রাজ্যপাল’ নামক পদটি আদৌ রাখিবার কোনও যৌক্তিকতা আছে কি না, সেই বিতর্ক দীর্ঘ দিনের। ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার ভিন্ন পদটির আর মাহাত্ম্য কী? সেই তর্ক যদি বকেয়াও রাখা যায়, একটি কথা সংশয়াতীত— রাজ্যপাল পদে যিনি থাকিবেন, তিনি দৃশ্যমান হইবেন বটে, কিন্তু শ্রুতিগোচর নহে। অর্থাৎ, রাজ্যের প্রশাসনিকতায় আলংকারিক ভিন্ন অন্য কোনও গুরুত্ব এই পদটির নাই। কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর সহিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাম্প্রতিকতম সংঘাতের প্রেক্ষিতে ফের এই কথাটি স্মরণ করাইয়া দেওয়া বিধেয়। রাজ্য সরকারকে না জানাইয়া জেলা প্রশাসনের সহিত বৈঠক করিতে চাওয়া আদৌ সাংবিধানিক কি না, বিশেষজ্ঞরা তাহার নিষ্পত্তি করিবেন। কিন্তু, আইনের ঊর্ধ্বে যাহার স্থান, তাহা রীতি অনুসারে চলিবার শিষ্টতা। ভারতীয় শাসনব্যবস্থার রীতি বলিবে, রাজভবন প্রশাসনিকতায় হস্তক্ষেপ করে না। রাজ্যপালের যদি নিতান্তই কোনও বক্তব্য থাকে, তাহা মুখ্যমন্ত্রী বা সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রীকে একান্তে জানানোই বিধেয়। সিদ্ধান্ত করিবার এক্তিয়ার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের। ত্রিপাঠীকে অবশ্য ব্যতিক্রম বলা মুশকিল, কারণ রাজভবনের অতিসক্রিয় হইবার প্রবণতা বারে বারেই দেখা গিয়াছে। আচরণটি রাজ্যপালের পদের গুরুত্বের সহিত মানানসই নহে।
আরও বেমানান রাজ্যপালের তরজায় জড়াইয়া পড়া। শাসক দল তাঁহার প্রশাসনিক বৈঠক বিষয়ে আপত্তি জানানোর পর রাজ্যপাল প্রকাশ্যে যে প্রতিক্রিয়া জানাইয়াছেন, তাহা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। রাজ্যের নির্বাচিত সরকার বিষয়ে কোনও তির্যক মন্তব্য— তাঁহার নিজস্ব বিচারে তাহা যতই সংগত হউক না কেন— রাজ্যপাল করিতে পারেন না। প্রকাশ্যে তিনি সরকারের নীতিরও সমালোচনা করিতে পারেন না। নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের মুখে ময়লা লাগিয়া আছে কি না, সেই প্রসঙ্গের উত্থাপন তো কল্পনাতীত। কেহ তাঁহাকে প্রশ্ন করিতেই পারেন, এমনকী উসকাইতেও পারেন। কিন্তু, সেই প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ার, উসকানিতে প্রলুব্ধ না হইবার অধিকার তাঁহার বিলক্ষণ আছে। প্রশ্ন হইল, মৌনী থাকিবার ইচ্ছাটিও কি আছে? এইখানেই শ্রুতিগোচর না হইবার নীতিটির মাহাত্ম্য। রাজ্যপাল যদি কোনও প্রসঙ্গেই মুখ না খোলেন, তবে আর কোনও একটি বিশেষ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ইচ্ছার গুরুত্ব থাকে না। কেশরীনাথ ত্রিপাঠী অহেতুক মুখ খুলিয়া কি এই অভিযোগটিকেই মান্যতা দিলেন না যে রাজ্যপাল রাজনীতি করিতেছেন?
শাসক দলের প্রতি বিশ্বস্ততার পুরস্কার হিসাবেই রাজ্যপালের পদটি ব্যবহার করা হইতেছে বলিয়া সাম্প্রতিক কালে একাধিক বার অভিযোগ উঠিয়াছে। কোন বিশিষ্ট নাগরিককে রাজ্যপাল করা হইবে, সেই বিবেচনা অবশ্যই কেন্দ্রীয় সরকারের। কিন্তু, এই পদে বসিতে হইলে যে পূর্বাশ্রম বিস্মৃত হইতে হয়, সেই শর্তটি অলঙ্ঘনীয়। তিনি পূর্বে কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক বা নেতা ছিলেন, কোন ‘সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান’-এর সহিত তাঁহার নাড়ির যোগ ছিল, সে সব কথা মনে রাখিলে রাজ্যপালের চলে না। তাঁহার অস্তিত্বটি অরাজনৈতিক। যে ব্যক্তির পক্ষে রাজ্যপাল পদের এই পূর্বশর্তটি পূরণ করা সম্ভব নহে, তাঁহাকে এই পদে নিয়োগ না করাই বিধেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy