এ বার প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সদুদ্দেশ্যেই নতুন স্বাস্থ্য বিধি প্রণয়ন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, মেনে নিয়েও বলতে হচ্ছে ফলটা কিন্তু সর্বৈব ইতিবাচক নয় এখনও পর্যন্ত। বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রে চিকিৎসক মহল সন্ত্রস্ত বেশ। রোগী ফেরাচ্ছে বহু বেসরকারি হাসপাতাল, ছুরি-কাঁচি ধরার আগে দশ বার ভাবছেন চিকিৎসক, কী কী শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দেওয়া হবে রোগীকে, প্রেসক্রিপশনে সেটুকু লিখতেও দ্বিধা হচ্ছে ডাক্তারের। ভয় কেন, ত্রাস কীসের, দ্বিধার কী আছে— এ সব প্রশ্নকে ঘিরে তর্ক-বিতর্ক চলতেই পারে। কিন্তু বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার স্বাস্থ্য ফেরাতে যে দাওয়াই দেওয়া হল, তার প্রাথমিক ধাক্কাটা যে জনসাধারণের পক্ষেও সুখকর হচ্ছে না, সে কথা সরকারকেও বুঝতে হবে।
রাজ্যের ৭০ শতাংশ, মতান্তরে ৮৫ শতাংশ বাসিন্দা সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর নির্ভরশীল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর হাল কিছুটা যে বদলেছে, সে কথা স্বীকার করে নিয়েও বলতে হয়, সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবায় অপ্রতুলতা কিন্তু এখনও বিস্তর। জনসংখ্যার যতটা অংশ সরকারি হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল, হাসপাতালের সংখ্যা তার নিরিখে নগণ্য তো বটেই। সরকারি হাসপাতালে সব ধরনের চিকিৎসা চাইলেই মেলে, তেমনটা বলার সময়ও এখনও আসেনি। খাস মহানগরের সরকারি হাসপাতালের পরিষেবা বা ব্যবস্থাপনা নিয়েই মাঝেমধ্যে প্রশ্ন উঠে যায়। তা হলে রাজধানী থেকে দূরবর্তী এলাকায়, মফস্বলে, গ্রামাঞ্চলে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল ঠিক কেমন, তা কল্পনা করতে খুব সমস্যা হয় না। বস্তুত, সরকারি চিকিৎসা পরিকাঠামোয় অপ্রতুলতা এবং অপারগতা রয়েছে বলেই বহু মানুষ বেসরকারি পরিষেবার মুখাপেক্ষী। অতএব, বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রকে ধান আর চালের হিসেবটা বুঝিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে যে পদক্ষেপ করা হল, তা আরও সাবধানী ছন্দে হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সব কিছু বেশ ঝড়ের মতোই এল এবং গেল। স্থানে স্থানে এখন তাই বিপর্যয়ের চিহ্ন।
রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম দশা অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালেরই। তার মধ্যেই বেসরকারি হাসপাতাল এ বার জটিলতা দেখলেই রোগী ফিরিয়ে দিতে শুরু করেছে। প্রবণতাটা যদি বাড়তে থাকে ক্রমশ, তা হলে সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উপর চাপ আরও বাড়তে বাধ্য। সেই বাড়তি চাপ সামলাতে কি আদৌ প্রস্তুত এ রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর?
বেসরকারি হাসপাতালে অনিয়ম এবং জুলুমের অভিযোগ দিন দিন যে ভাবে বাড়ছিল, তাতে কঠোর পদক্ষেপটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তার আগে নিজের ঘরটা গুছিয়ে নেওয়াও রাজ্য সরকারের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি ছিল।
অনেকে প্রশ্ন করছেন, স্বাস্থ্য পরিষেবা বা চিকিৎসা পরিকাঠামোর দায় সরকার নেবে কেন? ভর্তুকি-নির্ভর সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো আরও বাড়ানো হবে কেন? প্রশ্নগুলো অযৌক্তিক নয়। কিন্তু ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সরকারি খরচে স্বাস্থ্য পরিষেবার পর্যাপ্ত উপস্থিতি যে একটি অপরিহার্য বিকল্প, সে কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই। সেই পরিকাঠামোকে যদি স্বয়ংসম্পূর্ণতায় বা তার কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া যেত, বেসরকারি হাসপাতালগুলি জুলুম বা অনিয়মের অবকাশই পেত না সম্ভবত।
সরকারি হাসপাতালকে নতুন কঠোর স্বাস্থ্য বিধির বাইরে রাখার সিদ্ধান্তও কিন্তু জন্ম দিয়েছে বেশ কিছু অযাচিত প্রশ্নের। স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তথা পরিষেবার সার্বিক উত্তরণই যদি লক্ষ্য হয়, তা হলে সরকার-বেসরকারে ভেদ কেন? লক্ষ্যটা যথেষ্ট উদার তো?
বাংলা বিশ্বাস রাখতে চায় তার সরকারের উপর। জনদরদী সিদ্ধান্তকে বাংলা অকুণ্ঠ এবং উদ্বাহু সমর্থনও জানাতে চায়। কিন্তু অপ্রীতিকর প্রশ্ন তোলার অবকাশটাও সরকারই তৈরি করে দিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy