Advertisement
E-Paper

সিন্ধুবালা: একটি ঢেউয়ের নাম

পুরুলিয়ার দিকে দিকে সিন্ধুবালার নামে লোক উৎসবের মঞ্চ হচ্ছে। সভা হচ্ছে মাঝেমধ্যে। যদি কোনও দিন সরকারি ভাবে শিল্পীর মহাপ্রয়াণের দিনটি ‘ঝুমুর দিবস’ হিসেবে ঘোষিত হয়, তা হলে শিল্পী ও শিল্প উভয়েই আরও সম্মানিত হবে। অনুরোধ জানালেন তপন পাত্রদেহ-মন আওলানো ঝুমুরের সুরে আর ঢোল, লাগড়া, কর্তাল, সানাইয়ের তালে নাচনি এবং তাঁর রসিক মাতিয়ে বেড়ালেন সারা মানভূম।

শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৯ ০০:১৩
সিন্ধুবালা দেবী। ফাইল চিত্র

সিন্ধুবালা দেবী। ফাইল চিত্র

বারো বছর বয়সে ঘরছাড়া। বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে গৃহস্থ বাড়ির দরজা তাঁর জন্য বন্ধ। সামনে পেলেন নাচনি জীবনের অবারিত দ্বার। ভাবলেন, এ পথেই যদি এগিয়ে যাওয়া যায়! রসিক ‘চ্যাপা’র নাচনি হিসেবে শুরু হল তাঁর পথচলা। শেষ হল লোকসঙ্গীত চর্চাকেন্দ্র ‘সিন্ধু সঙ্গীতালয়ে’।

যাঁর কথা বললাম, তাঁর নাম সিন্ধুবালা। তবে রাঢ়ভূমে তিনি পরিচিত ‘চ্যাপার নাচনি’ হিসেবে। বান্দোয়ান থানার শাল-পলাশ-মহুয়া ঘেরা মাঘলা গ্রামে ১৯১২ সালে জন্ম হয়েছিল সিন্ধুর। মায়ের নাম রমণ মাঝি। বাবা গৌর মাঝি। প্রথম তালিম নেওয়া গৌরচন্দ্র কুইরির কাছে। রসিক ছিলেন পুরুলিয়ার বরাবাজার থানার ছোট গ্রাম গুঢ়াডাঙের মহেশ্বর মাহাতো। ডাক নাম চ্যাপা। ক্রমে সিন্ধুবালার এক এবং অদ্বিতীয় পরিচয় হয়ে উঠেছিল ‘চ্যাপার নাচনি’।

দেহ-মন আওলানো ঝুমুরের সুরে আর ঢোল, লাগড়া, কর্তাল, সানাইয়ের তালে নাচনি এবং তাঁর রসিক মাতিয়ে বেড়ালেন সারা মানভূম। যেখানেই উৎসব, গাজন, মেলা সেখানেই সিন্ধুবালা। বামুনডিহা, হুলহুলি, কাঁটাডি, শুকলাড়া যেখানেই নতুন হাটের সূচনা সেখানেই উদ্বোধনী নৃত্যে সিন্ধুবালা। মুক্তমঞ্চে সিন্ধুর গানের তান আর নৃত্যের সুচারু ভঙ্গিতে উপস্থিত দর্শকের মন আনন্দে পূর্ণ হয়ে যেত।

এক দিন কাশীপুরের রাজা জনার্দনকিশোর সিংহ দেওয়ের গ্রামের সাপ্তাহিক হাট উদ্বোধনের জন্য ডাক পড়ল সিন্ধুবালার। তাঁর গানের সুরে আর নাচের ছন্দে রাজা বিমুগ্ধ, বিস্মিত। বেনারস থেকে যে সব বাই আসতেন রাজদরবারে, সেই শিরোমণি, ফুলকুমারি, আশালতা, বেগমতাজ, পটলি, রাজলক্ষ্মীদের নাচেগানে ছাপিয়ে গেলেন সিন্ধুবালা। নাচলেন কমলা ঝরিয়ার সঙ্গে একই মঞ্চে। রাজার পরামর্শ অনুসারে ঢোল, ধামসা বাদ দিয়ে শ্রীবৃদ্ধির জন্য সংযোজিত হল বেহালা, এসরাজ, বাঁশি, ডুগি তবলা, জুড়ি-নাগড়া। সিন্ধুবালার নাচগানের আসরে বিভিন্ন সময় উপস্থিত থেকেছেন বরাবাজারের ভোলানাথ দাস, রঘুনাথপুরের বৈদ্যনাথ সেন, মানবাজারের যদুনাথনারায়ণ দেব, ব্যোমকেশ গঙ্গোপাধ্যায়, বড়জোড়ার গৌরবাবু, বেনারসের চন্দ্রমোহন-সহ অনেক বিখ্যাত গায়ক, বংশীবাদক এবং তবলা-শিল্পী।

সে সময় অন্য কোথাও নৃত্য প্রদর্শন করতে হলে রাজার অনুমতি নিতে হত। তবে সিন্ধুবালার ক্ষেত্রে ছাড় ছিল। বিহারের জরিয়াগড়, বনয়, ওড়িশার বামড়া, বারিপদা, সনপুর, খরসনা প্রভৃতি জায়গায় রাজবাড়ির বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে সিন্ধুবালা বাধা পেতেন না। নাচ ছাড়া, ঠুংরি আর ভজন গানের অনুষ্ঠানও করতে শুরু করলেন পরে।

ক্রমে ইতিহাসের পালাবদল হল, ভারতের মানচিত্র থেকে মুছে গেল মানভূম। কিন্তু সিন্ধুবালার নাচের গতি থামল না। বাংলা-বিহার-ওড়িশা যেখানেই বিশেষ গাজন মেলা সেখানেই সিন্ধুবালা। ১৯৬০ সালে হঠাৎ মারা গেলেন চ্যাপা মাহাতো। এক বছরের মতো নাচ-গান সব স্তব্ধ। পুনরায় শুরু হল নাচ, চ্যাপার ভাইপো হৃষীকেশ মাহাতোর তত্ত্বাবধানে। একে একে প্রশিক্ষণ নিতে এলেন মাঝিহিড়ার গীতারানি, আড়শা থানার সটরা গ্রামের বিমলা দেবী, রাজ খরসনার মালাবতী। এলেন ধানবাদ এসএসএলএনটি মহিলা মহাবিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের অধ্যাপিকা বীণাপাণি মাহাতো।

১৯৮২ সালে শুরু হল পুরস্কার, সংবর্ধনার পালা। ১৯৮২ ও ১৯৮৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ লোকসংস্কৃতি উৎসবে যোগদান করে সম্মানিত হন সিন্ধুবালা। ১৯৮৬ সালে হুটমুড়া হাইস্কুলের হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল নুরুল হাসান তাঁর হাতে পুরস্কার ও মানপত্র তুলে দেন। ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারীদিবসের দিন ‘মুক্তধারা’ শিল্পীকে সম্মানিত করে। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮৭-৮৮ সালের লোকসঙ্গীতে অ্যাকাডেমি সম্মান দেয় সিন্ধুবালাকে।

১৯৯৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ তাঁর হাতে তুলে দিল লালন পুরস্কার। ১৯৯৫ সালের ২৭ মে তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেন শিশির মঞ্চে। ওই বছরই বর্ধমানের শোধপুর সম্মেলনী তাঁকে ‘চামু পুরস্কার ১৯৯৫’-এ সম্মানিত করে।

২০০৩ সালেও ৯২ বছরের সিন্ধুবালা যেন তরতাজা বালিকা। পুরুলিয়া থেকে বরাবাজার টকরিয়া বাস স্টপেজে নেমে পশ্চিমমুখে হাঁটলেই ধানাড়া গ্রাম। তার পরে ভালুকডুংরি, শেষে কেন্দরি, প্রায় চার কিলোমিটার রাঙামাটির পথ। ছোট্ট গ্রামটিতে সাজানো গোছানো লোকসঙ্গীত চর্চাকেন্দ্র ‘সিন্ধু সঙ্গীতালয়’, হৃষীকেশের বাড়ির ঘেরা পাঁচিলের মধ্যেই।

সেখানেই আপন ছন্দে মাতোয়ারা সিন্ধু প্রাণ ঢেলে শিখিয়ে চলতেন গান আর নাচ। একের পরে এক শিল্পীকে। নাচনি নাচ আর ঝুমুর গান আয়ত্ত করা কি খুবই জটিল? এ জন্য শিল্পীর কী প্রয়োজন— প্রশ্ন করলে সিন্ধুবালা গেয়ে উঠতেন রাই রাজেনের লেখা একটি ঝুমুর গানের দু’চার কলি—

‘সুর স্বর তাল মান লয় ভাব রসজ্ঞান

রাগ রাগিনী আছে ভারী।

গলার স্বর চাই মিষ্টি, চাই

ভাবভঙ্গি দৃষ্টি

সমমাত্রা চাই বরাবরই

ঝুমুর গাওয়া বড়ি ঝকমারি...’

সিন্ধুবালা ২০০৪ সালে

৫ জানুয়ারি চিরবিদায় নিয়েছেন। পুরুলিয়ার দিকে দিকে তাঁর নামে লোক উৎসবের মঞ্চ হচ্ছে। সভা হচ্ছে মাঝেমধ্যে। যদি কোনও দিন সরকারি ভাবে শিল্পীর মহাপ্রয়াণের দিনটি ‘ঝুমুর দিবস’ হিসেবে ঘোষিত হয়, তা হলে শিল্পী ও শিল্প উভয়েই আরও সম্মানিত হবে।

লেখক মানভূমের লোকসংস্কৃতি গবেষক

Purulia Jhumur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy