নিতিন গডকরী।
মানুষকে যাঁহারা স্বপ্ন দেখান, মানুষ তাঁহাদের পছন্দ করেন, কিন্তু স্বপ্নপূরণ না হইলে লোকে (বিরূপ হইয়া) তাঁহাদের মারিতেও পারে।— অপ্রিয় সত্যটি উচ্চারণ করিয়াছেন কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী ও বিজেপির প্রবীণ নেতা নিতিন গডকরী। কথাটি নূতন নহে। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝিয়া বলিলে পুরানো কথাও মোক্ষম হইয়া উঠিতে পারে। সহকর্মীর মন্তব্যটি প্রধানমন্ত্রীর গায়ে বাজিলে বিস্ময়ের কিছু নাই। ২০১৪ সালে নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদী ছিলেন স্বপ্নের সওদাগর। ‘ন্যূনতম সরকার, সর্বাধিক প্রশাসন’-এর মোড়কে রকমারি প্রতিশ্রুতি পুরিয়া তিনি তথা তাঁহার প্রচার-ম্যানেজাররা ভোটের বাজারে বিতরণ করিয়াছিলেন। মানিতেই হইবে, সেই উদ্যোগ সফল হইয়াছিল। অনুমান করা যায়, দেশের বহু মানুষ তাঁহার প্রদর্শিত স্বপ্নে, বিভোর না হউন, ভরসা রাখিয়াছিলেন। সাফল্য প্রেরণা দেয়। আরও স্বপ্ন দেখাইবার প্রেরণা। প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিবার পরেও মোদীজির স্বপ্ননির্মাণ থামে নাই, বরং তাহা নূতন মাত্রা অর্জন করে। নোট বাতিল করিয়া কালো টাকা উদ্ধার হইতে শুরু করিয়া পাঁচ বছরে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করা অবধি কত স্বর্গের সিঁড়ি যে তিনি গত সাড়ে চার বছরে বানাইয়াছেন, তাহার ইয়ত্তা নাই। বহু মানুষ হয়তো এখনও সেই সকল স্বপ্নে আস্থা রাখিয়া সুদিনের ভরসায় আছেন। কিন্তু অন্যরা? যাঁহাদের আশায় বুক বাঁধিবার ক্ষমতা অসীম নহে? যাঁহারা স্বপ্ন দেখিবার সঙ্গে সঙ্গে কিছু স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশাও পোষণ করেন?
নিতিনবাবুর কথাটি এই তারেই বাজিতেছে। প্রধানমন্ত্রীর কথা ভাবিয়াই বা তাঁহাকে নিশানা করিয়াই তিনি স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের তত্ত্ব নির্মাণ করিয়াছেন কি না, তাহা তিনিই জানেন। তবে আইনের পরিসরে যাহাকে পরিস্থিতিগত সাক্ষ্যপ্রমাণ বলা হয় তাহার ভিত্তিতে তেমন অনুমান অসঙ্গত হইবে না। সরকার তথা বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারে শ্রী গডকরী প্রধানমন্ত্রীর ‘আপনজন’ বলিয়া পরিচিত নহেন, বরং তাঁহার একটি প্রতিস্পর্ধী সত্তা লইয়াই জনশ্রুতি প্রবল। লোকসভা নির্বাচনের লগ্ন আগাইয়া আসিলে সেই সত্তা প্রবলতর হইতেই পারে, বিশেষত যখন নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তায় ভাটার টানের লক্ষণ মিলিতেছে, উত্তর ও মধ্য ভারতের তিন রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন যে লক্ষণকে প্রকট করিয়া দিল। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিয়াছে, যে নায়কের অলোকসাধারণ আকর্ষণের ভরসায় বিজেপি ভোটদরিয়ায় তরি ভাসাইবে, তিনি কি তবে সামান্য লোকে পরিণত হইতেছেন? গডকরীর কথার সূত্র অনুসরণ করিলে তেমন আশঙ্কাই স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রী স্বপ্ন দেখাইয়াছিলেন, লোকে তাঁহাকে মাথায় তুলিয়াছিল। স্বপ্ন ভাঙিলে লোকে তাঁহাকে পথে নামাইয়া দিবে।
কিন্তু রাজনীতির কারবারিরা তো আজ নূতন স্বপ্ন দেখাইতে শুরু করিলেন না! নির্বাচনী প্রচারে আকাশের চাঁদ আনিয়া দিবার প্রতিশ্রুতি, তাহাও তো এই দেশে অভিনব কিছু নহে! সেই কোন সুদূর অতীতে দাদাঠাকুর গান বাঁধিয়াছিলেন— কালো গরুর দুধ দিব, দুধ খাবার বাটি দিব, ইত্যাদি! জন-অভিধানে ‘জুমলা’ শব্দটি মহামতি অমিত শাহের অবদান হইতে পারে, কিন্তু তাহার মর্মসত্য তো ভোটারের অজানা ছিল না! তবে এখন স্বপ্নভঙ্গের ব্যথা অধিক বাজিবার আশঙ্কা কেন? তাহার কারণ, সম্ভবত, নিউটনের তৃতীয় সূত্র। শোনা যায়, নরেন্দ্র মোদী গুজরাত কাণ্ডের পরে এই সূত্রটির উল্লেখ করিয়াছিলেন। সেই ইতিহাসের কথা থাকুক। কিন্তু সূত্রটি অমোঘ। স্বপ্ন বলা হউক বা জুমলা, মোদীজি সেই ফানুসটি অত্যধিক ব্যবহার করিয়াছেন। আজ ফানুস চুপসাইতেছে। সুতরাং, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার নিয়মেই, তাহার প্রতিঘাত বিষম আকার ধারণের আশঙ্কা দেখা দিয়াছে। নিতিন গডকরী সেই আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছেন। হয়তো ভাবিয়া-চিন্তিয়াই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy