Advertisement
০৭ মে ২০২৪
আর এক গভীর অসুখ
করোনাভাইরাস

অভিজ্ঞতা বলে, ভয়ভীতির পরিবেশ দিয়ে উচ্চশিক্ষা হয় না

করোনা-নিরপেক্ষ ভাবেও আজকের বিশ্ব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ভারতও তার সঙ্গে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে।

মইদুল ইসলাম
শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

কোভিড-১৯ আতঙ্ক এমনই আকার ধারণ করেছে যে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় এখন খুলতে পারছে না। ছাত্রছাত্রীদের প্রবল অসুবিধা। কিন্তু প্রশ্ন সেটা নয়। প্রশ্ন হল, করোনা পরিস্থিতি যখন একটু আয়ত্তের মধ্যে আসবে, সেই করোনা-উত্তর সময়েও কি দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের নেতা-মন্ত্রীরা ঠিক নীতি গ্রহণ করতে পারবেন?

আসলে, করোনা-নিরপেক্ষ ভাবেও আজকের বিশ্ব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ভারতও তার সঙ্গে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। এখন রাজনৈতিক উপরমহলকেই যদি শিক্ষানীতি তৈরি করতে হয়, তা হলে আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষায় পরিবর্তন আসবে কী ভাবে তা নিয়ে তাঁদের রীতিমতো সচেতন হওয়া দরকার। সেটা না ঘটায়, আমাদের দেশে এখনও মান্ধাতার আমলের শিক্ষানীতিই চলছে, যা একবিংশ শতাব্দীর গতি ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। শিক্ষানীতির পরিবর্তন কোনও রাজনৈতিক পার্টির মতাদর্শ অনুযায়ী হওয়া উচিত নয়। বরং এই শতকের নতুন কর্মক্ষেত্রের চাহিদা পূরণ করতে হলে দরকার এমন একটি উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা, যা একেবারেই পার্টি-সংযোগহীন।

এই কাজের জন্য দুটো শর্ত প্রয়োজন। এক, উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারের নাক গলানো বন্ধ করা। দুই, বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্ত পরিবেশ গড়তে হলে ছাত্র, অধ্যাপক, কর্মচারী এবং কর্তৃপক্ষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা। দ্বিতীয় শর্ত, অর্থাৎ সু-পরিবেশ গড়ে তোলা তখনই সম্ভব যখন প্রথম শর্তটি পূরণ হবে।

বামফ্রন্ট জমানায় উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে একটি অলিখিত পার্টিতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ছিল। তৃণমূল জমানার শুরুর দিকে উচ্চশিক্ষাকে পার্টিতন্ত্র থেকে সরিয়ে আনার কিছু প্রচেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছর পর দেখা গেল, বামফ্রন্টের অনুকরণ করতে গিয়ে এই জমানাতে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় একটি নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে। সেই সমস্যা হল, কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট জমানার পুরনো ভদ্রলোক এলিটদের বিরুদ্ধে নব্য এলিটদের চোখরাঙানি। পাশ করিয়ে দেওয়ার আন্দোলন, শিক্ষক নিগ্রহ এবং ছাত্র রাজনীতির নামে বালখিল্য সব দাবি, এবং সব ধরনের অভদ্রতা।

জনগণের করের টাকায় চলা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মাইনে দিচ্ছি বলে যা বলছি তা-ই শুনতে হবে’ গোছের হুকুমদারি মাঝেমধ্যেই শোনা যাচ্ছে। শুধু বিভিন্ন রাজ্যে নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীসান্ত্রিরাও এই রকম বলে যাচ্ছেন। কেউ আবার পরিষ্কার করে সে কথা না বললেও হাবেভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। আসলে, উচ্চশিক্ষা নিয়ে তাঁদের চিন্তা কম, কারণ সেখানে ভোট কম। আর যেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে বা নতুন করে তৈরি হচ্ছে, সেখানে বিভিন্ন রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের বহু ক্ষেত্রে হরেক রকমের সরকারি ভীতি প্রদর্শনের নীতি অবলম্বন তো চলতেই পারে। সামাজিক মাধ্যমে তাদের নামে কুৎসা ও অপপ্রচারও শুরু হয়েছে।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সব রকমের মানুষ থাকার কথা। মতাদর্শগত ভাবে কেউ দক্ষিণপন্থী হতে পারেন, কেউ বামপন্থী। মতাদর্শের ভিন্নতা এবং মতপার্থক্য কেবল বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেই নয়, যে কোনও বিভাগের মধ্যেও থাকা সম্ভব, এমনকি সেটা প্রয়োজনীয়ও বটে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে ‘অক্সব্রিজ’-এর রাজনীতি বিভাগেই চূড়ান্ত মতাদর্শগত পার্থক্য রয়েছে। ঘটনা হল, একই মতের মানুষ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হয় না— রাজনৈতিক দল হয়। একে অপরের থেকে শেখা এবং জানা কোনও ভুল কাজ নয়। চাই গণতান্ত্রিক পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার মানসিকতা এবং নতুন কর্মসংস্থানের জন্য শিক্ষাব্রতীদের মধ্যে দক্ষতা ও উদ্ভাবনী শক্তি সঞ্চার করার আগ্রহ।

ভয়-ভীতির পরিবেশ দিয়ে শিক্ষা, বিশেষত উচ্চশিক্ষা, হয় না। শাসন এবং নিয়মের মধ্যে যেমন পার্থক্য করতে হয়, তেমনই দ্বিমত আর রাজনীতির মধ্যেও ফারাক করা দরকার। কানপাতলা রাজনীতিবিদরা যদি উচ্চশিক্ষার উপরে ছড়ি ঘোরান, তা হলে উচ্চশিক্ষার অবস্থা কী হতে পারে সহজেই অনুমেয়। অমুক পার্টি এখন ক্ষমতায়, তাই বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে একমাত্র সেই পার্টিরই লোক বসবে, এহেন বিধান দিয়ে আর যা-ই হোক উচ্চমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলে না। আবার, অমুক ব্যক্তি সাবধানী, সতর্ক থাকতে চান বলে আজ যে পার্টি ক্ষমতায় আছে, তিনি কার্যত সেই পার্টির দালালি করবেন, সেটাও ঠিক কাজ হতে পারে না। রাজনৈতিক মতবাদ এক জিনিস, আর ‘আইন’ মেনে কাজ করা আর এক। দুটোকে গুলিয়ে ফেলেন যাঁরা, তাঁরা হয় আহাম্মক নয় সুযোগসন্ধানী।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়তে হলে যেমন খোলা মাঠ বা খেলাধুলো করার জায়গা দরকার— ঠিক তেমন জরুরি উদারমনা পরিবেশ। দুইয়ের অভাবেই বিভিন্ন রকমের কলুষ মনের মধ্যে বাসা বাঁধে। নতুন প্রজন্মের শিক্ষানুরাগীদের মধ্যে ভিডিয়ো গেম ও সামাজিক মাধ্যমে বেশি সময় ব্যয় করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এই সব কারণে দেখি, ছাত্রছাত্রীদের রাতে ঘুম কম হয়, মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটে। এটা উচ্চশিক্ষার উপযুক্ত দিনযাপন নয়। দীর্ঘ বই বা নিদেনপক্ষে প্রবন্ধ মন দিয়ে পড়তে হলে শুধু সামাজিক মাধ্যমে পড়ে থাকলে হবে না। আর সামাজিক মাধ্যমে অহরহ নিজের মনের ক্ষোভ-জ্বালা-যন্ত্রণা ব্যক্ত করে শিক্ষাজগতের সমস্যাও মিটবে না। সামাজিক মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, কিন্তু আবার তত গুরুত্বপূর্ণও নয়। অথচ এর সাহায্যে এখন যে কোনও ব্যক্তিকে টার্গেট করে ভিলেন বা হিরো বানানো বড্ড সহজ। প্রত্যেক মুহূর্তে একটি করে রায় দেওয়া হয়, টিপ্পনি কাটাও সহজ। প্রত্যেকেরই সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়া সহজ। অথচ এই বিশ্বে এক দিকে যেমন আন্তঃবৈষয়িক শিক্ষা ও গবেষণা এগিয়ে গিয়েছে, তেমন নতুন নতুন ক্ষেত্র ও বিশেষজ্ঞের প্রভাবও বাড়ছে। ইন্টারনেট থাকলেও তাই যে-কেউ সবজান্তা হয়ে যেতে পারে না।

এই সব কিছুর মধ্যে আসলে একটা বড় সঙ্কটের চিহ্ন আছে। সাফল্যের জন্য ধৈর্য যে একটি মৌলিক বস্তু, তা আজ বিস্মৃত, সেটা শেখানোর মতো মানুষও দ্রুত বিলীয়মান। অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে মন দেওয়ার পরিবেশটাই আজ আর খুঁজে পাওয়া ভার। এখন না-হয় চার দিক স্তব্ধ, সব কাজ করোনার ফলে এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু গত কিছু কাল ধরেই কি আমরা এই এলোমেলোর মধ্যে বাঁচছি না? শিক্ষাজগতে দেখি, বেশির ভাগই কাজ করেন না, আর যাঁরা করেন, তাঁদের পথ রোখার জন্য লোকের অভাব নেই।

কেউ বলতে পারেন, এই সব নিয়ে কি শুধু নিন্দা করলেই কাজ হবে? নিশ্চয়ই হবে না। তবে নিন্দা না হোক, সমালোচনাটা থাকতে হবে। সেটাও না থাকলে সঙ্কট থেকে বেরোনো যাবে কী করে? নিন্দা না থাকলে পৃথিবীকে তার হৃত গৌরবের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাটাও করা সম্ভব নয়। নিন্দুক অনেক সময় শুধু নিন্দা করেন না, সমালোচনার মধ্যে দিয়ে নতুন পথ খুঁজতে বলেন। মুশকিল হল, শিক্ষা-অশিক্ষা-কুশিক্ষা নিয়ে একেই কেউ ভাবতে আগ্রহী নন, তার উপর এই দেশে অন্য রকম কোনও ভাবনাচিন্তা শুনলেই মনে করা হয় নিশ্চয় একটা কোনও অভিসন্ধি আছে!

রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE