Advertisement
০৫ মে ২০২৪

কৃষকেরা রাজনৈতিক দলের ভোটের ‘তাস’ হয়ে উঠেছে

কৃষিঋণ মকুবের মধ্যে দিয়েই যে কৃষকদের সঙ্কটমোচন হবে, বিশেষজ্ঞেরা তা মনে করেন না। ২৩ ডিসেম্বর কৃষিদিবস পেরিয়ে এসে লিখছেন পঙ্কজ বিশ্বাসঅথচ, এই কথা তো আমরা জানি ভারত কৃষিপ্রধান দেশ। এই দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের রুটি-রুজি কৃষিব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।

শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:১০
Share: Save:

উহাদের এই ভাদ্রের রৌদ্রে মাথা ফাটিয়া যাইতেছে, তৃষায় ছাতি ফাটিয়া যাইতেছে, তাহার নিবারণজন্য অঞ্জলি করিয়া মাঠের কদর্দম পান করিতেছে; ক্ষুধায় প্রাণ যাইতেছে, কিন্তু এখন বাড়ী গিয়া আহার করা হইবে না, এই চাষের সময়। সন্ধ্যাবেলা গিয়া উহারা ভাঙ্গা পাতরে রাঙ্গা রাঙ্গা বড় বড় ভাত, নুন, লঙ্কা, দিয়া আধপেটা খাইবে। তাহার পর ছেঁড়া মাদুরে, না হয় ভূমে, গোহালের এক পাশে শয়ন করিবে— উহাদের মশা লাগে না। তাহার পরদিন প্রাতে আবার সেই এক হাঁটু কাদায় কাজ করিতে যাইবে ...।”

বঙ্কিম সেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি কৃষকদের দুরবস্থা দেখে ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধে এমনটা লিখেছিলেন। তার পর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। এই সময়ে দাঁড়িয়েও কি কৃষকদের অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়েছে বলে আমরা জোর গলায় দাবি করতে পারি? দৈনিক সংবাদপত্রের পাতা ওলটালেই কোথাও ঋণের দায়ে কৃষকের আত্মহত্যা, ফসল নষ্ট হওয়ার কারণে কৃষকের বিমর্ষ মুখের ছবি, কিংবা ফড়েদের খপ্পরে তাদের অসহায়তার খবর চোখে পড়ে। আলু বা পেঁয়াজের দাম একটু বেড়ে গেলে আমাদের গলা ওঠে। মিডিয়াও সেটাকে খবর করে। কিন্তু এই প্রশ্ন ওঠে না যে, এই দাম বৃদ্ধির সঙ্গে কৃষকের প্রাপ্য (যদিও দামবৃদ্ধির জন্য মিডলম্যানও দায়ি) জড়িয়ে রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের দেশে আজও প্রতিদিন ৪৭ জন কৃষক আত্মহত্যা করে, ১০০ জন কৃষক আত্মহত্যার চেষ্টা করে। কৃষির দুরবস্থা জেনেই আজকাল কৃষক তার সন্তানকে কৃষিকাজে নামাতে চায় না। প্রতিদিন ২১৫০ জন কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে অন্য পেশা গ্রহণ করছে। সুরেশ তেন্ডুলকর কমিটির তথ্য অনুযায়ী, ভারতের ৪২ শতকরা কৃষক আজও বিপিএল তালিকার অন্তর্ভুক্ত।

অথচ, এই কথা তো আমরা জানি ভারত কৃষিপ্রধান দেশ। এই দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের রুটি-রুজি কৃষিব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। অর্থাৎ, এই বিপুল জনগোষ্ঠী ও উৎপাদন গোষ্ঠীকে সরিয়ে রেখে দেশের সার্বিক বিকাশ কখনওই সম্ভব নয়। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যারা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিল, সেই কৃষক সম্প্রদায়ই স্বাধীনতার এত বছর পর আজও অবহেলিত। বরং আজ তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভোটের ‘তাস’ হয়ে উঠেছে।

মনে পড়বে, ২০১৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় আসে বিশেষ করে এই কৃষকদের সমর্থন দ্বারা। কিন্তু যে স্বপ্ন দেখিয়ে তারা এই কৃষকদের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, যেমন—কৃষকদের কৃষিঋণ মুকুব, উৎপাদন বাড়ানো, দালাল মুক্ত বাজার তৈরি, সেই স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, প্রশ্ন জাগে। উপরন্তু নেমে এসেছে ডিমনিটাইজেশন নামক খাঁড়ার ঘা। আর এর পরিণতি হয়েছে ভয়ানক। একটি তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ৩ লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছে। উল্লেখ্য, কেন্দ্র ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত কৃষক আত্মহত্যার কোনও পরিসংখ্যানই প্রকাশ করেনি।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়বে এই বছরের মে মাসে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চল কিংবা তার কয়েক মাস পরে, নভেম্বরে দিল্লিতে হিন্দি বলয়ের কৃষকদের লং মার্চের কথা। মূলত, কৃষিঋণ মকুবের দাবি নিয়েই তারা পথে নামে। কৃষিঋণ মকুবের এই দাবি এবং এই আন্দোলন কিন্তু তাদের ঘা-কেই চিনিয়ে দেয়। জানা যায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকেরা আড়াই লক্ষ কোটি টাকার বেশি কৃষি ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হওয়া, ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, কোথাও বা ‘মিডলম্যান’এর খপ্পরে পড়ে দাম না পাওয়ার প্রসঙ্গ বার বার উঠে এসেছে এই ঋণ পরিশোধ করতে না পারার কারণ হিসাবে।

আর বিরোধীদল হিসাবে কংগ্রেস কৃষকদের সেই ক্ষোভকেই নির্বাচনী কৌশলের প্রধান ইস্যু হিসাবে প্রয়োগ করেছে। ফলও মিলেছে হাতেনাতে। সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে তাদের দল জয়ী হয়েছে। তাই শপথ নেওয়ার পর পরই তিন হিন্দি বলয় রাজ্যে নব নির্বাচিত রাজ্য সরকার কৃষিঋণ মকুবের কথা ঘোষণা করেছে। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীশগঢ় মিলিয়ে মোট ৭২ হাজার কোটি টাকার এই খয়রাতি। অবশ্য শুরুটা হয়েছিল উত্তরপ্রদেশ দিয়ে। যাই হোক কংগ্রেসের এই ঋণ মকুবের তাস কি এর পর বিজেপিও সারা দেশে খেলবে না? ইতিমধ্যে গুজরাত ৬৫০ কোটি টাকা গ্রামীণ বিদ্যুৎ বিল মকুব করে বসেছে। অসমের বিজেপি সরকারও সেই পথে হাঁটছে।

কিন্তু কৃষিঋণ মকুবের মধ্যে দিয়েই যে কৃষকদের সঙ্কটমোচন হবে, বিশেষজ্ঞেরা তা মনে করেন না। এতে তাদের সাময়িক সুরাহা হতে পারে শুধু। অনেক ক্ষেত্রে নতুন করে ধার নিয়ে ফের এক বার ভোটের মুখে তা মকুব হবে বলে আশা করতে শুরু করেন কৃষকেরা। নাভিশ্বাস ওঠে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির। তাই কৃষিঋণ মকুবকে কিছুতেই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অঙ্গ করা উচিত নয় বলে মনে করেছেন তাঁরা।

(উদ্ধৃতির বানান অপরিবর্তিত)

চাপড়া গভর্নমেন্ট কলেজের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Farmer Political Party
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE