Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
যন্ত্র নয়, ভরসা মানুষ

ভয়াবহ সন্ত্রাসের দৃশ্য দেখেও মনে হচ্ছে, বুঝি ভিডিয়ো গেম

ওই ভিডিয়ো কত জন ডাউনলোড করেছেন, কতটা এলাকা জুড়ে ভিডিয়োটি ছড়িয়েছে, সে সবের কোনও স্পষ্ট হিসেব মেলেনি ফেসবুক, ইউটিউব, ট্যুইটার বা ইনস্টাগ্রামের কাছ থেকে। বিশ্ব জুড়ে অগণিত ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। তাই সেই হিসেব পাওয়াও কার্যত অসম্ভব। আসলে কোনও ছক, কোনও হিসেবেই বাঁধা যাচ্ছে না সোশ্যাল মিডিয়াকে।

সুজিষ্ণু মাহাতো
শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৯ ০০:৩৩
Share: Save:

‘‘কম্পিউটারে খেলছে আমার মেয়ে

নিধনের খেলা এ মেরে ফেলছে ওকে

অথবা দৈত্য ফেলছে কাউকে খেয়ে

মগজে এখন শুধু ভাইরাস ঢোকে...’’

কবীর সুমন, তখন সুমন চট্টোপাধ্যায়, লাইনগুলো লিখেছিলেন অনেকগুলো বছর আগে। যে ভাইরাস তখন মগজে ঢুকেছিল, তারা এখন সেখানে রাজ্যপাট বসিয়ে ফেলেছে। নিধনই এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। পাবজি বা প্লেয়ার্স আননোন ব্যাটলগ্রাউন্ড-এর মতো বন্দুকবাজির খেলায় এখন বুঁদ অজস্র স্কুলপড়ুয়া, কলেজপড়ুয়া, এমনকি কমবয়েসি চাকুরেরাও।

খেলা তো বন্দি মোবাইলে। কিন্তু বাস্তব? সে আরও ভয়ঙ্কর। খেলার ছলে বন্দুকবাজির এই দৃশ্যগুলো এখন এতটাই ‘স্বাভাবিক’, যে সত্যিকারের সন্ত্রাসবাদী হানার, বন্দুকবাজের গুলিতে সাধারণ মানুষের লুটিয়ে পড়ার দৃশ্য দেখেও এক ঝলকে মনে হচ্ছে বুঝি ভিডিয়ো গেম চলছে। আর তাই সংশয়— সন্ত্রাসবাদীরা তাদের সন্ত্রাসের সম্প্রচারের জন্য সেই সুযোগটাই নিচ্ছে না তো? নিউজ়িল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে সন্ত্রাসবাদী হানার পর সেই আশঙ্কা আরও জোরালো হয়েছে।

মাথার হেলমেটে লাগানো ক্যামেরার সাহায্যে ফেসবুকে লাইভ করতে করতে মসজিদে ঢুকে গুলি চালায় নিউজ়িল্যান্ডের দুষ্কৃতী। ১৭ মিনিট ধরে সেই ভিডিয়ো সরাসরি সম্প্রচারিত হয় ফেসবুকে। ভিডিয়োটি ছড়িয়ে পড়ে ইউটিউব, ট্যুইটারের মতো অন্য মাধ্যমেও। বিশ্ব জুড়ে। নিউজ়িল্যান্ড পুলিশের নির্দেশ পাওয়ার পরে যত ক্ষণে ফেসবুক সেই ভিডিয়ো সরায়, তত ক্ষণে যা ক্ষতি হবার হয়ে গিয়েছে। কারণ ওই সব মাধ্যম থেকে ভিডিয়োটি ডাউনলোড হয়ে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা আর মুছে ফেলা সম্ভব নয়।

ওই ভিডিয়ো কত জন ডাউনলোড করেছেন, কতটা এলাকা জুড়ে ভিডিয়োটি ছড়িয়েছে, সে সবের কোনও স্পষ্ট হিসেব মেলেনি ফেসবুক, ইউটিউব, ট্যুইটার বা ইনস্টাগ্রামের কাছ থেকে। বিশ্ব জুড়ে অগণিত ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। তাই সেই হিসেব পাওয়াও কার্যত অসম্ভব। আসলে কোনও ছক, কোনও হিসেবেই বাঁধা যাচ্ছে না সোশ্যাল মিডিয়াকে। এ যেন আমাদের জীবনে এক বাগে না আনতে পারা পোষ্য। যাকে ছাড়া আমাদের চলবে না, অথচ যার অপকর্মে বেড়ি পরানোর ক্ষমতাও আমাদের নেই।

ফেসবুক-ইউটিউবের মতো সংস্থায় হিংসা বা অন্য কোনও নেতিবাচক ভিডিয়ো চেনার জন্য ব্যবহার করা হয় যন্ত্র-মেধা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। সেই যন্ত্র-মেধা, যা না কি আগামী দিনে মানুষের মেধাকে ছাড়িয়ে যাবে, মানুষের চেয়েও যোগ্যতর পরিপূরক হয়ে উঠবে বলে দুনিয়া জুড়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু, কেমন সেই মেধা, যা বন্দুকবাজের গুলি করে মানুষ মারা দেখেও তা চিনতে পারে না? বুঝতে পারে না যে সেটা মোবাইল গেম না কি আসল হত্যালীলা! না কি যন্ত্র-মেধার এই ফাঁক বুঝে ফেলেই দুষ্কৃতীরা এমন ভাবে ক্যামেরা বসায়, যাতে হত্যার ভিডিয়ো দেখে যন্ত্র-মগজের মনে হয় ভিডিয়ো-গেমের দৃশ্য? হয়তো তারা বহু মহড়ার পরে ওই ভাবেই ক্যামেরাটা বসিয়েছিল, যাতে যন্ত্রের চোখে মনে হয় ভিডিয়ো গেম চলছে! পরে আবার এমন হলে তা ঠেকানোর উপায় কী? উত্তর নেই এমন বহু প্রশ্নের।

এ বছরের ফেব্রুয়ারির গোড়াতেই ফেসবুক দাবি করেছিল, কেবল যন্ত্র-মেধাই নয়, বিশ্বের নানা জায়গায় ২০টি অফিসে তাদের ৩০০০০ কর্মী কনটেন্টের (লেখা-ছবি-ভিডিয়ো) নজরদারি ও নিরাপত্তার তদারকি করেন। তারা এও দাবি করে, কোনও অভিযোগ পাওয়ার আগেই ফেসবুক সন্ত্রাস সম্পর্কিত ৯৯ শতাংশ কনটেন্ট, ৯৭ শতাংশ হিংসামূলক কনটেন্ট ও ৯৬ শতাংশ নগ্নতা সম্পর্কিত কনটেন্ট চিহ্নিত করতে পারছে। কিন্তু ক্রাইস্টচার্চের ঘটনার পর সেই দাবির সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

ফেব্রুয়ারির শেষেই জানা গিয়েছিল আবার আর এক কাণ্ড! ‌সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ভার্জ’-এর রিপোর্টে জানা যায় ফেসবুকের কনটেন্ট বিচার করার দায়িত্বে থাকা কর্মীদের একটা বড় অংশই ফেসবুকের কর্মী নন। অন্য সংস্থাকে দিয়ে এই কাজ করানো হয়। ওই প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, সেই কর্মীদের অনেকেই অত্যধিক হিংসার ভিডিয়ো দেখে ট্রমায় চলে যাচ্ছেন। সেই ট্রমা কাটাতে অনেকে ড্রাগে, যৌনতায় আসক্ত হয়ে পড়ছেন। সুস্থ ভাবে কাজ করতে পারছেন না। এই খবর প্রকাশ্যে আসতেই বিশ্ব জুড়ে শোরগোল ওঠে। বিবৃতি দেয় ফেসবুকও। তার এক মাসের মধ্যেই ক্রাইস্টচার্চের ঘটনা।

ইন্টারনেটে থাকা কোনও ভিডিয়ো অন্য কোনও ভুয়ো নামে, অন্য জায়গার বলে আপলোড করলে তা পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখে বোঝার একাধিক উপায় রয়েছে। কিন্তু সরাসরি কোনও কিছু সম্প্রচার করা হলে তা বেঁধে দেওয়া ছকের বাইরে গিয়ে যন্ত্র-মেধার পক্ষে বিচার করা যে কার্যত অসম্ভব, তা বার বার প্রমাণ হয়েছে। ফেসবুক লাইভ করে বিশ্বে একাধিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। নিউজ়িল্যান্ডের ঘটনা সেই তালিকায় নবতম সংযোজন।

কেবল ফেসবুক নয়, একই জিনিস প্রযোজ্য গুগলের ইউটিউবের ক্ষেত্রেও। দুটি ক্ষেত্রেই সরাসরি সম্প্রচার অর্থাৎ লাইভে কনটেন্ট বিচার করা যন্ত্র-মেধার হাতে ছাড়লে বিপত্তির সম্ভাবনা রয়েছে যথেষ্ট। কেবল ভিডিয়োই নয়, এমন লাইভ ভিডিয়ো চলাকালীন, তার তলায় সঙ্গে সঙ্গে কমেন্টও করতে থাকেন অসংখ্য মানুষ। তার মধ্যে অনেক সময়ই ঘৃণা, বিদ্বেষমূলক কমেন্ট করার জন্য বাঁধা বাহিনীও তৈরি থাকে। কিন্তু কেবল যন্ত্র-মেধা দিয়ে তা আটকানো অসম্ভব।

একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। ধরা যাক, ফেসবুক বা ইউটিউবে রাজনীতি নিয়ে কেউ লাইভ বক্তব্য রাখছেন। সেই ভিডিয়োর তলায় দলে দলে তাঁকে বিদ্বেষমূলক কথা বলে আক্রমণ করা হচ্ছে। যন্ত্র-মেধার মাধ্যমে ওই সব বাক্যের কয়েকটি শব্দ বা গোটা কয়েকটি বাক্যকে আটকানো যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সমস্যা হল, ওই সমস্ত শব্দ দিয়ে কেউ ইতিবাচক কমেন্টও করতে পারবেন না। আবার বাক্য গঠনের হেরফের করে ফের আক্রমণ শানাতে পারে সাইবার-দস্যুরা।

কেবল যন্ত্রই নয়, এর ভয়াবহ কুপ্রভাব রয়েছে মানব-মননের উপরেও। পাবজির মতো বন্দুকবাজির খেলা ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ায় নকল গুলিগোলা-হিংসার দৃশ্যের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের ইন্দ্রিয়, চেতনা। কারণ তার কাছে এই ছবি খুবই স্বাভাবিক, এই আর্তনাদ বড় দৈনন্দিন। কারণ সেই মন এই গুলির শব্দ শোনে পরিজনের মোবাইলে, কৃত্রিম যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি দেখে বাড়ির কম্পিউটারের পর্দায়। তার কাছে এই হিংসা চেনা। কারণ সে জানে এটা তো বাস্তব নয়, এটা খেলা। তাই বাস্তব যখন অবিকল ভুয়ো যুদ্ধের রূপ নিয়ে আসে, তখন আমরা আর শিউরে উঠি না। কারণ আমাদের সেই অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গিয়েছে দৈনন্দিন যুদ্ধবাজির অনুশীলনে। সম্প্রতি দেশ জুড়ে যে যুদ্ধ-জিগির উঠেছিল তা সেই মানসিকতারই আদর্শ উদাহরণ বলা যেতে পারে।

আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও প্রাসঙ্গিক। পাবজি-নেশা রুখতে ইতিমধ্যেই গুজরাতে সে খেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তার পরেও ক’দিন আগেই পাবজি খেলতে থাকা দশ জন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সংবাদমাধ্যমকে পুলিশ জানায়, তারা ওই খেলায় এতটাই বুঁদ হয়েছিল যে পুলিশ যে আসছে, সেটাও তারা খেয়াল করেনি।

অন্য নানা বিপদের সম্ভাবনাও ভয়ঙ্কর বেশি। কারণ দেশের মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর বেশির ভাগ অংশেরই সেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে হাতের মুঠোয় আসা তথ্য যাচাই করার মানসিকতা নেই। তাই তো শিশু-পাচার রুখতে পাকিস্তানের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তৈরি করা ভিডিয়ো ব্যবহার করে এ দেশের গ্রামেগঞ্জে হিংসা, গুজব ছড়ানো হয়। তার জেরে পর পর গণপিটুনিতে প্রাণ যায়। সার্জিকাল স্ট্রাইকের ভিডিয়ো বলে ছড়িয়ে পড়ে কম্পিউটার গেম থেকে তৈরি করা ভুয়ো ভিডিয়ো।

নিউজ়িল্যান্ডের ভিডিয়ো যে ভাবে ছড়িয়েছে তার মধ্যেও এমন অনাহূত আশঙ্কার বীজ লুকিয়ে রয়েছে। ওই ভিডিয়ো অনেকেই দেখেননি। তাই অন্য কোনও ঘটনার ভিডিয়ো বলে, আসল ভিডিয়োর উপরে অন্য কোনও কারিকুরি করে, অন্য কোনও ভিডিয়ো জুড়ে, বা কোনও কথা জুড়ে তা ছড়িয়ে দেওয়া হতে পারে। তেমন ভুয়ো ভিডিয়ো নিয়ে কখনও কোথাও হিংসা-ঘৃণার বার্তা ছড়ানো হবে না তো? ভাবতে ভয় হয়।

যন্ত্র-মেধা নয়, মানবিক মনন ছাড়া এই লুকিয়ে থাকা দৈত্যকে রোখা সম্ভব নয়। তাকে রুখতে যন্ত্র-মেধার উপরে ভরসা না করে মানব-মস্তিষ্কের নজরদারি বাড়াতে হবে। সেই লড়াইয়ে হাতিয়ার হোক যুক্তি, বুদ্ধি, মানবিকতা। কারণ আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে মানব মস্তিষ্কের দুর্বুদ্ধির সঙ্গেই, যন্ত্রের সঙ্গে নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE