Advertisement
০৬ মে ২০২৪

ষাটের দশক, দুর্গাপুর শিল্পনগরীর ‘স্বর্ণযুগ’

বাড়তে থাকল কর্মীর সংখ্যা। মাথা তুলল অসংখ্য আবাসন। তৈরি হতে শুরু করল দুর্গাপুর টাউনশিপ। দেশের নানা প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ আসতে থাকেন এই শিল্পনগরীতে। সর্বভারতীয় মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয় শহর দুর্গাপুর। লিখছেন সুকুমার বর্ধন বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি এই শিল্পনগরী গড়ে উঠলেও ষাটের দশকেই প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল এই নগরীর।

১৯৬১ সালে দুর্গাপুরে এসেছিলেন রানি এলিজাবেথ। ফাইল ছবি

১৯৬১ সালে দুর্গাপুরে এসেছিলেন রানি এলিজাবেথ। ফাইল ছবি

শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৯ ০৬:১৬
Share: Save:

একের পর এক কারখানা বন্ধ। বেকারত্ব। ভাল থাকতে শহর ছাড়ছেন অনেকেই। নানা আর্থ-সামাজিক সমস্যা বেড়েছে। কিন্তু আগের শতাব্দীর ষাটের দশকে দাঁড়ালে দুর্গাপুরের মতো শিল্পনগরীর ছবিটা মোটেও এমন ছিল না।

বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি এই শিল্পনগরী গড়ে উঠলেও ষাটের দশকেই প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল এই নগরীর। ১৯৫৭ সালে দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টে উৎপাদন শুরু হওয়ার আগে এই কোম্পানিতে কর্মরতদের জন্য অল্প সংখ্যক কোয়ার্টার বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু ষাটের দশকে উৎপাদনের সঙ্গেই বাড়তে থাকল কর্মীর সংখ্যা। মাথা তুলল অসংখ্য আবাসন। তৈরি হতে শুরু করল দুর্গাপুর টাউনশিপ। দেশের নানা প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ আসতে থাকেন এই শিল্পনগরীতে। সর্বভারতীয় মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয় শহর দুর্গাপুর।

নগর গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বদল আসে পরিবহণ ব্যবস্থায়। শিল্পনগরীর তকমা দুর্গাপুর স্টেশনের গুরুত্ব বাড়িয়েছিল। তারই সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ল বাসের সংখ্যা। সেই সময়ে দুর্গাপুরের মূল বাসস্ট্যান্ড গড়ে ওঠে স্টেশন বাজার এলাকায়। ষাটের দশকে হামেশাই দেখা যেত ডিএসপির নীল রঙের বাসে চেপে নামমাত্র ভাড়ায় যাতায়াত করছেন শহরের সাধারণ মানুষেরাও। তখনও বেনাচিতি প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। তাই বাস রুট ছিল টাউনশিপের শেষ প্রান্তের সেন্ট্রাল স্টোর পর্যন্ত।

১৯৬০ সালে দুর্গাপুরে মিশরের প্রেসিডেন্ট নাসের। ফাইল ছবি

শিল্পের হাত ধরে বদলাতে শুরু করল শহরের জনবিন্যাসও। প্রথম যুগে ডিএসপিতে যুক্ত ছিলেন বেশ কয়েক জন বিদেশি বিশেষজ্ঞ। বিদেশিদের কেনাকাটা করার প্রধান জায়গা ছিল স্টিল মার্কেট। ষাটের দশকেই ওই এলাকাটি ‘অভিজাত এলাকা’-র তকমা পেয়েছিল। আর বাইরে থেকে আসা কর্মী ও অফিসারদের হাত ধরে শহরের নিজস্ব পরিচিতি গড়ে ওঠে। সেই সময় দুর্গাপুরের ‘এ জোন’ এবং ‘বি জোন’-এ গড়ে উঠতে থাকল জনবসতি। মধ্যবিত্ত এবং কারখানার কর্মীদের জন্য শহরে তৈরি হল পাঁচটি সেক্টর মার্কেট। বেনাচিতি শহরের মূল বাজার রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করল। ষাটের দশকেই হস্টেল অ্যাভিনিউয়ে গড়ে উঠেছিল ‘ট্রেনি’স হস্টেল। এই অংশটিকে ষাটের দশকের দুর্গাপুরের প্রাণকেন্দ্রও বলা যেতে পারে। সারি সারি বহুতল আবাসনে হাজার দুয়েক বাসিন্দা ছিলেন। নানাভাষী সেই আবাসিকরা অধিকাংশই ছিলেন ডিএসপি এবং এএসপিতে প্রশিক্ষণরত।

পরিবহণ বা জনবসতি গড়ে ওঠার সূত্রে জোয়ার এল প্রথাগত শিক্ষাবিস্তারেও। ‘এ জোন’ এবং ‘বি জোনে’ তৈরি হতে লাগল একের পর এক স্কুল। ‘এ জোন’ ও ‘বি জোনে’ যতগুলি সেক্টর ছিল তার প্রত্যেকটিতে গড়ে উঠল প্রাক্‌ প্রাথমিক এবং প্রাথমিক স্কুল। আর আটের দশকেই দু’টি জোনে তৈরি হল একটি করে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল। প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি, শহরের পড়ুয়াদের কারিগরি বিদ্যায় পারদর্শী করে তোলার জন্য ষাটে দশকের শেষ দিকে তৈরি হল আরসিএমইআরআই নামের একটি প্রতষ্ঠান। এখন যা এনআইটি নামে পরিচিত।

শহরের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বদলের ছোঁয়া লাগল সংস্কৃতিচর্চা এবং বিনোদনের দুনিয়ায়। শহরের শিল্পানুরাগী মানুষজনদের সংস্কৃতি চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ১৯৫৯ সালে তৈরি হয়েছিল ‘স্বগত সাহিত্য পরিষদ’। তাদের উদ্যোগে প্রকাশিত হতে থাকে ‘স্বগত’ নামের একটি পত্রিকা। অনেকেই এই সংস্থাটিকে দুর্গাপুরের প্রথম সাহিত্যচর্চাকেন্দ্র বলে অভিহিত করে থাকেন। অবশ্য এ নিয়ে দ্বিমতও রয়েছে। আবার ১৯৬৩ সালে বৈদ্যনাথ অধিকারীর হাত ধরে গড়ে ওঠে ‘শিল্পশ্রী’ নামের একটি শিশু সাহিত্য সংগঠন। এই দুই সংগঠনের হাত ধরে কলকাতার শিল্পীদের পা পড়তে লাগল দুর্গাপুরে। ষাটের দশকেই আরও কয়েকটি সংগঠন তৈরি হয়েছিল। নাটক, আবৃত্তি-সহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতে লাগল ‘এ জোন কমিউনিটি সেন্টার’ (অধুনা নেতাজি ভবন), এবং ‘বি জোন কমিউনিটি সেন্টার’-এ (বর্তমানের দেশবন্ধু ভবন)। অফিসারদের জন্য উভয় জোনে ছিল একটি করে ‘অফিসার্স ক্লাব’। সেই সময় দর্শকদের বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল সিনেমা। ‘এ জোন’ ও ‘বি জোনে’র কমিউনিটি হলে শনি ও রবিবার করে সিনেমা দেখানো হত। সিনেমা দেখতে শহরের নানা প্রান্ত থেকে ভিড় জমাতেন দর্শকেরা। হস্টেলবাসীদের হাত ধরে দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজো মতো নানা পার্বণ শুরু হয়। সেই উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এসেছিলেন কলকাতার নামজাদা শিল্পীরাও। বই পড়া বাড়াতে ‘এ জোন’-এ ‘অনুরূপা দেবী স্মৃতি পাঠাগার’ ও ‘বি জোন’-এ ‘রবীন্দ্র পরিষদ পাঠাগার’ তৈরি হয়েছিল। রবীন্দ্র পরিষদের উদ্যোগে শুরু হয় যাত্রা উৎসব। শহরের অন্য প্রান্তেও যাত্রা ও নাট্যোৎসব নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। ১৯৬৪ সাল নাগাদ এ জোনের লাল ময়দানে অনুষ্ঠান করতেএসেছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।

ষাটের দশকে দুর্গাপুরের খেলাধুলোর চর্চায়ও জোয়ার এসেছিল। প্রথম দিকে, এ শহরে খেলা বলতে লোকে ফুটবলকেই বুঝতেন। তখনও দুর্গাপুরে স্টেডিয়াম তৈরি হয়নি। কিন্তু শহরে ক্রীড়াপ্রেমীর অভাব ছিল না। ‘কে সেক্টর মাল্টিপারপাস স্কুল’-এর মাঠটি টিন দিয়ে ঘিরে প্রদর্শনী ম্যাচের আয়োজন করা হত। ১৯৬৫ সালে এই মাঠে পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়, চুনি গোস্বামীর মতো খেলোয়াড়েরা খেলে গিয়েছেন। এই দশকের শেষ দিকে ফুটবলের সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেট, ভলিবল, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টনের মতো খেলা জনপ্রিয়তা হতে শুরু করে। আন্তঃইস্পাত খেলার আয়োজন করা হলে দর্শকদের মধ্যে বিপুল উন্মাদনার সৃষ্টি হত।

সুযোগের অভাবে দুর্গাপুর ছেড়ে তরুণেরা চলে যাচ্ছেন। কমছে কারখানার সংখ্যা। নানা নাগরিক সঙ্কটে জর্জরিত এ শহর। তার পরেও ষাটের সেই ‘স্বর্ণযুগ’ এখনও এ শহরের প্রবীণদের মধ্যে স্মৃতিমেদুরতার জন্ম দেয়।

ডিএসপির প্রাক্তন কর্মী এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Durgapur Heritage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE