Advertisement
০৪ মে ২০২৪

গ্রামবাংলার কাজের ঢেঁকি

ঢেঁকি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে শস্য ভাঙার একটি শিল্পস্বরূপ। আশার কথা, বর্তমানে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার বিভিন্ন গ্রামে মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর হাত ধরে আবার ঢেঁকি ও ঢেঁকির ব্যবহার ফিরে আসছে। ঢেঁকির ইতিহাস ও বর্তমান নিয়ে লিখছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ভারী দীর্ঘ এক কাঠের খণ্ডের আগায় তিন-চার ফুট লম্বা একটি কাঠের লম্বা টুকরো মাটিতে তৈরি করা একটি গর্তের সোজাসুজি লাগানো হত।

ঢেঁকিতে চাল গুঁড়োনো হচ্ছে চাল। ফাইল চিত্র

ঢেঁকিতে চাল গুঁড়োনো হচ্ছে চাল। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৯ ০৩:১০
Share: Save:

কথায় বলে ‘ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে’। পুরাণেও দেবর্ষি নারদের বাহন হিসেবে ঢেঁকির উল্লেখ পাওয়া যায়। আর অকর্মণ্য, অকেজো মানুষদের ‘অকম্মার ঢেঁকি’ বলার রেওয়াজ তো রয়েছেই। যদিও একটা সময় এই ঢেঁকিই ছিল বাংলার গ্রাম্যজীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। ঢেঁকিশালে ঢেঁকির সুখনিদ্রার জো ছিল না। দিনভর কৃষিনির্ভর গ্রামের মহিলা-পুরুষেরা গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে পালা করে ঢেঁকিতে ‘পাহার’ দিয়ে ধান থেকে চাল ছাড়া, বিভিন্ন শস্যও কুটতেন। ঢেঁকির শব্দে মুখরিত হত এপাড়া-ওপাড়া। নিতান্ত সাধারণ এই যন্ত্রটি এক সময়ে খুব বিপদের কারণ বলেও চিহ্নিত হত। আগে গ্রামগঞ্জে অনেক বাড়িতে ডাকাতেরা ‘ঢেঁকি’ দিয়ে দরজা ভেঙেছে, এমন খবর প্রায়ই শোনা যেত।

সাধারণত মহুয়া, শাল, বাবলা, জাম, কাঁঠাল প্রভৃতি শক্ত কাঠ দিয়ে ঢেঁকি তৈরি করা হত। মোটা, ভারী দীর্ঘ এক কাঠের খণ্ডের আগায় তিন-চার ফুট লম্বা একটি কাঠের লম্বা টুকরো মাটিতে তৈরি করা একটি গর্তের সোজাসুজি লাগানো হত। কাঠের টুকরোর আগায় একটি লোহার বেড় পরানো অংশ থাকত। একে বলা হত ‘মুষল’। আর মাটিতে তৈরি গর্তটিকে বলে ‘গড়’। প্রবাদ আছে ‘ঢেঁকি যতই মাথা নাড়ুক গড়ে তাকে পড়তেই হবে’। মূল ঢেঁকিটিকে পাথরের বা কাঠের চাপানে বসানো হত। ঢেঁকির পিছনে এক বা একের বেশি মানুষ পায়ে চাপ দিলেই ঢেঁকি ওঠা-নামা করে। এই পদ্ধতিকে বাঁকুড়া পুরুলিয়ার মানুষজন ‘পাহার’ দেওয়া বলেন। ঢেঁকির ওঠানামার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এক জন গড়ের মধ্যে শস্য ফেলতেন।

বর্ষা ছাড়া অন্য সময়ে ঢেঁকি ঢেঁকিশালেই থাকত। বর্ষায় তা ঢেঁকিশালের মাথার মাচায় বা অন্য কোনও নিরাপদ জায়গায় যত্নে তুলে রাখা হত। কারণ, বর্ষায় ‘গড়ে’ বৃষ্টির জল ঢুকে গড়কে কর্দমাক্ত ও নোংরা করে দেয়।

বাংলার লোকজীবনের অঙ্গ ঢেঁকি বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পরিবারের বিবাহ ইত্যাদি উৎসবেরও জানান দিত। অধিকাংশ হিন্দু পরিবারে বিবাহের দিন ‘ঢেঁকি মঙ্গলা’ নামে ‘ঢেঁকি’ পুজো পেত। ঢেঁকিতে হলুদ-জিরে-ধনে-তেজপাতা-লঙ্কা কুটনোর ব্যস্ততা নজরে পড়ত আগেভাগেই। যাঁরা এই ব্যস্ততায় ঢেঁকিতে মশলা কুটে হাতে হলুদ রাঙিয়ে কুলো বা ঝুড়িতে যত্নে ঘরে তুলে রাখতেন, বুঝতে হত তাঁদের বাড়িতে ‘বড় কাজ’ লেগেছে। মশলা কোটার গন্ধে পাড়া ম-ম করত।

রাঢ়বঙ্গে ‘পিঠে পরব’ লোকসংস্কৃতির এক অনন্য উৎসব। অগ্রহায়ণের সংক্রান্তিতে ‘এস্কা পিঠে’ ও পৌষের মকর সংক্রান্তিতে ‘পুলিপিঠে’ (স্থানীয় নাম ‘ভাপা’ পিঠে বা ‘গড়গড়িয়া’ পিঠে), দুর্গাপুজোয় ‘গুড় পিঠে’-র চল এখনও রয়েছে। তবে ঢেঁকির জায়গা নিয়েছে যন্ত্র। যদিও দক্ষিণ বাঁকুড়ার বহু স্থানে আজও পিঠে তৈরির প্রয়োজনীয় চালগুঁড়ি ঢেঁকিতেই ভানা হয়।

বিংশ শতকের মাঝামাঝিরও কিছু পরে বাজারে ‘গুঁড়ো মশলা’ এতটা আসেনি। কেনা চাল সে সময়ে কেউ খেতে পছন্দ করতেন না। ঢেঁকিছাটা চালই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ খেতেন। ‘বাবুদের’ বাড়ির নিজস্ব ঢেঁকিছাটা চালের ভাত তখন বাবুদেরও পাতে পড়ত। জমিদার বা সমর্থ বিত্তবানেরা বাড়ির উৎসবে ঢেঁকিছাটা চালের ভাত খাওয়াতেন। সে কারণে তাঁরা আগেভাগেই পরিমাণমতো ধান চাল করবার জন্য কাউকে না কাউকে ‘ভাচা’ (বরাত) দিতেন। একটা সময়ে ‘থানাভর নিমন্ত্রণ’ ব্যবস্থা বলে একটি ব্যবস্থা চালু ছিল। রাস উৎসব, দুর্গোৎসব, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, দোল বা কোনও আশ্রমিক উৎসব (‌মোচ্ছব)-এ দেদার থানাভর লোকজন খাওয়ানোর রীতি ছিল। এ ব্যবস্থা এখনও উঠে যায়নি। বরং কোনও কোনও স্থানে মোচ্ছব এখন আরও জাঁকিয়ে হচ্ছে। পার্থক্য শুধু এই যে, ঢেঁকিছাঁটা চালের জায়গা নিয়েছে মিলের চাল।

ষাট-সত্তরের দশকের সেই ঢেঁকিশাল আজ প্রায় উধাও। ঢেঁকিশাল আজ রূপান্তরিত হয়েছে আধুনিক রান্নাঘরে। কেরোসিন, ডিজেল, বিদ্যুৎচালিত ধান ভাঙা ‘কল’ যত বসেছে, ততই ঢেঁকি অস্তিত্ব হারিয়েছে। মেলা-গাজনে কিনতে পাওয়া খেলনা-ঢেঁকিও এখন মেলে না। উধাও হয়ে গিয়েছে ঢেঁকিছাটা চালের পান্তাভাত, আমানিজল, মাড়ভাত প্রভৃতি সুস্বাদু খাবারও। তবে ঢেঁকি নিয়ে রামপ্রসাদী গান, সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’ বইয়ের ছড়া, পুরুলিয়া-বাঁকুড়া জুড়ে ‘ঢেঁকি গান’ আজও সমান জনপ্রিয়।

ঢেঁকি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে শস্য ভাঙার একটি শিল্পস্বরূপ। আশার কথা, বর্তমানে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার বিভিন্ন গ্রামে মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর হাত ধরে আবার ঢেঁকি ও ঢেঁকির ব্যবহার ফিরে আসছে। আবার ঢেঁকিতে ভাঙা চালগুঁড়ো, ছাতু বিভিন্ন সমবায় ও বড় বড় দোকানে বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে ঢেঁকিতে তৈরি নানা দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে। এতে ঢেঁকির পুনরাগমনের সম্ভাবনা যে উঁকি দিচ্ছে, তা বলাই যায়।

লেখক বাঁকুড়া বন দফতরের প্রধান করণিক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Husking Pedal ঢেঁকি Village Households
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE