উদ্বিগ্ন: জাতীয় নাগরিক পঞ্জি কেন্দ্রের সামনে নথি হাতে অপেক্ষা, মরিগাঁও, অগস্ট ৪। পিটিআই
অসমে নবায়িত জাতীয় নাগরিক পঞ্জির ঘোষণা, তাকে কেন্দ্র করে ‘বৈধ-অবৈধ’ নাগরিক কারা হবেন, বা হবেন না, এই নিয়ে কেন্দ্রীয় রাজনীতি ও আন্তঃরাজ্য রাজনীতির দড়ি-টানাটানি শুরু হওয়ার ক’দিন আগে গবেষণার কাজে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। ১৯৪৭ সালের পর অসম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো থেকে যাঁরা সিলেটে ফিরে যান তাঁদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। দেখলাম, প্রশ্ন শুরু করার আগে ওঁদের বহু উদ্ভ্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে। সৌজন্যে, এনআরসি। বয়স্ক মানুষগুলোর চোখে-মুখে গভীর চিন্তার রেখা— ছেড়ে আসা দেশের মানুষদের বিপন্নতার খবর আছড়ে পড়েছে তাঁদের খণ্ডিত অংশেও।
দেশভাগের আগে ও পরে বার বার নানা রাজনৈতিক কাটাছেঁড়ার দাম দিতে হয়েছে অসমের বেশ ক’টি জনগোষ্ঠীকে। এখনও সেই বাস্তুহীনদের তাড়া করে ফেরে আর এক বার উদ্বাস্তু হওয়ার ভয়। সাতচল্লিশের সিলেট-ভাগ একটা উদাহরণ। অনেকেই হয়তো জানেন না, সিলেট গণভোটের দুর্যোগের সময় হাতে গোনা কিছু ঘটনা ছাড়া, প্রায় কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। যদিও অসম প্রদেশ ও তার মিশ্র বিচিত্র জনবিন্যাস এবং ক্ষমতার বাঁটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত উনিশ শতকের গো়়ড়া থেকে। ব্রিটিশদের প্রশাসনিক স্বার্থে এ সব সংঘাতে আরও ইন্ধন জোগানো হয়, অসমের জাতিবিন্যাস ও শ্রেণিবিন্যাসের ছবিটা ক্রমশ পাল্টে যায়। ১৯৫১’র জনশুমারিকে কেন্দ্র করে নাগরিকদের গণনার যে প্রক্রিয়া বা এনআরসি ভারতের সব রাজ্যে শুরু হয়, একমাত্র অসমে এখনও সেই হিসেব কষা চলছে। ১৯৬০ ও ১৯৭২ সালে অসম-বাঙালি ভাষিক পরিচিতির প্রশ্নে আসু-র ১৯৭৯’র বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলনের পরে, সমাধানসূত্র হিসেবে ১৯৮৫-র ১৪ অগস্ট মধ্যরাতে ত্রিপাক্ষিক অসম-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে বিদেশি শনাক্তকরণ ও বিতাড়নের জন্য ১৯৭১-এর ২৪ মার্চের মধ্যরাতকে ভিত্তি-তারিখ স্থির করা হয়। এই চুক্তিকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ১৯৫৫-র নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে ১৯৮৫ সালেই ৬(ক) ধারা সংযোজিত হল, নাগরিকত্বের ভিত্তিবর্ষের প্রশ্নে।
১৯৮৫ সালের অসম চুক্তির পর আনন্দবাজার পত্রিকায় (১৭.০৮.৮৫) লেখা হয়েছিল, ‘‘দেশ বিভাগের সময় জাতির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের তরফে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় মানুষদের বার বার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছে, স্বাধীন ভারত তাঁহাদের বিস্মৃত হইবে না, প্রয়োজনে সব সময়ে তাঁহাদের জন্য দরোজা খোলা থাকিবে। সেই প্রতিশ্রুতির কথা মনে রাখিলে কিন্তু ১৯৭১-এর পর যাঁহারা অসমে প্রবেশ করিয়াছেন, তাঁহাদেরও নির্বিচারে দেশের বাহিরে ছুঁড়িয়া ফেলা যায় না।’’ দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা (১৭.০৮.৮৫) আবার আর এক ধাপ এগিয়ে লিখেছিল, ‘‘যে আমলাতন্ত্র এত দিন সকল অনুপ্রবেশকে সাহায্য করেছে, তারাই বিদেশি চিহ্নিতকরণ ও বহিষ্কারের দায়িত্ব নিয়েছে।’’ ১৯৯৭ থেকে আর একটি নতুন শব্দ অসমে আতঙ্ক সৃষ্টি করে: ভোটার লিস্টে নামের পাশে লেখা ‘ডি’ (ডাউটফুল)। সংযোজন: ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’।
নাগরিক পঞ্জি নবায়নের এ পর্যন্ত দু’টি খসড়া প্রকাশ হয়েছে। গত ৩০ জুলাই দ্বিতীয় খসড়া প্রকাশের পর প্রত্যন্ত অসমের সঙ্কট সর্বভারতীয় মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, যার কারণ সম্ভাব্য ‘রাষ্ট্রহীন’ মানুষের সংখ্যার হিসেব। একেবারে চল্লিশ লক্ষ? এঁরা ঠিক কারা? এঁরা কি সত্যিই বাংলাদেশি বা অনুপ্রবেশকারী? অথচ চূড়ান্ত খসড়া তালিকায় বহু ‘খিলঞ্জিয়া’ (ভূমিসন্তান) অসমিয়া পরিবারের সদস্যেরও নাম নেই, নাম নেই দেড় লক্ষ নেপালিরও। সঙ্গত প্রশ্ন ওঠে: এনআরসি-র শেষ তালিকায় (যা প্রকাশিত হওয়ার কথা ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮) যাঁদের নাম থাকবে না, সেই রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীর ঠিক কী অবস্থা হবে? কত লোকের স্থান হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে? এই আটক শিবির কি গণতান্ত্রিক ভারতের মেজাজের সঙ্গে খাপ খায়?
কথা হচ্ছিল শিলচর শহরের স্কুলশিক্ষিকা পাপড়ি ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তাঁদের পরিবার শিলচরে অনেক পুরনো। তাঁর দাদু স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। ‘লেগাসি’ প্রমাণ করা তাঁদের পক্ষে সহজই ছিল। এনআরসি কর্তারা ‘এনকোয়ারি’র সময় তাঁর কাগজপত্র ও মৌখিক উত্তরে সন্তুষ্টও হন। কিন্তু দ্বিতীয় খসড়া লিস্টে তাঁদের নাম নেই।
তালিকায় নাম না থাকলে সম্ভাব্য ফল কী হতে পারে? এখনও অবধি বলা হচ্ছে ‘ডি’ ভোটারদের ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখার কথা। এই ক্যাম্পগুলো কোথায়? বাস্তবে কোনও ডিটেনশন ক্যাম্পই অসমে নেই। এ অবধি মুখ্যত ৬টি কেন্দ্রীয় জেলখানাকে (তেজপুর, শিলচর, ডিব্রুগড়, জোড়হাট, কোকরাঝার, গোয়ালপাড়া) ডিটেনশন ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক খবর, গোয়ালপাড়ায় ৩০০০ জনের বাসযোগ্য ক্যাম্প নাকি তৈরি হচ্ছে, যার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যে কয়েক কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। আপাতত যাঁরা এই ক্যাম্পগুলোতে আছেন, তাঁরা আবার মোটামুটি দু’টি ভাগে বিভক্ত: ‘ঘোষিত বিদেশি’ ও ‘সন্দেহভাজন ভোটার’। কিন্তু আদতে এঁরা প্রায় সবাই সমাজের প্রান্তবাসী, তথাকথিত অশিক্ষিত, অনেকেই বয়স্ক, যার মধ্যে মহিলারা সংখ্যায় বেশি, অনেকেই বিয়ের সূত্রে দীর্ঘ দিন অসমবাসী। কিন্তু তাঁদের অন্য ‘ডকুমেন্ট’ তো দূরস্থান, বিয়ের সার্টিফিকেটও নেই। অনেকের ‘ডকুমেন্ট’ অন্য রাজ্য থেকে ‘ভেরিফায়েড’ হয়ে ফিরে আসেনি। আবার, অসমে মেঘালয় থেকে আসা ‘ভেরিফায়েড ডকুমেন্ট’ যে ভাবে গ্রাহ্য হচ্ছে, ত্রিপুরা থেকে আসা তথ্য তত গ্রাহ্য হচ্ছে না, যুক্তি: সেগুলো ‘দুর্বল নথি’। কেন দুর্বল? কারণ, ত্রিপুরার বর্ডার নাকি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর মধ্যে সব চেয়ে শিথিল। সমাজের সাধারণ প্রান্তিকদের সঙ্গে ভবঘুরে, যৌনকর্মী, সরকারি অনাথ আশ্রমের ও বিভিন্ন ধর্মীয় আশ্রমগুলোর বাসিন্দা, মানসিক ভারসাম্যহীনেরা কী ভাবে নাগরিকত্বের প্রমাণ দেবেন? কল্যাণকামী রাষ্ট্রের উচিত দুর্বলদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। কী করে তা সম্ভব? কোথায় মিলবে এঁদের বংশবৃক্ষের হদিস?
গত কয়েক দশকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নিরাপত্তার কড়াকড়ি নিয়ে অনেক বার, অনেক কারণে জলঘোলা হয়েছে। কিন্তু এটা শুধু ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সমস্যা নয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী সংক্রান্ত হাই কমিশনার (ইউএনএইচসিআর)-এর তথ্য জানায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সব দেশই ‘নড়বড়ে সীমান্ত’ সমস্যায় ভুগছে। ভারতের অবস্থা আরও গোলমেলে, কারণ দেশভাগের ফলে বাস্তুচ্যুত উদ্বাস্তু ছাড়াও তিব্বত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, সোমালিয়া, সুদান, ভুটান, মায়ানমার প্রভৃতি রাষ্ট্র থেকে আসা অনেক উদ্বাস্তু-গোষ্ঠীকে ভারত আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু ভারত ১৯৫১-র রিফিউজ়ি কনভেনশন বা ‘১৯৬৪ প্রোটোকল’-এ সই করেনি, তাই উদ্বাস্তু সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণে এক দিকে যেমন ভারতের স্বাধীনতা আছে, অন্য দিকে কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ভারত উদ্বাস্তু খাতে সরাসরি অর্থসাহায্য পায় না। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে শরণার্থী-উদ্বাস্তু প্রত্যর্পণ চুক্তি তো নেইই, বরং বাংলাদেশ অনেক বারই সাফ জানিয়ে দিয়েছে, অসমে তাদের দেশ থেকে কোনও অনুপ্রবেশ ঘটেনি। বাংলাদেশ এমনিতেই জনসংখ্যার চাপে ব্যতিব্যস্ত। তার ওপর এই ছোট রাষ্ট্র দায়িত্ব নিয়েছে মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এক বিশাল সংখ্যক ‘রাষ্ট্রহীন’ রোহিঙ্গাদের। এই পরিস্থিতিতে, সত্যিই যদি অসম থেকে বিরাট সংখ্যক রাষ্ট্রহীনের ঢল বাংলাদেশে নামে, যদি তাদের ‘ডিপোর্ট’ করার চেষ্টা হয়, কী যে অবস্থা হবে দুই দেশের সম্পর্কে, তাদের অর্থনীতিতে, সমাজ-বিন্যাসে, তা অনুমেয়।
আসলে, কোনও রাষ্ট্রব্যবস্থা ও নাগরিক সমাজ চায় না যে, তাদের সম্পদে, জমিতে, আর্থিক বণ্টনে ‘বাইরের কেউ’ এসে ভাগ বসাক। এই ভেতর-বাইরের অঙ্ক, ভূমিসন্তান বনাম বহিরাগত হিসেব এখন পৃথিবী জোড়া সঙ্কট। কে কী ভাবে তার সমাধান করছে, তাতেই তার পরিচয়।
ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপিকা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy