Advertisement
০৯ মে ২০২৪

দেশপ্রেমের নামে অন্য দেশকে ছোট করেননি তিনি

জাতীয়তাবাদের নামে অন্য রাষ্ট্রের প্রতি বিদ্বেষ প্রচার নয়। বরং নিজ দেশগণ্ডি ভেদ করে বিশ্বের সঙ্গে মিলনে সবার চৈতন্য জাগাতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লিখছেন দেবযানী ভৌমিক (চক্রবর্তী)রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম হল তাঁর মানবতাবাদ। দেশকে ভালবাসা অর্থাৎ দেশের মানুষকে সব ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে গিয়ে অকৃত্রিম ভাবে ভালবাসা। পক্ষান্তরে পৃথিবীর সকল মানুষকেই ভালবাসা।

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৯ ০১:৩৭
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর গীতবিতানে সজ্জিত গানগুলি সম্পর্কে বলেছিলেন—‘‘...সুরের সহযোগিতা না পেলেও পাঠকেরা গীতিকাব্যরূপে এই গানগুলির অনুসরণ করতে পারবেন।’’ (অখণ্ড গীতবিতান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা)। অর্থাৎ, স্বরবিতানের মতো গীতবিতানে সুরটি দেওয়া না থাকলেও কবিতা হিসেবেও এই গানগুলির একটা পাঠযোগ্যতা আছে। এটা বাস্তবিক দেখা যায়, বেসুরো সঙ্গীতপ্রেমিকরা এই গানগুলির লিরিক আবেদনের জন্য প্রাণের আনন্দে পাঠ করে থাকেন। সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই সফল হলেও একথা অনস্বীকার্য তাঁর সৃষ্ট সঙ্গীত তাঁকে সর্বাধিক জনপ্রিয় করে রেখেছে আজও। মানবমনের সকল অনুভূতি প্রকাশে এই সকল গান বাণী ও সুরের সমন্বয়ে যেন অনবদ্য সৃষ্টি।

রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম হল তাঁর মানবতাবাদ। দেশকে ভালবাসা অর্থাৎ দেশের মানুষকে সব ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে গিয়ে অকৃত্রিম ভাবে ভালবাসা। পক্ষান্তরে পৃথিবীর সকল মানুষকেই ভালবাসা। পশ্চিমের পররাষ্ট্রলোভী আগ্রাসী তথা মানবতাবিরোধী জাতীয়তাবাদে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। যা তাঁর ১৯১৭ সালে প্রকাশিত ‘ন্যাশনালিজম্’ গ্রন্থে আমরা পেয়ে থাকি। গ্রন্থটির এমন জাদুশক্তি ছিল যে, ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া ম্যাক্স প্লাওম্যান নামে এক ইংরেজ যুবক ১৯১৭ সালে গ্রন্থটি পাঠ করে যুদ্ধ থেকে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এর ফলে অবশ্য তাঁকে শাস্তিভোগ করতে হয়েছিল। রোমা রোলাঁও গ্রন্থটির পরম ভক্ত ছিলেন। তাঁর বোনকে দিয়ে গ্রন্থটির ফরাসি অনুবাদ করে প্রকাশও করেছিলেন। লেনিনেরও বিশেষ প্রিয় ছিল এটি। রবীন্দ্রমননের যে ইতিবাচক দিকটি ছিল, তার প্রমাণ তিনি বিভিন্ন লেখায় দিয়েছেন। তাই জাতীয়তাবাদের নামে অন্য রাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ প্রচার নয়, বরং শুধু নিজ দেশগণ্ডি ভেদ করে বিশ্বের সঙ্গে মিলনের উৎসবে তিনি সকলের চৈতন্যকে জাগাতে চেয়েছেন। পূজা পর্যায়ের একটি গানে তিনি বলেছেন— ‘‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো/ সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।’’

রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে রবীন্দ্রনাথের মোট গানের সংখ্যা ২২৩২টি। কবি নিজেই গীতবিতানের দ্বিতীয় সংস্করণে ‘ভাবের অনুষঙ্গ রক্ষা করে’ গানগুলিকে পূজা, স্বদেশ, প্রেম, প্রকৃতি, বিচিত্র ইত্যাদি পর্যায়ে সাজিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে ৪৬টি গানকে তিনি স্বদেশ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করেন। কবির তিরোধানের পর তৃতীয় সংস্করণে ‘জাতীয় সংগীত’ শিরোনামে কবি বর্জিত ১৬টি গানকে সংকলিত করা হয়। সুতরাং, গীতবিতানে স্বদেশি গানের সংখ্যা সর্বমোট ৬২টি। রবীন্দ্রনাথের দেশভাবনার প্রকাশ অন্য রচনাতেও আমরা পেয়ে থাকি। এমনকি, স্বদেশ পর্যায় ভিন্ন অন্য পর্যায়েও পেয়ে থাকি। তবে স্বদেশ পর্যায়ের গানগুলিতেই দেশচিন্তার সচেতন প্রকাশ লক্ষ করা যায়। তিনি ভারতীয়তার নবীকরণ ঘটিয়েছেন। তাঁর ভারতচেতনার যেন বিশ্বায়ন ঘটেছে বিশ্বমানবতার মাধ্যমে। আধুনিক দুনিয়ার বাণিজ্যিক বিশ্বায়ন তা নয়। রবীন্দ্রনাথের গান প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশেরও জাতীয়সঙ্গীত। এ থেকেই তো বোঝা যায়, কোনও নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে তিনি সীমায়িত নন। সমগ্র বিশ্বই তাঁর আবাসভূমি। সকলের জন্য ভালবাসা তথা শুভচেতনা এটাই তো ভারতীয়ত্ব। জগতের আনন্দযজ্ঞের নিমন্ত্রণেই যে তাঁর মানবসংসারে আগমন।

প্রকৃত মানবদরদী তথা দেশপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ দেশ ও জাতির মুক্তি আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করেছেন মূলত লেখনির সাহায্যে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে ঘিরে যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল, ওই সময়টাই ছিল কবির স্বদেশভাবনামূলক গানের উৎকৃষ্ট সময়। যদিও তিনি বালক বয়স থেকে শুরু করে জীবনসায়াহ্ন পর্যন্ত এই ভাবের গান লিখেছেন। তবে সংখ্যার দিক থেকে ওই সময়েই বেশি। তাঁর স্বদেশ পর্যায়ের গানগুলি অনেক ক্ষেত্রেই কোনও কবিতার গীতরূপ। যেমন দু’টি জনপ্রিয় গান— ‘‘কেন চেয়ে আছো, গো মা মুখপানে!" এবং ‘‘আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না।’’— দুটিই ‘কড়ি ও কোমল’ (১৮৮৬) কাব্যগ্রন্থের ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ ও ‘বঙ্গবাসীর প্রতি’ কবিতার গীতরূপ। এ প্রসঙ্গে শেষোক্ত কবিতাটি অর্থাৎ গান হিসেবে গড়ে ওঠার কারণস্বরূপ ‘আমায় বোলো না গাহিতে’র প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিষয়টি উল্লেখ করা প্রয়োজন। সেটি হল— তারকনাথ পালিতের বাড়িতে আমন্ত্রিত কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয়দের আচরণে তাঁদের দেশপ্রেমের অগভীরতা অনুভব করেন রবীন্দ্রনাথ। নেতাদের দেশপ্রেমের নামে ভণ্ডামি দেখে এই গানটিতেই কবি বলছেন— ‘শুধু মিছে কথা ছলনা’।

জীবনের অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত খাঁটি দেশপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ দেশনেতাদের যে কোনও প্রকার ভ্রান্তি, অপরাধ বা সংকীর্ণ মানসিকতার বিরুদ্ধে যেমন কথা বলেছেন, তেমনই ধিক্কার জানিয়েছেন ব্রিটিশ সরকারের শোষণ-দমন-হিংস্রতাকে। নির্ভীক প্রতিবাদে তাঁর লেখনি সক্রিয় থেকেছে সর্বদা। আবার, এ হেন রবিঠাকুরকেও বিরূপ সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। তাঁর পঞ্চাশ বছর বয়সের (১৯১১) রচনা ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ গানটি সম্পর্কে অনেকে মন্তব্য করেছিলেন এটি সম্রাট পঞ্চম জর্জের প্রশস্তি করে কবি রচনা করেছেন। কিন্তু বিষয়টি অসত্য। প্রকৃত সত্যটি হল কলকাতায় ২৭তম কংগ্রেস অধিবেশনে গাওয়ার জন্য জাতীয় নেতাদের অনুরোধে তিনি এটি লিখেছিলেন। তার পর ১৯৩৬ সালের ২৮ অক্টোবর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি এই গানটিকে ভারতের জাতীয়সঙ্গীত হিসাবে স্বীকৃতি দেন।

রবীন্দ্রনাথ যেমন স্বদেশভাবনার সঙ্গে বিশ্বভাবনাকে মিলিয়েছেন। আবার, তার সঙ্গে দেশমাতার মহিমা বন্দনা তথা ভারতকে মহামিলনের পুণ্য অঙ্গন হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন তাঁর গানে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য তাঁর ‘ভারততীর্থ’ কবিতার গীতরূপ ‘হে মোর চিত্ত, পুণ্যতীর্থে’— যেখানে তাঁর ভারতচেতনা শীর্ষ স্পর্শ করেছে৷ তিনি এখানে ‘নরদেবতারে’ নমস্কার জানাচ্ছেন। কবির এই দেশ-ভাবনাই এখানে বিশ্বভাবনায় উত্তীর্ণ।

কবির স্বদেশভাবনামূলক গানগুলি বিভিন্ন রাগরাগিণী ও ছন্দে গাঁথা। সুরবৈচিত্রও চোখে পড়ার মতো। কোনও কোনও গানকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে বাউল সুর। গগন হরকরার সেই বিখ্যাত গান—‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে’— যেটি কবির বড় প্রিয় ছিল। এক দিকে মনের মানুষের সন্ধান যেমন তিনি আজীবন করেছেন, তেমনই ওই সুরও তাঁকে যেন বিভোর করে রেখেছিল। বেশ কিছু গান তিনি ওই সুরে সৃষ্টি করেছেন। উল্লেখ করা যায় ‘আমার সোনার বাংলা’ (বাংলাদেশের জাতীয়সঙ্গীত) গানটি। যদিও লালন ফকিরের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’—গানটিও কবিকে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর ‘গোরা’ উপন্যাসের সূচনাতেই যার উল্লেখ। জমিদারি দেখাশোনার কাজে পদ্মা তীরবর্তী শিলাইদহ-পতিসর-সাজাদপুর অঞ্চলের জনজীবনের বিশেষ কাছাকাছি আসার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। তখনই কৃষক-শ্রমিকদের পাশাপাশি বাউল-ফকিরদের সান্নিধ্যও লাভ করেছিলেন। স্বদেশি গানে পথকবি বাউলদের সুরপ্রভাব যেন যথার্থই গানগুলিকে জনগণসঙ্গীত করে তুলেছে। এ প্রসঙ্গেই উল্লেখ করতে হয় যে, ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার প্রতিবাদে সেই অনবদ্য গানটি— ‘‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল—/ পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।’’ মানুষের বোধের জাগরণ ঘটিয়েছে রবীন্দ্রগান। সাধারণ মানুষকে সহজেই স্পর্শ করে তাঁর গানের বাণী। দেশকে দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার যে মরিয়া প্রচেষ্টা ভারতবাসীর মধ্যে দেখা দিয়েছিল তাতেও এই গানের বিশেষ ভূমিকা ছিল বলেই মনে করা যায়। তিনি দেশকে ভালবেসেছেন অন্তর দিয়ে কিন্তু নিজের দেশকে কখনও সর্বশ্রেষ্ঠ দেশ বলে বন্দনা করেননি। কারণ, দেশপ্রেমের নামে অন্য কোনও দেশকে কোনও ভাবে ছোট করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। পরজাতিবিদ্বেষ বা উগ্র জাতীয়তাবাদ তাঁর নিকট সর্বাগ্রে পরিত্যাজ্য। দেশের মাটিতে তিনি মাথা ঠেকাতে চেয়েছেন। একটি গানে তিনি দেশকে এ ভাবে বন্দনা করেছেন— ‘‘অয়ি ভুবনমনোমোহিনী, মা,/ অয়ি নির্মলসূর্যকরোজ্জ্বল ধরণী জনকজননিজননী।’’ দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা এখানে ফুটে উঠেছে। ভাণ্ডার পত্রিকায় ১৩১২ সনের মাঘ সংখ্যায় ‘রাজভক্তি’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন— ‘‘...ভারতবর্ষের ইংরেজ হৃদয়ের কারবার কোনোদিন করে নাই। তাহারা এদেশকে হৃদয় দেয়ও নাই, এ দেশের হৃদয় চায়ও নাই, দেশের হৃদয়টা কোথায় আছে তাহার খবরও রাখে নাই।’’

রবীন্দ্রনাথের বিশ্বৈক্যবোধই আজকের এই অশান্ত পরিস্থিতিতে হয়ে উঠতে পারে অবলম্বন।

(উদ্ধৃতির বানান অপরিবর্তিত)

শ্রীপৎ সিং কলেজের বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Patriotism Nationality
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE