Advertisement
১১ মে ২০২৪

প্লাস্টিক বিরোধী অভিযানে প্রয়োজন সমবেত সদিচ্ছার

পুজোর মরসুমে কমিটিগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হবে যে, তারা যেন মণ্ডপসজ্জা এবং প্রতিমাসজ্জায় প্লাস্টিক, থার্মোকলের ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখেন। লিখছেন ইনাস উদ্দীন খুব বেশি দিন নয়, বছর কুড়ি আগেও চলতে-ফিরতে হাটে বাজারে কথায় কথায় এত প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ছিল না। পিকনিক, বিয়েবাড়ি বা খাবারের দোকানে এত থার্মোকলের থালা-বাটির ব্যবহার ছিল না।

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৯ ০২:০১
Share: Save:

‘শিরে হইলে সর্পাঘাত তাগা বাঁধি কোথা’— প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পথে নেমে উদ্যোক্তা সহ সকলেরই প্রায় এ রকম দিশেহারা অবস্থা। অতি সম্প্রতি আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় স্তরে সরকারি ভাবে পরিবেশকে প্লাস্টিক দূষণমুক্ত করার একটা উদ্যোগ শুরু হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার এমন ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছে যে তাকে সরানোর চেষ্টা যথেষ্টই বেদনাদায়ক।

খুব বেশি দিন নয়, বছর কুড়ি আগেও চলতে-ফিরতে হাটে বাজারে কথায় কথায় এত প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ছিল না। পিকনিক, বিয়েবাড়ি বা খাবারের দোকানে এত থার্মোকলের থালা-বাটির ব্যবহার ছিল না। এখন ক্যারিব্যাগ ছাড়া আনাজ বাজার, মাছের বাজার প্রায় অচল। অথচ, এই প্লাস্টিকের মারাত্মক ক্ষতির ব্যাপারগুলি বোঝার জন্য পরিবেশ কর্মী বা খুব জ্ঞানীগুণী হওয়ার দরকার পড়ে না। এক জন সাধারণ শিক্ষিত মানুষও জানে যে মাঠ-ঘাট, নালা-নর্দমা, প্লাস্টিক বোতল আর ক্যারিব্যাগে কী ধরনের দূষিত হয়ে চলেছে। মাছ-মাংস খাবারের মাধ্যমে ছোট ছোট প্লাস্টিক কণা কী ভাবে মানুষের শরীরে ঢুকে পড়ছে, হার্ট-কিডনি-ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটাচ্ছে। কিন্তু সেই একই কথা, সবাই তো ব্যবহার করছে। আমি একা মানুষ কী আর করতে পারি?

অনেক দিন থেকেই সচেতন মানুষ জন প্লাস্টিক দূষণের কমানোর কথা ভাবছেন, বলছেন। স্বেচ্ছাসেবী মানুষেরা নানা রকম প্রচার ও উদ্যোগ নিচ্ছেন। টিভি এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়ছে ভাসমান প্লাস্টিক কী ভাবে নদী সমুদ্রে দূষণ ঘটাচ্ছে। সামুদ্রিক প্রাণি তো বটেই, আমাদের আশেপাশের গবাদিপশুও ঘাসপাতার সঙ্গে প্লাস্টিক খেয়ে ফেলছে, অসুস্থ হচ্ছে, মারা যাচ্ছে। অন্য শহরের মতোই কৃষ্ণনগর শহরেও বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু মানুষ সচেতনতা প্রচার চালাচ্ছিলেন। গত বছর এ রকমই কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সমমনস্ক মানুষ জন মিলে ‘কৃষ্ণনগর পরিবেশ বন্ধু’ নামে একটি প্লাস্টিক বিরোধী আন্দোলনের মঞ্চ গড়ে তোলেন। গণ আবেদনের মাধ্যমে পৌরসভা-সহ বিভিন্ন প্রশাসনিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। ‘'ক্যারিব্যাগ দেব না, ক্যারিব্যাগ নেব না’— এই স্লোগান সামনে রেখে প্রতিটি বাজারে যৌথ ভাবে সচেতনতা অভিযান চালানো হয়। ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকে অনুরোধ জানানো হয় ক্যারিব্যাগ না নিতে, না দিতে। লিফলেট, ব্যানার, পোস্টার নিয়ে শহরে পদযাত্রা এবং দোকানে দোকানে প্রচার অভিযান চালানো হয়। অধিকাংশ মানুষ স্বাগত জানালেও কিছু মানুষ জন বিরক্তি প্রকাশ করেছেন, তর্ক করেছেন—‘সরকার যদি এতটাই আগ্রহী হয় তা হলে কারখানাগুলি বন্ধ হচ্ছে না কেন? ব্যবসায়ীদের বিক্রি কেন বন্ধ হচ্ছে না? সাপ্লাই বন্ধ হচ্ছে না কেন?’

বক্তব্যগুলি কোনওটাই ফেলে দেওয়ার মতো নয়। স্বেচ্ছাসেবীরা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, আমাদের নিজেদের স্বার্থে এই ব্যবহার কমাতে হবে। সরকার কখন উদ্যোগ নেবে তার অপেক্ষায় বসে না থেকে মানুষের সার্বিক স্বার্থেই আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে।

বাজারে অনেক দোকান, বিশেষ করে, মিষ্টির দোকান মুদিখানার দোকানদারেরা অনেকেই ক্যারিব্যাগ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। অনুরোধে সাড়া দিয়ে পৌরসভার পক্ষেও অনেকগুলি কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো মুখ্যত বড় উৎসব। পুজো কমিটির মানুষজনকে নিয়ে মিটিং করে পৌরসভার পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল, যাতে প্লাস্টিক ও থার্মোকলের ব্যবহার যথাসম্ভব কমানো হয়। ক্যারিব্যাগের ব্যবহারের জন্য জরিমানা ঘোষণা করে নোটিস দেওয়া হয়েছিল প্রতিটি বাজারে। বিক্রেতা ক্যারিব্যাগ দিলে তাঁকে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে। বাজারে কারও হাতে ক্যারিব্যাগ দেখলে তাঁকে ১০০ টাকা জরিমানা করা হবে। দুঃখের বিষয়, ঘোষণা করা হলেও এই জরিমানা কার্যকর করার প্রশাসনিক তেমন কোনও উদ্যোগ করা হয়নি। ফলে, আন্দোলন কিছুটা ঝিমিয়ে আসে। আবার বাজারে ক্যারিব্যাগের ব্যবহার বাড়তে থাকে।

সম্প্রতি পৌরসভার পক্ষ থেকে নতুন করে উদ্যোগ করা হয়েছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর এই উদ্দেশ্যে একটি নাগরিক কনভেনশনের আয়োজন করা হয়। সেখানে বেশ কিছু কর্মসূচি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। প্রথমেই ক্রেতা, বিক্রেতা ও জনসাধারণের জন্য সতর্কতা হিসাবে একটা সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দুর্গাপুজোর মরসুম পার করে গত ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। প্রতিটি অনুষ্ঠান বাড়ি, ক্যাটারার ও খাবারের দোকানদার সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে থার্মোকলের থালা-বাটি কিংবা প্লাস্টিকের গ্লাস ব্যবহার যেন করা না হয়। এ ছাড়া আগামী জগদ্ধাত্রী পুজোর মরসুমে কমিটিগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হবে যে, তারা যেন মণ্ডপসজ্জা এবং প্রতিমাসজ্জায় যথাসম্ভব প্লাস্টিক এবং থার্মোকলের ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখেন। শুধু তাই নয়, মণ্ডপের বাইরের খাবারের দোকানগুলিতেও যেন প্লাস্টিক এবং থার্মোকলের ব্যবহার না হয়, সেই নির্দেশিকা জারি করা হবে। পুরকর্মী শহরের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য এবং পরিবেশ বন্ধু স্বেচ্ছাসেবীদের মিলিত টিম তৈরি করা হবে, যারা বাজারে বাজারে নিয়মিত নজরদারি চালাবে। একটি হোয়াটসঅ্যাপের নম্বর নির্দিষ্ট করা হবে, যেখানে নজরদারি কর্মীরা কিংবা সাধারণ মানুষ ক্যারিব্যাগ, থার্মোকলের ব্যবহার দেখলেই যাতে সেখানে অভিযোগ জানাতে পারেন।

প্রশ্ন ওঠে যে, পঞ্চাশ মাইক্রনের নীচে হলেই সেই ক্যারিব্যাগ ক্ষতিকর, আর তার উপরে হলে সেগুলি কি ক্ষতিকর নয়? ক্যারিব্যাগ ছাড়াও বিভিন্ন প্যাকেট, ফয়েল, জলের বোতল ইত্যাদিতে যে ঢালাও প্লাস্টিকের ব্যবহার হচ্ছে, এর জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? এ ছাড়া ঘরের জিনিসপত্র আসবাবপত্র সব কিছুতেই তো প্লাস্টিকের ব্যবহার চলছে! সেগুলোর কী হবে? ক্যারিব্যাগের বিকল্প কি মাথায় কিছু আছে? বাজারে মানুষ মাছ-মাংস কিনবেন কী ভাবে? এ সব প্রশ্নের নানা রকম উত্তর দেওয়াই যায়, নানা রকম বিকল্প ভাবনা ভাবছেন অনেকেই।

সাধারণ ভাবে বলা যেতে পারে যে, পাতলা ক্যারিব্যাগগুলি এক বার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়, সেই জন্য এইগুলি জঞ্জালের পাহাড় তৈরি করে। অপর দিকে, মোটা প্লাস্টিকের ব্যাগগুলি একাধিক বার ব্যবহার করা যেতে পারে। ওই রকম মোটা প্যাকেটগুলি যদি মাছ মাংস কিনতে ব্যবহার করা হয়, তা হলে একটা প্যাকেট হয়তো ছ’মাস কী তিন মাস চলে যাবে। তা হলেও তো প্রচুর ক্যারিব্যাগের জঞ্জাল থেকে আমরা পরিবেশকে কিছুটা হলেও রক্ষা করতে পারব।

নির্ধারিত ১৭ তারিখের পর দিনই পুর কর্তৃপক্ষ এবং পরিবেশ বন্ধুর কর্মীরা সম্মিলিত ভাবে শহরের একটি বাজারে প্রতীকী অভিযান করেছেন। প্লাস্টিকের গ্লাস, কাপ ও থার্মোকলের কিছু থালাবাটি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে একটা বার্তা অবশ্যই শহরে নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া গিয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, এই বার্তা এই উদ্যোগ শহরে একটা ভাল রকমের সাড়া ফেলবে। সদিচ্ছা নিয়ে সমবেত ভাবে উদ্যোগী হলে শিরে সর্পাঘাত হলেও যে তার চিকিৎসা সম্ভব— এটা আগামী দিনে নিশ্চয়ই প্রমাণিত হবে।

সম্পাদক, কৃষ্ণনগর পরিবেশ বন্ধু

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Environment Pollution Plastic
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE