Advertisement
E-Paper

নারীর ক্ষমতায়ন লক্ষ্য হলে এ ত্রুটির সংশোধন জরুরি

এক দিকে কন্যাশ্রী— প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে মেয়েদের বিয়ে যাতে না দেয় পরিবার, তা নিশ্চিত করার জন্য আর্থিক প্রোৎসাহনের বন্দোবস্ত। আর এক দিকে রূপশ্রী— মেয়ের বয়স ১৮ হওয়া মাত্রই বিয়ের বন্দোবস্ত করার জন্য অনেকগুলো পরিবারকে উৎসাহিত করার ব্যবস্থা।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:৩৬
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

প্রতিরোধটা ক্রমশই তীব্র হচ্ছে। সঙ্কট শিকড় থেকে নির্মূল হয়ে গিয়েছে, এমন নয়। কিন্তু শিকড়ে টান মারা গিয়েছে জোরদার। তাই পূর্ব মেদিনীপুরের ঘাটালের সরস্বতী মালিক তার অবিবেচক অভিভাবকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস খুঁজে পাচ্ছে। সাহস খুঁজে পাচ্ছে হাওড়ার বালির শ্রীপ্রিয়া ঘোষ, মালদহের মানিকচকের নুর বানু। ইতিবাচক প্রবণতারই ইঙ্গিতবহ এই সব প্রতিরোধ সংশয় নেই। কিন্তু কত দিন টিকবে এই প্রবণতা? আদৌ কি কোনও প্রথা বা পরম্পরায় রূপান্তরিত হবে এ? নাকি শাসকের এক অবিবেচক পদক্ষেপ অঙ্কুরেই নষ্ট করবে এক উজ্জ্বল সামাজিক সম্ভাবনাকে?

কিশোরী সরস্বতী আরও পড়তে চায়। কিন্তু পরিবার চায় বিয়ে দিতে। শত আপত্তি অশ্রুত রেখে বিয়ের বন্দোবস্ত যখন প্রায় পাকা, তখন পুলিশের দ্বারস্থ হল অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ রুখে দিল বিয়ে।

এই প্রশাসনিক তৎপরতা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। সরস্বতীর মতো আরও অনেক নাবালিকাকে সাহস জোগানো গিয়েছে যে প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায়, সেই প্রক্রিয়া প্রশংসনীয়। আর প্রশংসনীয় সেই ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প, যা সরস্বতী-শ্রীপ্রিয়া-নুর বানুদের বুঝতে শিখিয়েছে যে, তাদের জীবন কোন পথে গড়াবে, সে বিষয়ে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার গুরুত্বই সর্বাধিক।

অতঃপর কী হল? উজ্জ্বল দীপশিখায় সরকার নিজেই যেন জল ঢালল! ‘রূপশ্রী’ নামে আর এক প্রকল্প এল, মেয়ের বয়স ১৮ হলেই বিয়ে দেওয়ার জন্য ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হল। যে সব পরিবারের বার্ষিক আয় দেড় লক্ষ টাকার কম, সেই প্রত্যেক পরিবার এই প্রকল্পের আওতায় আসবে বলে জানানো হল। শাসকের চিন্তা-ভাবনায় নিদারুণ বৈপরীত্যের আভাসই কি দিল না এই নতুন প্রকল্প?

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

এক দিকে কন্যাশ্রী— প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে মেয়েদের বিয়ে যাতে না দেয় পরিবার, তা নিশ্চিত করার জন্য আর্থিক প্রোৎসাহনের বন্দোবস্ত।

আর এক দিকে রূপশ্রী— মেয়ের বয়স ১৮ হওয়া মাত্রই বিয়ের বন্দোবস্ত করার জন্য অনেকগুলো পরিবারকে উৎসাহিত করার ব্যবস্থা।

কন্যাশ্রী-তে কী ভাবে উপকৃত হচ্ছে সমাজ? প্রথমত, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা কমছে। দ্বিতীয়ত, অন্তত ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েরা পড়াশোনা করবে, এমনটা অনেক ক্ষেত্রেই সুনিশ্চিত করা যাচ্ছে। তৃতীয়ত, মেয়েদের মধ্যে সামগ্রিক ভাবে উচ্চশিক্ষার প্রবণতা বাড়ছে।

আর রূপশ্রী কী ভাবে ক্ষতি করতে পারে? প্রথমত, ১৮ বছর বয়স হওয়া মাত্রই মেয়ের বিয়ে দিতে তৎপর হয়ে উঠবে অনেক পরিবার। কারণ বছরে দেড় লক্ষ টাকাও রোজগার নেই যে পরিবারের, এককালীন ২৫ হাজার টাকা পাওয়ার হাতছানিকে অপেক্ষা করতে বলার ক্ষমতা সে পরিবারের কমই। দ্বিতীয়ত, উচ্চশিক্ষার দিকে যাওয়ার প্রবণতা মেয়েদের মধ্যে সামগ্রিক ভাবে বাড়ছিল যে কন্যাশ্রীর কারণে, সেই প্রবণতায় এই রূপশ্রী ধাক্কা দিয়ে দেবে। কারণ কন্যাশ্রী ও রূপশ্রী বাবদ যে মোট ৫০ হাজার টাকা পাওয়া যাবে, সে কথা মাথায় রেখে অনেক প্রান্তিক পরিবারই চাইবে, মেয়ের বিয়ে নামক ‘গুরু দায়িত্ব’টি যত দ্রুত সম্ভব সম্পাদন করে ফেলতে। আর এ দেশে তথা এ সমাজে বিয়ের পরে শিক্ষা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ মেয়েদের জন্য কতটা মসৃণ হয়, সে ধারণা আমাদের অনেকেরই রয়েছে।

আরও পড়ুন: পড়তে চাই, পাকা দেখার দিনই থানায় সরস্বতী

বৈপরীত্য বড় মারাত্মক চেহারা নিল না কি? যে প্রকল্প সমাজকে সত্যিই এক নতুন দিশা দেখাতে শুরু করেছে, যে প্রকল্প নারীর ক্ষমতায়নের কর্মসূচিকে নতুন গতি দিয়ে দিয়েছে, যে প্রকল্প এ রাজ্যের এবং এ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়ে প্রশংসিত হয়েছে, সেই প্রকল্পের আরও সাফল্যের পথে সরকার নিজেই কাঁটা বিছিয়ে দিল না কি?

পদক্ষেপে ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে বাঞ্ছনীয়ও নয়। আরও বেশি করে বাঞ্ছনীয় নয় ভুল সংশোধনে অনীহা। রূপশ্রী প্রকল্পটিও মেয়েদের উন্নতির কথা মাথায় রেখেই আনা হয়েছে সংশয় নেই। সে ক্ষেত্রে এই প্রকল্পের ত্রুটি চিহ্নিত হলে, তা সংশোধন করে নেওয়ার ইচ্ছা আরও প্রবল হওয়া উচিত। সরকার কি হাঁটবে সে পথে? যদি হাঁটে, তা হলে নারীর উন্নয়ন বা নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্নের কোনও অবকাশ থাকবে না। কিন্তু মারাত্মক ত্রুটিটা চিহ্নিত হওয়ার পরেও যদি সরকারের নীতি নির্ধারকরা অনড় থাকেন অবস্থানে, তা হলে এই নতুন সরকারি কর্মসূচিটি নিছক ভোট কেনার কৌশল হিসেবে প্রতিভাত হতে পারে। কন্যাশ্রীর অসামান্য সাফল্যের পর তেমন কোনও কলঙ্কের মুখোমুখি হওয়া বোধ হয় খুব একটা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে না।

Minor Marriage Government Scheme Rupashree Scheme Kanyashree Newsletter অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় Anjan Bandyopadhyay কন্যাশ্রী’ প্রকল্প রূপশ্রী প্রকল্প Women empowerment
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy