Advertisement
১১ মে ২০২৪

খুশির ইদ পালনেও বদলের ছবি

কাজের খোঁজে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দেওয়া পুরুষের দল বাড়ি ফিরছে ইদের আনন্দ পরিবারের সঙ্গে ভাগ করে নিতে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে স্ত্রী-সন্তানের জন্য, মা বাবার জন্য নতুন পোশাক। নিজের শৈশব-কৈশোরে মা-বাবার যে ম্লান মুখ দেখেছেন তাঁরা, সেখান থেকে মুক্তি পেতেই তাঁদের ওই প্রাণপণ সংগ্রাম। লিখলেন নাসিম এ আলম।অস্বীকার করা যাবে না যে, মুসলিম সমাজে শিক্ষিত যুবক-যুবতীর সংখ্যাও বেড়েছে অনেকগুণ। তাঁরা অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য পাওয়ার পরে সংস্কৃতি মনস্ক হতে চাইছেন।

ইদের বেশ কিছু দিন আগে থেকেই ঘরে ফেরার পালা। নিজস্ব চিত্র

ইদের বেশ কিছু দিন আগে থেকেই ঘরে ফেরার পালা। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৯ ১০:৫৩
Share: Save:

এক মাস সারাদিন উপবাস করে, রমজান পালন করে তবেই এমন এক দিন অর্জন করতে হয়। খুশির ইদ আসে। নতুন পোশাক পরে সকাল থেকে ইদগাহে সব বয়েসের মানুষের ভিড়, ইদের নমাজ পড়া। অতঃপর আত্মীয়, প্রতিবেশীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়। সারাদিন চলে মিষ্টিমুখ। তারপরে কাছে-দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া।

একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের প্রান্ত সীমায় পৌঁছে ইদের যে ছবি দেখতে পাচ্ছি, বিগত তিন বা চার দশক আগের ছবিটা এমন ছিল না।

এখন মুসলমান সমাজ কিছুটা অর্থনৈতিক সাফল্যের মুখ দেখেছে। পুরনো দিনে অনেক গরিব পরিবার এক বেলা খেয়ে অন্য বেলা খাবারের জোগাড় করতে পারত না। দু’বেলা পেটপুরে খাওয়াটাই যেখানে স্বপ্নের, সেখানে ভাল পোশাক কেনা কিংবা উৎসব অনুষ্ঠানে ভাল খাওয়া-দাওয়া করা একটা অধরা বিলাসিতা। এর পরে রয়েছে প্রসাধনসামগ্রী। অন্তত দামি সাবান তেল ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গের অন্য জেলার সঙ্গে বীরভূমের ছবিটা কার্যত একই রকম। ভারতবর্ষের অন্য রাজ্যগুলির সঙ্গে ছবিটা তাই এক রকম ভাবে মেলে না। তার কারণ দু’বার দু’টি ভিন্ন অভিজ্ঞতা বাঙালি মুসলমান সমাজকে প্রভাবিত করেছে। প্রথমবার ১৯৪৭-এর দেশভাগ, পরবর্তী ক্ষেত্রে ১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। দুই বারই শিক্ষিত মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশ ও-পারে পাড়ি জমিয়েছিলেন। এখানে যাঁরা রইলেন, তাঁদের বড় অংশই অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত এবং দরিদ্র শ্রেণির মানুষ, মূলত শ্রমজীবী।

অর্থনৈতিক দারিদ্রতা থাকলে উৎসবের জন্য বিলাসিতা করা সম্ভব হয় না। এই ছবিটা মুরারই, রাজগ্রাম, রাজনগর, মহম্মদবাজার কিংবা লাভপুর, নানুর— সর্বত্র প্রায় একই ছিল অন্তত দু-তিন দশক আগে। শহরাঞ্চলে দু-চারটি বর্ধিষ্ণু পরিবার থাকলেও বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে অভাবি মানুষের সংখ্যাই বেশি। অতএব পুরনো শাড়ি, পাজামা, পাঞ্জাবি, প্যান্ট পরিষ্কার করে উৎসবের দিনটা চালিয়ে নিতে হতো। খাওয়া-দাওয়ারও তেমন কোনও বিলাসিতা চোখে পড়ত না। দূর গ্রামের দিকে বছর চল্লিশ আগেও পুকুরে স্নানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মাথায় শ্যাম্পু-সাবান দেওয়া তো দূরের কথা, কখনও সস্তা কাপড় কাচা সাবান, এমনকি মাটি ঘষে মাথার ময়লা পরিষ্কার করতেন। গ্রামবাংলার এই ছবি নজর এড়িয়ে যায়নি ঔপন্যাসিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজেরও।

পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টেছে বিগত দুই দশকে। পঞ্চায়েত স্তরে বার্ধক্য ভাতা, বিভিন্ন আবাস যোজনার ঘর, স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি হওয়ার ফলে সংখ্যালঘু সমাজ কিছুটা হলেও আর্থিক স্বাচ্ছল্যের মুখ দেখেছে। সঙ্গে রয়েছে পরিশ্রম করার ক্ষমতা। দু’বার ধান হওয়ার ফলে কৃষিতে সাফল্য এসেছে। আবার চাষের সময় ছাড়া বছরের অন্য সময় যুবকেরা রাজমিস্ত্রির কাজ নিয়ে চলে যাচ্ছে ওড়িশা, চেন্নাই। কেউ কারখানার শ্রমিক হিসেবে দিল্লি বা দেশের অন্যত্র। বীরভূমগামী ট্রেনে ইদের পনেরো দিন আগে থেকেই মানুষের ঢল। কাজের খোঁজে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দেওয়া পুরুষের দল বাড়ি ফিরছে ইদের আনন্দ পরিবারের সঙ্গে ভাগ করে নিতে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে স্ত্রী-সন্তানের জন্য, মা বাবার জন্য নতুন পোশাক। নিজের শৈশব-কৈশোরে মা-বাবার যে ম্লান মুখ দেখেছেন তাঁরা, সেখান থেকে মুক্তি পেতেই তাঁদের ওই প্রাণপণ সংগ্রাম।

অস্বীকার করা যাবে না যে, মুসলিম সমাজে শিক্ষিত যুবক-যুবতীর সংখ্যাও বেড়েছে অনেকগুণ। তাঁরা অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য পাওয়ার পরে সংস্কৃতি মনস্ক হতে চাইছেন। ফলে পুরনো দিনের ইদ উৎসব পালনের সঙ্গে আজকের তফাতটাও চোখে পড়ছে। এখন গ্রামে গ্রামে ইদ উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় সিউড়ি, রামপুরহাট, মাড়গ্রাম বা অন্যত্র। সেখানে নজরুল ইসলামের কবিতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, সুকান্তের কবিতাও আবৃত্তি করা হয়। স্কুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কুইজ় কনটেস্ট, তাৎক্ষণিক বক্তৃতায় অংশ নেয়।

ইদ পালনে বদলের প্রসঙ্গে মেয়েদের নমাজের কথা এসে যায়। এটি মেয়েদের সচেতনতা বৃদ্ধির একটা উল্লেখযোগ্য দিক। বিগত দশ বছরে সংবাদপত্র খুললে মুরারই, নলহাটি বা কীর্ণাহার সংলগ্ন গ্রামে ইদের দিন মেয়েদের আলাদা ভাবে জমায়েত করে নমাজ পড়ার সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। যদিও মেয়েদের ইদের নমাজের ইতিহাসটি আরও প্রাচীন। এর সূচনা হয়েছিল ১৯৭০ বা ’৭১ সালে কীর্ণাহার সংলগ্ন গ্রাম নিমড়ায়। প্রবীণ সাহিত্য সাধক এম আব্দুর রহমানের মেজো মেয়ে ফাতেমা খাতুন সেই নমাজ পরিচালনা করতেন। গ্রামের অন্য মেয়েরা সমেত রহমান সাহেবের পাঁচ মেয়ে তখন শিক্ষিত হয়েছেন। শুধু কি তাই, সাতের দশকের গ্রামের কিছু উৎসাহী মেয়েকে নিজ উদ্যোগে বাংলা ও আরবি পড়াতেন ফাতেমা। তখনও সাক্ষরতা অভিযান শুরু হয়নি। গ্রামে গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল না অথচ শিক্ষার আগ্রহে আড়ালে থেকে ফাতেমা কী নিদারুণ সংগ্রাম করেছেন কয়েক জন আলোকবর্তিনীকে সঙ্গে নিয়ে।

সুগন্ধি আতর ব্যবহার করা ইদের প্রচলিত রীতি। ইদানীং আতরের জায়গা নিচ্ছে দামি পারফিউম। পোলাও-মাংসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিরিয়ানি। থাকে নানাবিধ মিষ্টি, পরোটা। সারাদিনের উৎসবে আত্মীয় প্রতিবেশীরা আসেন, নিমন্ত্রণ থাকে প্রতিবেশী সংখ্যাগুরু সমাজের মানুষজনের। শিক্ষার প্রচলন বেড়েছে, বেড়েছে দুই সমাজের মেলামেশা ও কাছাকাছি আসা।

ইদের আনন্দের সঙ্গে সমানুপাতিক ভাবে জড়িত ইদের সাহিত্য। স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে অনেক পত্রিকা ইদ সংখ্যা প্রকাশ করত। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সওগাত’। লিখতেন সাহিত্য সাধক এম আব্দুর রহমান। তাঁর সৃজনশীল গদ্য ইদে সংখ্যাতেও যত্নের সঙ্গে ছাপা হত। স্বাধীনতার পরে সাড়া জাগিয়ে প্রকাশিত হত ‘কাফেলা’। সম্পাদক আব্দুল আজিজ আল আমান। কাফেলায় থাকত উপন্যাস, কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, প্রবন্ধ। কাফেলার ইদ সংখ্যায় সম্মানের সঙ্গে প্রকাশিত হত বীরভূমের আব্দুর রকিবের উপন্যাস, ছোটগল্প। কবিরুল ইসলামের কবিতাও উল্লেখ করার মতো বিষয় ছিল। লিখতেন ছোটগল্পকার এ মান্নান এবং আবু আতাহার। কর্মসূত্রে যাঁরা বাইরে থাকতেন, ইদে বাড়ি আসার সময় সংগ্রহ করে আনতেন ‘কাফেলা’। কেউ কেউ ‘মিযান’, ‘দামাল’ প্রভৃতি। এই পত্রিকাগুলিও মননশীল ইদ সংখ্যা প্রকাশ করত।

বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক রেজাউল করিম কর্মসূত্রে থাকতেন বহরমপুরে। শৈশব-কৈশোরে জন্মভূমি মাড়গ্রামে যে আনন্দের সঙ্গে ইদ উৎসব পালন করতেন, তা ইদের দিন স্মৃতিচারণা করতেন রেজাউল। একই ভাবে স্মৃতিমগ্ন হতেন বিজ্ঞানী কুদরত-ই-খুদা, ঢাকার বাসভবনে বসে কৈশোরে মাড়গ্রামের ইদের দিনগুলির কথা বলতেন সহকর্মী বন্ধু-বান্ধবদের।

তাই তো বলা ইদ উৎসব খুশির উৎসব। প্রার্থনা করি, এই খুশি সমাজের সকল মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক। শান্তি বজায় থাকুক গ্রাম ও শহরে। আজকের ‘বদলে’ যাওয়া যুগে শান্তি যে বড্ড জরুরি!

(লেখক সাহিত্যকর্মী, মতামত নিজস্ব)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Eid Eid Celebration Religious Festival ঈদ
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE