমি কোনও ‘শিক্ষা’ দিতে আসিনি। ১৯২০ সাল থেকে চলা প্যালেস্টাইনের মানুষের আন্দোলন তো শান্তিপূর্ণই ছিল। তাই, কোনও নতুন কথা তাঁরা শুনছেন না। আসলে অল্প বয়স থেকে ওখানে কালচারাল স্টাডিজ়-এর ক্লাস নিতে নিতে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিশি। আমি স্বচ্ছন্দে আরবিতে কথা বলতে পারি। আমি তখনই কোথাও অংশ নিতে যাই, যখন লোকে আমায় ডাকেন, মেয়েদের নিয়ে কর্মশালায় সকলের কথা শুনি, সবাইকে নিয়েই অন্তত সামাজিক ক্ষেত্রে শান্তির পথ খুঁজি।... এখন অবশ্য মোবাইল ফোনে ফিল্ম বানিয়ে এই সব কথা ছড়িয়ে দিতে প্রশিক্ষণও দিচ্ছি।

প্র: একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন। অত দিন আগে, ইংল্যান্ড থেকে জেরুসালেমে গিয়ে মানাতে সমস্যা হয়নি?

উ: কিসের সমস্যা? মানুষ যখন প্রেমে পড়ে, কোনও কিছুই সমস্যা থাকে না! (লাজুক হাসি)

Interview Lucy Nusseibeh Palestine Peaceforce লুসি নুসিবে
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy