জ্যোতিবাবুর ১০২তম জন্মদিন গেল। টেলিভিশনে গৌতম ঘোষের তথ্যচিত্রের কিছু অংশ দেখছিলাম আর অনেক কথা মনে পড়ছিল। রাজনীতিবিদ হিসেবে জ্যোতিবাবুকে সবাই চেনেন। আমরা তাঁকে দেখেছি প্রশাসক হিসেবে। আমার সুযোগ হয়েছিল চাকরির গোড়ার দিকে কিছু দিন তাঁর ডেপুটি সেক্রেটারি হয়ে কাজ করবার। তার পর যখন জেলায় চলে যাই, তখনও দেখা হত তাঁর জেলা সফরের সময়। তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও প্রশাসনিক স্টাইল আমাদের প্রভাবিত করেছিল। অনেক কিছু শিখেছিলাম তাঁর কাছে। অবসর নিয়েছি, তাই কৃতজ্ঞতা স্বীকারে বাধা নেই।
১৯৭৮ সালে চাকরিতে যোগ দিলাম: এসডিও, কাসির্য়াং। জ্যোতিবাবু আসছেন দার্জিলিং হিল কাউন্সিলের মিটিং করতে। চারি দিকে সাজ-সাজ রব। প্রথম বার তাঁকে ‘রিসিভ’ করব, চিন্তায় আছি। বস্্কে জিজ্ঞাসা করলাম, মুখ্যমন্ত্রীর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা কী রকম হবে। বস্ বললেন, ইংল্যান্ডের রাজা এলে যে রকম ব্যবস্থা হত, ঠিক সেই রকম! দেখলাম সত্যিই ইংল্যান্ডের রাজা। আমি যখনকার কথা বলছি, তখন জ্যোতিবাবুর ‘জনগণের সঙ্গে’ রাজনৈতিক কাজের অভিজ্ঞতা তিরিশ বছরেরও বেশি। মনে হয় সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছিলেন যে, নিজেকে নানা রকমের সংকীর্ণতা থেকে দূরে রাখতে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ সাহেবিয়ানা বজায় রাখা দরকার।
সবাই জানে তিনি ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন না, ছিলেন বাংলার রাজনৈতিক নেতা। বাঙালির নেতা হতে গেলে ‘বাঙালি’ না হলেও চলে। চামচে পরিবৃত হয়ে মুড়ি আর আলুর চপ না খেলেও চলে। বরঞ্চ আপনি আশেপাশের লোকজন থেকে কিছুটা দূরত্ব তৈরি করে নিতে পারেন, যা অন্যেরা অতিক্রম করতে পারবে না, কিন্তু আপনি নিজে পারবেন আপনার বুদ্ধির জোরে। প্রশাসনে এই কৌশল অপরিহার্য। মানসিক উদারতা এবং নিরপেক্ষতা হল সরকারি অফিসারদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ— এ কথা তাঁর কাছেই শেখা। প্রশাসককে দেখে মানুষ মনে করবেন যে তিনি দুই দলের কথাই বুঝতে পারছেন, কিন্তু নিজে দলাদলির ঊর্ধ্বে। এই বিশ্বাস জন্মালেই প্রশাসন চলবে, নয়তো রোজই লাঠিচার্জ করে পথ অবরোধ তুলতে হবে। জেলায় কাজ করতে গিয়ে বারে বারেই এ কথা স্মরণ করতে হয়েছে।
জ্যোতিবাবুকে দেখে, আর তাঁর কথা শুনে বোঝা যেত না যে তিনি প্রশাসনের সঙ্গে কতটা আন্তরিক ভাবে যুক্ত। ‘এ ভাবে তো চলতে পারে না’ অথবা ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না’ ইত্যাদি মন্তব্যে একটা নির্লিপ্ত ভাব প্রকাশ পেত। যে সমস্যার সমাধান নীচের স্তরেই হওয়া উচিত, সেগুলিও তাঁর কাছে পৌঁছত বলেই আপত্তি। প্রয়োজনে কিন্তু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সমস্যাও তাঁর নজর এড়াত না। অনেক সময় দেখেছি অফিসারদের ভুল ধরিয়ে দিতে। স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। এক বার, দিল্লিতে হোম মিনিস্টারের কাছে চিঠি যাবে। লম্বা চিঠি। খসড়া দেখালাম। এক জায়গায় একটু সংশোধন করে দিলেন। সংশোধিত চিঠি সই করাব, সে সুযোগ মিলল দিন দশেক পরে। সই করার আগে অন্য কিছু না দেখে, শুধু দেখে নিলেন সেই সংশোধনটা হয়েছে কি না।
প্রশাসক হিসেবে জ্যোতিবাবুর প্রধান সমস্যা ছিল তাঁর সহিষ্ণুতা, অনুকম্পা এবং অপ্রিয় কথা বলার অক্ষমতা। কার্সিয়াঙের সেই হিল কাউন্সিল মিটিঙে বিভিন্ন কাজের পর্যালোচনা হল। জ্যোতিবাবু বুঝলেন অনেক কাজই আটকে আছে লাল ফিতের ফাঁসে। ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘পারলে আপনাদের টু-থার্ড’কে তাড়িয়ে দিতাম।’ আমার চাকরি তখন এক বছরও হয়নি। ভাবলাম, তার পরের দিন থেকে দেখব সবাই মন দিয়ে কাজে লেগেছে। তা কিন্তু হল না। যেমন চলছিল, তেমনই চলল। মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ে থাকার সময় কখনও কখনও সামান্য কাজ দিতেন। কাজটা হয়ে গেছে বললে প্রথমে মনে হত তিনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না, তার পর দেখতাম খুশি হয়েছেন। বাঙালি যে কর্মবিমুখ, সে কথা পুরোপুরি মেনে নিয়েছিলেন। বুদ্ধবাবু সে তুলনায় অনেক বেশি অসহিষ্ণু, তাই আমলাদের দিয়ে কাজ করাতে অনেক বেশি সক্ষম হয়েছিলেন।
জ্যোতিবাবুর সম্বন্ধে একটা কথা প্রচলিত ছিল যে, উনি মধ্যপন্থায় বিশ্বাসী। কথাটা ঠিক। এই প্রান্তে বা ওই প্রান্তে না থেকে মাঝামাঝি একটা পথ বার করে নিতে পারতেন। এই ক্ষমতা কাজে লাগত বিভিন্ন সমস্যায় মধ্যস্থতা করে বিরোধ মিটিয়ে দিতে। আশির দশকে শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়নগুলির সঙ্গে মালিক পক্ষের শিল্পভিত্তিক বোঝাপড়া হত। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আলোচনা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যেত। অচলাবস্থা কাটাতে সমস্যাটা আনা হত মুখ্যমন্ত্রীর টেবিলে। জ্যোতিবাবু অসীম ধৈর্য ধরে মিটিং করতেন, দেখে মনে হত যে তিনি কাজটা উপভোগ করছেন। আমাদের জন্য এটা ছিল একটা বড় শিক্ষা। এক জন প্রশাসকের কাজের শতকরা নব্বই ভাগ হল নিরপেক্ষ মধ্যস্থতা। এ কাজে যাঁরা সফল, তাঁরাই দক্ষ প্রশাসক হতে পারেন। অন্তত আমাদের সময়ে তো তা-ই দেখেছি।
জ্যোতিবাবুর রসবোধ নিয়ে অনেক গল্প আছে। বিরাশি বা তিরাশি সাল। কলকাতায় টেস্ট খেলা হবে। সিপিএম খেলা বয়কট করল। অন্য দিকে কংগ্রেস দাবি তুলল, ছাত্রদের সস্তায় টিকিট দিতে হবে। প্রেস বুঝল সরকার চাপে আছে। বয়কটও হবে আবার শস্তায় টিকিটও হবে, তা কি সম্ভব? সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জ্যোতিবাবু বললেন, ‘শুনুন, একটা গল্প বলি। আমরা তখন দমদম জেলে। সপ্তাহে এক দিন মাছ হত। আমাদের প্রবীণ নেতা হালিম সাহেব কাউকে কোনও সুযোগ না দিয়ে মাছের টুকরোগুলো নিয়ে নিতেন। আমরা আপত্তি করলে বলতেন, তোদের বয়স আছে, তোরা অনেক মাছ খেতে পারবি। ছাত্রদের বলুন যে, তাদের বয়স আছে, তারা অনেক খেলা দেখতে পারবে।’
আমি রাজনীতির লোক নই, রাজনীতি বুঝিও কম। এটুকু বুঝতাম যে জ্যোতিবাবুর একটা সংস্কারবাদী ‘ইমেজ’ আছে, যে কারণে তাঁর সমালোচনাও হত অনেক। কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দকে শ্রেণিসম্পর্কের বিন্যাস বুঝে কাজ করতে হয়, উৎপাদনী শক্তিগুলি কতটা বিকাশিত হল, সেই খবরও রাখতে হয়। কিন্তু এই তথ্য যোজনা কমিশনের কোনও রিপোর্টে পাওয়া যায় না। পরিস্থিতি বুঝতে হয় নিজেদের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। ‘বিপ্লব নিয়ে বড় বড় কথা বলে, বিপ্লবের দিন তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না!’ বুঝেছিলেন যে, স্থান-কাল-পাত্র কোনওটিই বিশেষ সুবিধের নয়, বিপ্লবের অনুকূল নয়। ঠিক বুঝেছিলেন না ভুল, সেই কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই।
স্বরাষ্ট্রসচিব হয়ে দিল্লি থেকে ফিরে এলাম ২০০৯ সালে। ইন্দিরা ভবনে গেলাম জ্যোতিবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি তখন অসুস্থ, তাও কিছুক্ষণ বাইরে এসে বসলেন। বললেন, ‘এটা ভাল হয়েছে। আপনাকে হোম সেক্রেটারি করেছে। আপনি তো রাইটার্সে কাজ করেছেন, সবই জানেন।’ সেই সংক্ষিপ্ত, সাঙ্কেতিক, পরিচিত ভাষা! এই
সাক্ষাতের পরে জ্যোতিবাবু বছরখানেক বেঁচে ছিলেন, কিন্তু আমার আর তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি।
ভূতপূর্ব মুখ্য সচিব, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy