Advertisement
০৩ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

উপভোক্তা, না পণ্য

ফেসবুক-এর কর্ণধার মার্ক জুকেরবার্গ সংবাদপত্রে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দিয়া ক্ষমা চাহিয়াছেন, গ্রাহকের তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করিতে নিজের দায়বদ্ধতার কথা জানাইয়াছেন।

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৮ ০০:৪৮
Share: Save:

ফেসবুকের ওয়েবসাইটটি খুলিলে প্রথম যে পাতাটি আসে, সেখানে একটি ঘোষণা আছে— ফেসবুকের পরিষেবা বিনামূল্যে পাওয়া যায়, এবং চিরকাল বিনামূল্যেই মিলিবে। গোটা দুনিয়ায় প্রায় দেড়শত কোটি মানুষ নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহার করিয়া থাকেন। জানা নাই, তাঁহাদের মধ্যে কত জন অন্তত এক বার ভাবিয়াছেন, ফেসবুকের এহেন উদারতার কারণটি কী? দুনিয়া যাহাতে মজিয়া রহিয়াছে, পরিষেবার খরচ বাবদ কিছু টাকা দাবি করিলে বহু মানুষই সম্ভবত যাহা বিনা আপত্তিতে মানিয়া লইবেন, সেই পরিষেবাটি নিখরচায় দেওয়া কেন? ইহাই ‘বিনামূল্য’-এর মজা। তাহার এমনই আকর্ষণ যে অতি স্বাভাবিক প্রশ্নগুলিও হারাইয়া যায়। ফলে, এই দেড়শত কোটি ব্যবহারকারীর সিংহভাগ কখনও সন্দেহ করেন নাই, তাঁহারা ফেসবুকের উপভোক্তা নহেন। বস্তুত, তাঁহারাই পণ্য। যে তথ্য ‘একবিংশ শতকের পেট্রোলিয়ম’ নামে খ্যাতি পাইয়াছে, তাঁহারা সেই ব্যক্তিগত তথ্য নির্দ্বিধায় তুলিয়া দিতেছেন ফেসবুকের হাতে। গুগ্‌ল-এ যে পণ্যটির খোঁজ করিয়াছেন, কেন ফেসবুক খুলিলে তাহারই বিজ্ঞাপন আসে, মানুষ ভাবিয়া দেখেন নাই। ইহাই তথ্যের মাহাত্ম্য। বিজ্ঞাপনকে ব্যক্তি-স্তরে পৌঁছাইয়া দেওয়াই সোশ্যাল মিডিয়ার ‘বিপ্লব’। সেই বিজ্ঞাপন রাজনৈতিক কি না, তাহা জনৈক ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ক্ষমতায় বসাইতে পারে কি না, ভাবিয়া দেখিবার দায় ফেসবুকের নাই। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কেলেঙ্কারিটিকে এই বিন্দুতে চিহ্নিত করা বিধেয়।

ফেসবুক-এর কর্ণধার মার্ক জুকেরবার্গ সংবাদপত্রে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দিয়া ক্ষমা চাহিয়াছেন, গ্রাহকের তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করিতে নিজের দায়বদ্ধতার কথা জানাইয়াছেন। তবে, এই দফায় তথ্যের অপব্যবহার লইয়া হইচইয়ের মাত্রা এমনই বেশি যে শুষ্ক কথায় রাজনৈতিক মত না ভিজিবারই সম্ভাবনা। তথ্য ফাঁসের জন্য জরিমানা ইত্যাদিতে যদি মামলা মিটিয়া যায়, জুকেরবার্গ আপত্তি করিবেন না। কিন্তু, সেখানেই শেষ হইবার সম্ভাবনা কম। ফেসবুক ও তৎসম সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলি গ্রাহকদের তথ্য কী ভাবে ব্যবহার করিতেছে, সে বিষয়ে আইনি নজরদারি বাড়িবে, আঁচ করা চলে। স্বতন্ত্র গবেষকরা যাহাতে চাহিলে প্রক্রিয়াটির ভিতরে প্রবেশ করিতে পারেন, সেই দরজাও খোলা হইবে। অর্থাৎ, এত দিন যে পথে নেটওয়ার্কিং সাইটগুলির মূল ব্যবসা চলিত বলিয়া অভিযোগ, তাহা ক্রমেই কঠিনতর, বস্তুত অসম্ভব, হইবে। সম্ভাবনাটি ইতিমধ্যেই দানা বাঁধিতেছে। অবাধ বাণিজ্যের অধিকার হইতে ফেসবুককে যদি নিয়ন্ত্রিত সংস্থায় পরিণত করা হয়, এবং তাহার লাভযোগ্যতার ঊর্ধ্বসীমা বাঁধিয়া দেওয়া হয়, তবে একটি হিসাব বলিতেছে, সংস্থার আয় প্রায় ৮০ শতাংশ অবধি কমিয়া যাইতে পারে। কী হইবে, তাহা এখনও অনুমানের পরিসরে। কিন্তু বিপদ আসিতেছে। এবং সেই বিপদ-সলিল বহুলাংশে স্বখাত। নেটওয়ার্কগুলির ভরসা একমাত্র সাধারণ মানুষ। ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা বিষয়ে তাঁহাদের কত শতাংশ সত্যই উদ্বিগ্ন, এবং কয় জন প্রশ্নটিকে একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন হিসাবে দেখিতেছেন, সেই হিসাব এখনও মেলে নাই। রাজনৈতিক সমাজের উপর সাধারণের চাপ যদি না বাড়ে, তবেই জুকেরবার্গরা বাঁচিয়া যাইতে পারেন। অন্তত, এই দফায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Facebook Mark Zuckerberg political societies
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE