Advertisement
E-Paper

কেবল আজকের জন্য বাঁচা

শহর ও শহরতলির বাসিন্দারা অপরিসর বস্তি বা উড়ালপুলের নীচে বাসরত পরিবারে, কিংবা গাড়ির জানালায় ভিক্ষুক মহিলার কোলের শিশুটির মুখে এই অবহেলাই কি দেখেন না

শৈবাল কর

শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০

দিল্লিতে অনাহারে তিন শিশুর মৃত্যু মানুষকে আলোড়িত করেছে। কিন্তু কেন? অতি দরিদ্র পরিবারে অনাহার, অপুষ্টি, অবহেলার সংবাদ আমাদের কি বিস্মিত করে? শহর ও শহরতলির বাসিন্দারা অপরিসর বস্তি বা উড়ালপুলের নীচে বাসরত পরিবারে, কিংবা গাড়ির জানালায় ভিক্ষুক মহিলার কোলের শিশুটির মুখে এই অবহেলাই কি দেখেন না?

দেখেন। এবং অনেকেই ভাবেন, কী করে বাবা-মা এতটা উদাসীন হতে পারে শিশুর ভালমন্দ নিয়ে? কী করে এমন উচ্ছৃঙ্খল জীবন কাটাতে পারে? দারিদ্র কি মানুষকে এতই অমানবিক করে? শিশুর প্রতি অবহেলা, এবং আরও অনেক সামাজিক সমস্যার মূলে রয়েছে একটি প্রশ্ন। এক জন মানুষ তাঁর ভবিষ্যৎকে কী ভাবে দেখছেন? যাঁদের জীবনে আগামী কালের গুরুত্ব অতি সামান্য তাঁরা বিপন্ন, এবং কিছু ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে ‘ডিসকাউন্ট রেট’ বলে, তা চৈত্র সেলের রিবেট নয়, কিন্তু প্রয়োগের দিক থেকে অনেকটা একই ধরনের। সেলে দাম বাড়িয়ে জামা-কাপড়ের উপর ছাড় দেয়। সেই রকম, এক জন ব্যক্তি আজকের হিসেবে ভবিষ্যতের ‘রিবেট-দেওয়া’ দাম হিসেব করেন। কে নিজের ভবিষ্যৎকে আজকের চাইতে বেশি দামি মনে করেন, আর কার কাছে ভবিষ্যতের গুরুত্ব আজকের চাইতে কম, তা তাঁর রোজগার ও সঞ্চয়ের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে।

যাঁর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল নয়, তাঁর কাছে আজকের দিনটি আগামী কালের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে শুধু আজকের জন্য বাঁচে তার ন্যূনতম রোজগার হয়ে গেলেই আর উৎসাহ থাকে না। কোনও রিকশাচালক হয়তো সেটুকুই রোজগার করতে চান, যাতে আজ খানিকটা খাবার আর দেশি মদ হয়ে যায়। কাল বেঁচে থাকলে, এর পুনরাবৃত্তি হবে। আবার ব্যাঙ্কের সুদের হারও ঠিক করে দেয়, আগামী বিশ-ত্রিশ বছরের রোজগারের মূল্য আজকের নিরিখে কত। সুদের হার বাড়তে থাকলে ভবিষ্যৎ গুরুত্ব পায়, কমতে থাকলে বর্তমানমুখী হয়ে পড়েন মানুষ।

মনস্তাত্ত্বিক বিচারও কিন্তু ভবিষ্যতের মূল্য নির্ধারণ করে। রিকশাওয়ালার স্ত্রী হয়তো স্বপ্ন দেখেন, ছেলেমেয়ে বড় হয়ে ভাল চাকরি করবে। এঁরা অন্যের বাড়িতে কাজ করে ছেলে-মেয়েদের ইস্কুলে পাঠান। রাজ্য সরকারের কন্যাশ্রী-র মতো প্রকল্প মেয়েদের ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য এমন পরিবারকে প্রণোদিত করছে, সন্দেহ নেই।

কিন্তু নানা কারণে ভবিষ্যৎকে কম মূল্য দিতে পারেন গরিব মানুষ। দু’দশক আগে এইডসের প্রভাবে আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে মানুষ কোনও কাজ করতে চাইতেন না। অল্প দিনের মধ্যে যদি মারাই যাই, তা হলে আজ খেটে হবে কী? পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছরের মধ্যে মৃত্যু হতে পারে জানলে কে-ই বা আগামী কালের কথা ভাববে? এমন হতাশা প্রভাব ফেলে পড়াশোনাতেও। কাল চাকরি যদি না জোটে, আজ পড়ে কী হবে? সবাই তো মেধাবী নয়। মধ্যমেধার মানুষদের জীবিকার কী বন্দোবস্ত আছে? এই হতাশার ফল ফলছে মারাত্মক। বেসরকারি চাকরি পেতে গেলে দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতাই ভরসা। সরকারি কাজে অনেক সময়ে এক জন সুনিপুণ কর্মী অনেকের ত্রুটি ঢেকে দিতে পারেন। কিন্তু কঠিন বাজারব্যবস্থায় তা হবে না। ফলে দক্ষতা তৈরি না হওয়ায় কাজের জগৎ থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছেন অনেকে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, হতাশা তাঁদের ভাল জীবিকার সম্ভাবনা নষ্ট করছে।

ইদানীং শহরের রাস্তায় বাইকে চড়া, চুলে তিন রকম রং করা কিছু যুবক দেখা যায়। তাদের একাংশ রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ, সিন্ডিকেট চালায়। বাকিরা স্বতঃপ্রণোদিত নিয়মভঙ্গকারী। তারা হেলমেটহীন, তীব্র গতিতে বাইক চালায় প্রায় মৃত্যুপণ করে। আন্দাজ হয়, এদের অধিকাংশের মনে ‘আগামী কাল’ নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই। কয়েক জন বাড়ির ব্যবসায় বড়লোক হবে, হয়তো নেতাও হবে, বাকিরা প্রত্যেক দিনের জন্য বাঁচবে। এদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সুশৃঙ্খল ভাবে বাঁচার জন্য প্রণোদিত করার উপায় কী? ভারতের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প প্রাচীন লণ্ঠনের মতো। আলো কম, ধোঁয়া বেশি। সেগুলোর ভরসায় জীবনের পরিকল্পনা তৈরি করা চলে না। ‘স্কিল ইন্ডিয়া’ প্রকল্প এদের বিভিন্ন পেশায় নিয়োগের উপযুক্ত তৈরি করবে, এমন আশা করা গিয়েছিল। কার্যক্ষেত্রে লাভ হয়েছে সামান্যই।

অথচ ভারত মনে করে যে তরুণ-তরুণীদের প্রথাগত কাজে নিয়োগ করে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বাড়াবে। ষোলো থেকে পঁচিশ বছর বয়সি শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেকারত্বের হার সব থেকে বেশি। নব্বইয়ের দশক থেকে তা দশ শতাংশের নীচে নামেনি। যদিও ভারতের লেবার বুরো কখনও বলতে পারেনি বেকারদের সংখ্যা ঠিক কত। চাকরি বা পড়াশোনা, কোনওটার সঙ্গেই যুক্ত নেই কত জন, তার প্রকৃত আন্দাজ নেই। তবু ভারতের নীতি নির্ধারক মহল বিশ্বাস করে যে তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা বেড়ে গেলেই আর্থিক বৃদ্ধির জোয়ার আসবে, কারণ তারা বেশি হারে শ্রমবাজারে প্রবেশ করবে এবং রোজগার করবে। তার একটা অংশ সঞ্চয় হবে, বিনিয়োগ হবে এবং এর ফলে আর্থিক বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে।

হতে পারত, কিন্তু হচ্ছে কি? চাকরি তৈরিই হচ্ছে খুব কম। তার উপর, আগামী কালের দিশা নেই বলে আজকে বাঁচার প্রবণতায় যা খরচ হচ্ছে তার দরুন ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন হয়তো বাড়ছে, কিন্তু স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টির বড় নজির তৈরি হচ্ছে না। বস্তুত, নব্বইয়ের দশকে কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত ছিলেন ১৫-২৪ বছর বয়সি পুরুষদের সত্তর শতাংশ। ২০১৬-য় তা কমে ৫০ শতাংশ হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের যোগদান দ্রুত কমেছে। এত মানুষের আগামী কালের বন্দোবস্ত কী হবে তার দিশা কোথায়? বিশেষত নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের নিয়োগের সুযোগ প্রায় কিছুই হচ্ছে না।

এই পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের পরিকল্পনার প্রতি অনীহা আসতেই পারে। তা থেকে আজকের কর্তব্যের প্রতি অবহেলা আসাই স্বাভাবিক। বিপজ্জনক জীবনযাত্রাও আশ্চর্য নয়। সেই আশাহীন, ঝুঁকিপূর্ণ জীবনে পরিবারের শিশুটি সব চাইতে বিপন্ন হয়ে পড়ে।

(কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক)

Future Malnutrition Economy Finance Delhi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy