চাষিদের আন্দোলনের চাপে কৃষিঋণ মকুব করেছে নানা রাজ্যের সরকার। তাতে চাষির কতটা লাভ হবে, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। কিন্তু আর একটি তথ্য চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। তা হল, কৃষকদের ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। ২০১০–১১ সালে ৪৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার লক্ষ্য ছিল কেন্দ্রের। কিন্তু ২০১১-১৩, এই দুই বছরে মাত্র ১৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া গিয়েছে। তবে কি ঋণের চাহিদা নেই? না কি, আধিকারিকদের গাফিলতিতে চাষিরা তা পাচ্ছেন না?
আসল সমস্যা অন্যত্র। চাষির ঋণের চাহিদা ও সরকারি ঋণের জোগানের ভিতরের ফাঁকে জায়গা করে নিয়েছেন মহাজনেরা। তাঁদের উপর চাষির নির্ভরতা কেবল নগদ টাকার নয়। জল, সার, বীজ থেকে শুরু করে বাজারে ফসলের বিপণন— কৃষির সব দিকে মহাজনদের জাল ছড়ানো আছে। এই ‘নেটওয়ার্ক’-এর উপর প্রতি পদে নির্ভর করতে হয় ছোট চাষিকে। এর কেন্দ্রে সাধারণত থাকেন দু’চার জন প্রভাবশালী ব্যক্তি, যাঁরা বন্ধুত্ব বা আত্মীয়তার সম্পর্কে সংযুক্ত। এঁরা প্রধানত এলাকার সম্পন্ন চাষি, অনেকেই ভূমিসংস্কারের সময়ে জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এঁদের সঙ্গে হাত মেলান এলাকার রাজনৈতিক নেতা, এবং হিমঘর ও চালকলে লগ্নিকারী ব্যক্তিরা।
এঁদের ঠিক নীচের স্তরে থাকেন এক শ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী। এঁরা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের সঙ্গে নেতা-মহাজনদের সংযোগ হিসেবে কাজ করেন। মূল ‘নেটওয়ার্ক’-এর হয়ে এঁরাই ধার দেন, হিসেব রাখেন, ফসল হিমঘরে বা বাজারে পৌঁছে দেন। আলু উঠলে এঁরাই আলু নিয়ে তার পরিবর্তে বন্ড দেন, বন্ড ধারে খাটান, নতুন বন্ড কেনেন, শেষ পর্যন্ত সমগ্র ফসলের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্কের কাছে পৌঁছে দেন। বিনিময়ে এঁরা যা উপার্জন করেন তা ছোট চাষির থেকে বেশ কয়েকগুণ বেশি।
প্রশ্ন হল, এই মাঝের শ্রেণির উপর ছোট চাষির নির্ভরশীলতা কমছে না কেন? ২০১১–১২’র তুলনায় ২০১৬–১৭’য় রাজ্যে কৃষির বরাদ্দ প্রায় ছ’গুণ বেড়েছে। ফসলের বিপণন, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণেও সরকার জোর দিয়েছে। তাও এই মাঝের গোষ্ঠীর ক্ষয় দেখা যাচ্ছে না কেন?
গবেষকরা দেখিয়েছেন, ছোট চাষিদের উন্নয়নের জন্য সরকারের ব্যয়ের অধিকাংশটাই দখল করে নেয় এই ‘নেটওয়ার্ক।’ উৎপাদন ও বিপণন, দুটি ক্ষেত্রেই সরকারি ভরতুকি, ব্যাংকের স্বল্প সুদের ঋণ, সবই চলে যায় নেটওয়ার্কের কবলে। এরা তৈরি করে ‘প্রাইভেট’ মার্কেট, যার উপর নির্ভর করতে ছোট চাষি বাধ্য হয়। এর একটা নিদর্শন সেচ ব্যবস্থা। বাম আমলে ডিপ টিউবওয়েল তৈরির জন্য ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হয়, কিছুটা ভরতুকিও দিয়েছিল রাজ্য সরকার। সে সুযোগ কাজে লাগিয়েছিলেন তুলনায় ধনী চাষিরা। ব্যাংকে বাঁধা রাখার মতো সম্পত্তি ছোট চাষির ছিল না। আশি-নব্বইয়ের দশকে রাজ্যে দ্রুত ডিপ টিউবওয়েলের বিস্তার হয়। তৈরি হয় জলের বাজার। ছোট চাষি জল কিনতে থাকেন ডিপ টিউবওয়েল মালিকদের থেকে, সে টাকায় বড় চাষিরা শোধ করেন ব্যাংকের ঋণ। নগদে জলের দাম দেওয়ার ক্ষমতা নেই বলে ছোট চাষি বাঁধা পড়ে যায় নেটওয়ার্কের কাছে। ছবিটা বদলায়নি। ২০১৩–১৪ সালে গভীর নলকূপের জন্য সরকার অর্থ বরাদ্দ করেছিল। সেই সব নলকূপের জলও কিনতে হচ্ছে ছোট চাষিকে।
কেবল ভূগর্ভস্থ জলের উপরেই নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে নেটওয়ার্ক, তা নয়। বর্ধমানের ঝিল ও নদী-সংলগ্ন এলাকায়, বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুর জলাধার-সংলগ্ন এলাকায় সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সেচের পাম্প ক্ষুদ্র চাষিরা ধারে ব্যবহার করেন। অর্থাৎ জলের উৎস নদী বা বড় জলাশয় হলেও তা ব্যবহার করার প্রযুক্তির মালিকানা ব্যক্তিগত। জাতীয় জল নীতি (১৯৮৭) জল ব্যবহারকারীদের সংগঠন তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলোতে অন্তত দশ হাজার এমন সংগঠন আছে। সেগুলো হয় অকেজো, নয় রাজনৈতিক দলের দখলে।
পশ্চিমবঙ্গে সে অর্থে জলের অভাব নেই, কিন্তু জলের উৎসের ও ব্যবহারে নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ চোখে পড়ার মতো। গত দশকে একটি সমীক্ষার কাজ করতে গিয়ে চোখে পড়ে, বীরভূমে ময়ূরাক্ষীর ক্যানালের জল চাষের মরশুমে ইচ্ছে করে কিছু দিন আটকে রাখা হয়, যাতে বেসরকারি বাজার কাজ করতে পারে। আইআইএম কলকাতার ওই সমীক্ষাতে সার্বিক ভাবেও দেখা গিয়েছে যে, রাজ্যের বেশির ভাগ জলসেচ প্রকল্প থেকে চাহিদার তুলনায় কম জল দেওয়া হয়, যা চাষিদের আরও নির্ভরশীল করে তোলে জলের বাজারের উপর।
বীজ, সার, কীটনাশক প্রভৃতির উপর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেও চাষির ফসলের ওপরে অপ্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ তৈরি হয় ওই নেটওয়ার্কের। ফলে ছোট চাষি এক রকম বাধ্য থাকেন নেটওয়ার্ক-এর মাধ্যমে ফসল বিক্রি করতে। মধ্যস্বত্বভোগীদের বাদ দিয়ে চেকের মাধ্যমে ফসলের সহায়ক মূল্য চাষির কাছে পৌঁছে দেওয়ার সরকারি প্রচেষ্টা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। বাজার মন্দ থাকলে ছোট চাষির সহায়ক মূল্য মেলে না, বাজার চড়া থাকলে বাড়তি দাম মেলে না, কারণ তার ফসল আগেই ‘বাঁধা’ রয়েছে মহাজনের ঘরে।
প্রান্তিক চাষিরা নেটওয়ার্ক-এর উপর নির্ভরতা থেকে বের হতে পারছেন না অন্তত তিনটি কারণে। প্রথমত, মহাজন-বড় চাষির প্রভাব কৃষিতে সীমিত নয়। গ্রামের কোন পরিবার কী ধরনের সরকারি সহায়তা পাবে, তা-ও এঁরাই নির্ধারণ করেন। তাই এঁদের অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, হঠাৎ টাকার দরকার হলে মহাজনের দ্বারস্থ হতেই হয় চাষিকে। তৃতীয়ত, ফসলের বিনিময়ে, শ্রমের বিনিময়ে মহাজনের ঋণ শোধ করা যায়। ব্যাংকের সুদ কম, কিন্তু কেবল নগদে কারবার।
মহাজন-ব়ড় চাষি-নেতার নেটওয়ার্ক সহজে ভেঙে যাবে, দলে দলে প্রান্তিক চাষি সরকারি ঋণ নেওয়া শুরু করবেন, এমন আশা নেই। তবু মুক্তির পথ খোঁজা চাই। নিশ্চিত করতে হবে, চাষের অনুদান যেন ছোট চাষির কাছেই পৌঁছয়। অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত মানুষের স্বাস্থ্য, পেনশন প্রভৃতি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় চাষিকেও আনা দরকার। স্বল্প সঞ্চয় ও ক্ষুদ্র ঋণের পরিসর গ্রামীণ এলাকায় অনেক বাড়ানো চাই। সার্বিক সহায়তার পরিকাঠামো তৈরি না হলে ছোট চাষির মুক্তি নেই।
ড. এপিজে আব্দুল কালাম গভর্নমেন্ট কলেজে নৃতত্ত্বের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy