ঢাকার ছাত্র আন্দোলন।ফাইল চিত্র।
ঢাকার এ বারের ছাত্র আন্দোলনটি বিভিন্ন অর্থেই বিশিষ্ট। পরিবহণের মতো দৈনন্দিন বিষয়কে সামনে রাখিয়া প্রশাসনের সামনে এত বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়িয়া দেওয়া সহজ কথা নয়। বিশিষ্টতা আন্দোলনকারীদের বয়সেও। নিতান্ত কিশোরবয়সি বিদ্যালয়-পড়ুয়াদের নেতৃত্বে আয়োজিত হইল এই মহা কর্মকাণ্ড। তাহারা কেবল পথ অবরোধ করিল না, যানবাহন কী ভাবে রাজপথ দিয়া যাওয়া সঙ্গত ও বাঞ্ছিত, তাহাও হাতে-কলমে করিয়া দেখাইল। আন্দোলন এই ভাবেই প্রতিবাদের সীমা পার হইয়া সাংগঠনিক দৃষ্টান্ত হইতে পারে— বুঝাইয়া দিল অল্পবয়সি ছেলেমেয়েগুলি। অসংখ্য ছেলেমেয়ের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাস্তায় নামিয়া আসা দেখিয়া বোঝাই যায়, কোনও একটি মাত্র ঘটনা ইহার কারণ হইতে পারে না। রেষারেষির দৌড়ে ব্যস্ত বাসের তলায় দুই পড়ুয়ার মৃত্যু হইবার পরই এই আন্দোলনের শুরু ঠিকই, কিন্তু ওই দুর্ঘটনাটি আগুনের ফুলকি-মাত্র, আগুনের গনগনে আঁচ ভিতরে জমিতেছিল আরও আগে হইতেই। ঢাকার পরিবহণ লইয়া অনেক রঙ্গরসিকতা শোনা যায়। তবে অব্যবস্থা যে কেবল রসিকতার প্রস্রবণই উৎসারিত করে না, তলে তলে নিদারুণ অগ্নিশিখাও উদ্গিরণ করে, বাংলাদেশের শাসকরা নিশ্চয় আগে ধরিতে পারেন নাই।
তবে কিনা, একটি কথা আবারও প্রমাণিত হইল। আন্দোলন বস্তুটির শুরু আর শেষের মধ্যে বিস্তর দূরত্ব, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই দূরত্ব অনভিপ্রেত। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যাহারা আন্দোলন শুরু করে, ক্রমশ তাহারা রাজনৈতিক ভাবে চালিত ও বিপথচালিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অন্য বিন্দুতে গিয়া শেষ করে। ঢাকাতেও আন্দোলন শুরু হইবার দিন-সাতেকের মধ্যেই দেখা গেল, সরকারি অবহেলা ও দুর্নীতিপরায়ণতার বিরুদ্ধে এত অসামান্য একটি প্রতিবাদ আস্তে আস্তে রাজনীতির সর্পিল ফাঁদে শ্বাসরুদ্ধ হইতেছে। কয়েক বৎসর আগে ঢাকার শাহবাগ আন্দোলনেও এমনটাই ঘটিয়াছিল, পশ্চিমবঙ্গে নন্দীগ্রামবিরোধী আন্দোলনও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। সৎ ও নিরপেক্ষ নাগরিক প্রতিবাদ ধীরে ধীরে রাজনীতির বিষকুম্ভে তলাইয়া যায়। ঢাকায় এখন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যুক্ত হইয়া সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থ পূরণ করিতেছে। আর সরকারি দল নিজেদের ছাত্র-শাখাকে উস্কাইয়া আন্দোলনকারীদের অনৈতিক অশালীন ভাবে প্রতিহত করিতেছে। নির্বাচন বেশি দূরে নাই, সুতরাং ছাত্র-আন্দোলনকে সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষই আত্মসাৎ করিতে ব্যস্ত।
বিশ্ব-ইতিহাসে বিক্ষোভ-বিপ্লব— ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সের দুনিয়া কাঁপানো বিপ্লবটি সমেত— বারংবার প্রগতি হইতে প্রতিক্রিয়ায় গিয়া শেষ হইয়াছে। তাহা আন্দোলনের নেতৃত্বের ক্ষীণতা প্রমাণ করিলেও আন্দোলনকারীদের শক্তির ন্যূনতা বোঝায় নাই। ঢাকার এ বারের বিদ্রোহটিও সেই জাতের। এক দিকে তাহা বুঝাইয়া দেয়, মৌলবাদ ও ধর্মবাদের বাহিরে নাগরিক অধিকারকেন্দ্রিক আন্দোলনের গুরুত্ব। বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষেরা তাহা না ভাবিতে পারিলেও ছোটরা কিন্তু করিয়া দেখাইতে পারে। অন্য দিকে, এই আন্দোলনের ক্রম-পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক চেহারা দেখাইয়া দেয় নাগরিক আন্দোলনের মুখ্য বিপদটি কোন দিক হইতে আসিতে পারে। বর্তমানের অতি-রাজনীতি-আক্রান্ত সময়ে যে কোনও পরিস্থিতিতেই নাগরিক সমাজকে গ্রাস করিয়া লইবার ক্ষমতা ধরে রাজনৈতিক সমাজ। তবে সরকারের ভূমিকাটি এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যদি নাগরিক আন্দোলনকে বিষাক্ত করিয়া তুলিতে চায়, কাহারও সাধ্য নাই রোধ করিবার। আওয়ামি লিগ সরকার বহু ছাত্র-আন্দোলনের জনক এবং দর্শক। সেই দলের সরকারও যদি এ ভাবে ছাত্রছাত্রীদের উপর দমন-পীড়ন-নির্যাতন চালাইয়া নাগরিক কণ্ঠ বন্ধ করিতে চায়, তাহা ঐতিহাসিক অন্যায় ছাড়া আর কী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy