Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
এক ঢিলে দুই পাখি

দুই শতাব্দীর আন্দোলন পার স্রেফ একটি পঞ্জির জোরে

সমস্যা চরমে ওঠে যখন পূর্ব বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলের চাষিদের অসমের পতিত জমিতে পুনর্বাসন দেয় ব্রিটিশ সরকার। প্রথম দিকে ভূমিহীন মুসলমানরা অল্প অল্প করে এসেছিলেন, কিন্তু তার পর থেকে তাঁদের আসা ক্রমেই বাড়তে থাকে। অসমিয়াদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও জনস্রোত ঢুকতে থাকে অসমে। যে রাজ্যে মুসলমানদের সংখ্যা নিতান্ত কম ছিল, সেখানে তাঁদের অনুপাত ক্রমে বড় আকার নিল।

সজল নাগ
শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

গত ৩০ জুলাই, অসমের স্থানীয় সংবাদপত্রগুলিতে পাশাপাশি দু’টি জিনিস পাঠকের নজর কেড়েছে। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে নেতারা পরস্পর মিষ্টি বিতরণ করছেন, আর তার পাশেই বড় বড় হরফের শিরোনাম: ৪০,০০,৭০৭ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে, যাঁরা অসমে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী। এই রাজ্যে ‘অবাঞ্ছিত’ ৪০ লক্ষ মানুষের থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে, তাই এই উৎসব। এই অ-নাগরিকরা প্রধানত বাঙালি। হিন্দু ও মুসলমান, দুই সম্প্রদায়েরই। ঔপনিবেশিক অঞ্চল ভাগাভাগির কারণে ১৮২৪ থেকে আদি অসমিয়ারা এঁদের সঙ্গে বসবাসে বাধ্য হয়েছেন। তখন থেকেই বিভাজন শুরু। হিন্দুরা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদির দিক থেকে ‘অপর’, আর মুসলমানরা সরাসরি রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক ত্রাস। যে সব বাঙালি ঔপনিবেশিক সরকারের কর্মী হয়ে অসমে বসবাস শুরু করেন, অসমিয়ারা কেবল তাঁদের সামাজিক প্রাধান্য নিয়েই আপত্তি করেননি, বাঙালির সাংস্কৃতিক আধিপত্য নিয়েও তাঁদের আপত্তি ছিল। অসমিয়ারা এঁদের চক্রী বলে মনে করতেন, কারণ ১৮৩৭ সালে অসমিয়া ভাষাকে সরিয়ে বাংলাকে অসমের সরকারি ভাষা বলে ঘোষণা করা হয়। কেবল তা-ই নয়, অসমিয়াকে বাংলার একটি উপভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাংলার তিনটি জেলা— সিলেট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়াকে ১৮৭৪ সালে অসম প্রশাসনের অন্তর্ভুক্ত করা হলে শুধু বাংলাভাষীর সংখ্যাই বাড়ে না, প্রশাসনে বাঙালি প্রাধান্যও বাড়ে।

সমস্যা চরমে ওঠে যখন পূর্ব বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলের চাষিদের অসমের পতিত জমিতে পুনর্বাসন দেয় ব্রিটিশ সরকার। প্রথম দিকে ভূমিহীন মুসলমানরা অল্প অল্প করে এসেছিলেন, কিন্তু তার পর থেকে তাঁদের আসা ক্রমেই বাড়তে থাকে। অসমিয়াদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও জনস্রোত ঢুকতে থাকে অসমে। যে রাজ্যে মুসলমানদের সংখ্যা নিতান্ত কম ছিল, সেখানে তাঁদের অনুপাত ক্রমে বড় আকার নিল। এবং যে ঔপনিবেশিক সরকার এই দেশান্তরের হোতা, তারাই তখন রাজ্যকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করার উদ্দেশ্যে অসমিয়াদের এই বলে সাবধান করতে লাগল যে, তাঁদের উপর বাঙালি মুসলমানদের ‘আক্রমণ’ এবং ‘আগ্রাসন’ ঘটবে। ঔপনিবেশিক রটনাই সত্য প্রমাণিত হল যখন ১৯৪০ সালের লাহৌর চুক্তিতে পাকিস্তান প্রস্তাবে অসমকেও পাকিস্তানের অঙ্গ করে নেওয়ার দাবি উঠল। অসম পাকিস্তানে চলে যাবে, এই ভয়ে অসমিয়ারা তখন অভিবাসীদের তাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। পাকিস্তানের অঙ্গ হলে অসমিয়া পরিচিতি এবং আধিপত্যে প্রচণ্ড আঘাত পড়বে, তা থেকে পরিত্রাণের একটাই উপায় ছিল বাঙালি জনসংখ্যা কমানো, সে হিন্দুই হোক আর মুসলমানই হোক। সিলেটকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করায় বাঙালি জনসংখ্যার ভার কিছুটা কমেছিল বটে, কিন্তু ভারত ভাগ হওয়ার পর পূর্ববঙ্গ থেকে আসা বাঙালি উদ্বাস্তুরা সেই শূন্যস্থান প্রায় পূরণ করে দিলেন। অসমে সেই সময়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে নিয়মিত দাঙ্গা হত। তার মধ্যে ১৯৪৮, ১৯৫৪, ১৯৫৫ এবং ১৯৬০ সালের দাঙ্গা মনে রাখার মতো।

জনবিন্যাসের রাজনীতি ও অভিবাসী বিতাড়নের দাবি তখন থেকেই অসমের রাজনীতির মূল ভিত্তি। ১৯৪৬-১৯৫১ সালে অসমে ২,৭৪,৪৫৫ জন উদ্বাস্তু ছিলেন। ১৯৫৬ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লক্ষ ৯০ হাজার, ১৯৬১’তে ৭ লক্ষ ২৬ হাজার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় প্রায় ৩ লক্ষ উদ্বাস্তু অসমে আশ্রয় নেন। মনে করা হয়, স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার পরেও এঁদের অনেকেই ফিরে যাননি। লক্ষণীয়, স্বাধীনতার পরে অসমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ বহু মুসলমানকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু ১৯৫০ সালের নেহরু-লিয়াকত চুক্তির দৌলতে তাঁদের অনেকেই ১৯৫১-৫২ সালে আবার ফিরে আসেন। বরদলৈ নিজের রাজনৈতিক প্রয়োজনের দিক থেকে বাঙালি মুসলমানদের বিশেষ উপযোগী মনে করেছিলেন, কারণ তাঁরা অসমিয়াদের সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছুক ছিলেন, আর তাঁদের কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাবনা ছিল, অন্য দিকে হিন্দু বাঙালিরা নিজেদের ‘সাংস্কৃতিক ভাবে উচ্চতর মানের’ বলে মনে করতেন, ‘স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে চাইতেন’। বরদলৈয়ের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী নেহরু বলেছিলেন, এই নীতির মূলে আছে সঙ্কীর্ণ মানসিকতা।

এই সময়ে অসম জাতীয় মহাসভা ও অম্বিকা গিরি রায়চৌধুরীর মতো নেতার উদ্যোগে মুসলমান বাঙালি অভিবাসীরা অনেকেই নিজেদের অসমিয়াভাষী বলে চিহ্নিত করেন। ফলে ১৯৫১-এর জনশুমারিতে রাজ্যের জনসংখ্যায় অসমিয়াদের অনুপাত বেড়ে যায়। কিন্তু আদি অসমিয়াদের মনে ভয় থেকেই যায় যে, এই বাঙালি অভিবাসীরা যদি মাতৃভাষার টানে বাংলায় ফিরে যান, তা হলে হিন্দু-অসমিয়ার সংখ্যা কমে যাবে এবং তাঁরা ফের সংখ্যালঘু হয়ে পড়বেন। ১৯৬০ সালে অসমের সব মানুষকে একত্র করার তাগিদে অসমিয়াকে সরকারি ভাষা করার দাবি ওঠে। কিন্তু ফল হয় উল্টো, অসম প্রদেশটি ভেঙে কয়েকটি ছোট রাজ্যের সৃষ্টি হয়।

গত শতাব্দীর শুরু থেকেই বাঙালি মুসলমানদের চলে আসা শুরু হয়েছিল। কোনও দিনই তা বন্ধ হয়নি। কিন্তু আগে যা ছিল একই প্রদেশের এক জেলা থেকে আর এক জেলায় বৈধ যাতায়াত, দেশভাগের পর তা অবৈধ অনুপ্রবেশ হয়ে দাঁড়াল। ১৯৫০ সাল থেকে অসমে মুসলমান অনুপ্রবেশের অভিযোগ চলেই আসছে। কেন্দ্রের সম্মতিক্রমে তখন বিভিন্ন পদক্ষেপ করা হয়। যেমন, পারমিট ব্যবস্থা, অভিবাসী (অসম থেকে উৎখাত) আইন (১৯৫০), আইএমডিটি (বেআইনি অভিবাসী নির্ধারণ আইন), সন্দেহজনক অনুপ্রবেশকারীদের উৎখাত বা আটক করার উদ্দেশ্যে ‘ডি’ (ডাউটফুল) ক্যাটেগরি ভোটার চিহ্নিতকরণ। ১৯৮৩ সালে নেলিতে এক ভয়াবহ ঘটনায় প্রায় ৩০০০ মুসলমানকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৭৯ সালে মঙ্গলদইয়ের উপনির্বাচনে মুসলমান ভোটারের সংখ্যা বিপুল ভাবে বাড়ে।

এই সংখ্যাস্ফীতির প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে শুরু হয় বিদেশি-বিরোধী আন্দোলন, ১৯৮৫ সালে অসম চুক্তির মাধ্যমে যার অবসান ঘটে। ঠিক হয়, ১৯৭১-এর আগে পর্যন্ত যাঁরা অসমে এসেছেন তাঁদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, কিন্তু শর্ত ছিল ১৯৬১ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে যাঁরা এসেছেন তাঁরা ভারতে টানা দশ বছর বসবাস করার পরই নাগরিকত্ব পাবেন। কিন্তু অসম চুক্তিতে জাতীয় নাগরিক পঞ্জির কোনও উল্লেখ ছিল না। অসম চুক্তি বা অসম গণ পরিষদ খুব বেশি সংখ্যক বিদেশি নাগরিককে ফেরত পাঠাতে পারেনি, ফলে এই ব্যাপারটি অসমের রাজনৈতিক আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে যায় এবং রাজনৈতিক মেরুকরণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। অনুমান করা হয়েছিল, ৩০ লক্ষ থেকে ১ কোটি বাংলাদেশি অবৈধ ভাবে অসমে বসবাস করছেন, যাঁরা অচিরেই আদি অসমবাসীদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করতে পারেন।

ইতিমধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা অসমের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশে পৌঁছয়, অসম বিধানসভায় ১২৬ জন বিধায়কের মধ্যে ১৯৫২ সালে যেখানে ১২ জন মুসলমান বিধায়ক ছিলেন, সেখানে ১৯৯১’তে মুসলমান বিধায়কের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪। রটনা হয়, ‘‘অসমের আদি বাসিন্দারা যে নিজভূমে পরবাসী হয়ে যাবেন সেটা কেবল সময়ের অপেক্ষা... তার পরেই অসমকে বাংলাদেশের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য গণভোটের প্রস্তাব আসবে।’’ আসল ভয় ছিল, যদি মুসলমান বিধায়করা অসমিয়া জনজাতি, চা-বাগানের প্রাক্তন শ্রমিক, নেপালি ও বাঙালি হিন্দু বিধায়কদের সঙ্গে হাত মেলান, তা হলে তাঁরা অসমিয়া হিন্দুদের আধিপত্যে প্রবল আঘাত হানতে পারেন। সেটা আটকানোই ছিল অসমের আদি বাসিন্দাদের উদ্দেশ্য।

একটি ত্রিপাক্ষিক আলোচনায় বিদেশি সংক্রান্ত বিতর্কিত প্রশ্নটি ‘আসু’ আবার তোলে। এই প্রথম, ২০০৫ সালের সেই আলোচনায় ঠিক হয় যে, ১৯৫১ সালের হওয়া জাতীয় নাগরিক পঞ্জির সংশোধন করা হবে। ২০১৪ সালে একটি আবেদনের উত্তরে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী সংশোধনের প্রক্রিয়া চালু হয়। ১৯৫১ সালের জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরি হয়েছিল খুব গোপনে, জনশুমারির জন্য জমা দেওয়া স্লিপের ভিত্তিতে। সেই প্রক্রিয়ায় নজরদারির সুযোগ ছিল না, এই পঞ্জি প্রামাণ্য তথ্য হিসেবে গণ্য হওয়ারও যোগ্য ছিল না। আক্ষেপের কথা, নাগরিকত্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি কোনও প্রামাণ্য তথ্য হতে পারে না— এই মর্মে কোনও প্রতিবাদী আবেদন সুপ্রিম কোর্টে জমা পড়েনি। আর তাই কলমের একটি খোঁচায় ৪০ লক্ষ মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে যেতে পারেন। এক শতাব্দীর আন্দোলন যা করতে পারেনি, জাতীয় নাগরিক পঞ্জির সংশোধন দু’বছরে তা করে দেখাল।

এই সংশোধিত নাগরিক পঞ্জি নিয়ে অসমিয়াদের সমর্থনকে রাজনৈতিক দলগুলি আবার ব্যবহার করতে নেমে পড়েছে। কংগ্রেস বাহবা নিতে চাইছে, কারণ তারাই এই সংশোধনের পথিকৃৎ, আর বিজেপির দাবি, তারা কাজের কাজটা করে ‘হিম্মত’ দেখিয়েছে— বাংলাদেশি মুসলমানদের উৎখাত করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে। এ বার হিন্দু-বাঙালিদের সামনে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল ২০১৬-র গাজর ঝোলানো হচ্ছে। তাঁদের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে: যে সব হিন্দু-বাঙালির নাম জাতীয় নাগরিক পঞ্জিতে নেই, ওই বিল পাশ হলে তাঁরা নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। এ হল ২০১৯-এর নির্বাচনে তাঁদের ভোট পাওয়ার জুতসই হাতিয়ার। এবং, এক ঢিলে দুই পাখি মারার দারুণ কৌশল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

History Assam NRC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE