উপাসনা গৃহে ২৫ বৈশাখে কবিকে স্মরণ। ফাইল চিত্র
রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলা থেকেই জীবনে চলার পথে আশ্রয় করেছিলেন গায়ত্রী মন্ত্রকে। পরিণত বয়সের ‘জীবনস্মৃতি’তে বাল্যবয়সের সেই উপলব্ধির কথা অকপটে প্রকাশ করেছিলেন, ‘আমার বেশ মনে আছে, আমি “ভূর্ভুবঃ স্বঃ” এই অংশকে অবলম্বন করিয়া মনটাকে খুব করিয়া প্রসারিত করিতে চেষ্টা করিতাম। কী বুঝিতাম, কী ভাবিতাম তাহা স্পষ্ট করিয়া বলা কঠিন, কিন্তু ইহা নিশ্চয় যে, কথার মানে বোঝাটাই মানুষের পক্ষে সকলের চেয়ে বড়ো জিনিস নয়।’ আজকের যুগে জীবনের জটিল আবর্তে আমাদের বেশি করে প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথের মতো করে ‘মনকে খুব করিয়া প্রসারিত’ করা। ১৩০ বছর ধরে ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শান্তিনিকেতনে তেমনই এক স্থান— উপাসনা মন্দির।
‘মন্দির’ শব্দটি সাধারণের কাছে যে অর্থ প্রতিপন্ন করে, মহর্ষির শান্তিনিকেতন বা রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী সেই গতানুগতিক অর্থ উপস্থাপিত করে না। এখানে মন্দির মানে কোনও দেবদেবীর অধিষ্ঠান নয়। মন্দির হল একটি অনুষ্ঠান— জীবনচর্যায় একটি উচ্চতর বোধের সাধনা। সে সাধনা বিশেষ কোনও ধর্ম বা সম্প্রদায়ের আচার-অনুষ্ঠান পালনের নিছক অনুসরণমাত্র নয়। পরিবারের কারওর মঙ্গল কামনায় নাম-গোত্র দিয়ে সংকল্প নিবেদন করে, মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে পূজো দেওয়াও নয়। এই মন্দির হল ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব নিয়ে বিশ্বের সৃষ্টি-স্থিতি-পালনকর্তার প্রতি এক নীরব আধ্যাত্মিক আত্মনিবেদন।
এর সূচনার ইতিহাস বলতে গেলে আমাদের ফিরে তাকাতে হয় প্রায় দু’শো বছর আগের বাংলা তথা পরাধীন ভারতের কথায়। ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায় একটি নবদিগন্তের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করে তিনি নির্যাস হিসেবে পেয়েছিলেন একটি সিদ্ধান্ত— পৃথিবীর সব ধর্ম একই সত্যের কথা বলে। পার্থক্য শুধু আচার-আচরণগত। শুরু করলেন এক ও অদ্বয় ব্রহ্মের উপাসনার মাধ্যমে এক ধর্মান্দোলন। তৈরি হল ব্রহ্মসমাজ। সেই সময় ব্রাহ্মসমাজ হয়ে উঠেছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের একটি আশ্রয়। রামমোহনের তিরোধানের পর মহর্ষি ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্বভার নিয়ে তার একটি বীজ রোপণ করলেন শান্তিনিকেতনে। ধীরে ধীরে সার-মাটি-জল দিয়ে লালন করে একটি ছায়াসুনিবিড় মহীরুহে পরিণত করেন। বৃহৎ শাখা-প্রশাখাময় সেই আশ্রয় হল শান্তিনিকেতনের ‘ছাতিমতলা’। পরবর্তী পরিণত রূপ হল শান্তিনিকেতনের ব্রহ্ম মন্দির বা উপাসনা গৃহ। ‘তিনি আমার প্রাণের আরাম মনের আনন্দ আত্মার শান্তি’— মহর্ষির জীবনবেদরূপ এই বাণীটি আজও অনুরণিত হয় এখানে। প্রতি বছর পৌষমেলার সূচনা এখানেই, ‘৭ই পৌষের উপাসনা’র মাধ্যমেই হয়। মহর্ষির আমলেই ঝড়-বৃষ্টি-রোদ এ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বাধাবিঘ্নের কারণে ১৮৯১ সালে গড়ে উঠেছিল ব্রহ্মমন্দির বা উপাসনা গৃহ। যাকে এখন আমরা শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যময় প্রাঙ্গণ ‘কাচমন্দির’ বলে জানি। এই মন্দিরের শিলান্যাস ঘটেছিল ১৮৯০ সালের ৭ ডিসেম্বর। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্দির স্থাপনার আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন, আর রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মসঙ্গীত গেয়েছিলেন। ১৮৯১-র ২১ ডিসেম্বর মন্দিরের আনুষ্ঠানিক শুভ উদ্বোধন করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, এ বারও রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মসঙ্গীত পরিবেশন করেন। যদিও সে সময় মহর্ষি শান্তিনিকেতনে থাকতে পারতেন না, তবু সব খবরাখবর রাখতেন। মন্দির নির্মাণের খরচ হিসেবে তৎকালীন মূল্যে ১৫,০০০ টাকা তিনি বরাদ্দ করেন। মন্দিরের গায়ে পূর্ব দিকে স্থাপিত হয়েছিল পঞ্চচূড়া— যার শীর্ষে তিনটি ছত্রে লেখা ছিল ‘ওঁ তৎ সত ঋতং সত্যং’। কালের ধর্ম গ্রাস করে বিস্মৃত করেছে সেই চূড়াকে, কিন্তু পুরনো দিনের ছবিতে তার স্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে।
রামমোহন প্রবর্তিত ব্রাহ্মসমাজে যে ট্রাস্টডিড গঠিত হয়েছিল— তা অনুসরণ করেই মন্দিরের মূল উদ্দেশ্য সাধিত হয়। সেই দলিল অনুসারে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আজও শান্তিনিকেতনবাসী নিয়মিত উপাসনাগৃহে যথাযথ গাম্ভীর্য, আবেগ ও ভক্তিকে আশ্রয় করে অখণ্ড অনন্ত পরমপুরুষের আরাধনায় মগ্ন হন। অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যে শিক্ষামূলক বক্তৃতা দেওয়া হয়, তা মানুষের নৈতিকতা দয়া করুণা ও মহানুভবতাকেই দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করে। এই মন্দিরে না থাকে কোনও দেববিগ্রহ, না থাকে নৈবেদ্যর ডালি। না প্রয়োজন কোনও ধর্মযাজক, মৌলবী কিংবা পুরোহিতের। পূজার্চনা বা আরতি এখানে স্থান নেয় পবিত্র বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ আর সুললিত সঙ্গীতের মূর্চ্ছনায়। আচার্যপদে আসন গ্রহণ করেন কোনও জ্ঞানতপস্বী।
আচার্য মহোদয়কে কেন্দ্র করে শ্বেত-শুভ্র পোশাকে সজ্জিত কচিকাচা থেকে বুড়ো, পড়ুয়া থেকে প্রবীণ আশ্রমিক সকলে সমবেত হন। এমন ঘটনা নাকি প্রায় বিরল ছিল যে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে আছেন অথচ উপাসনায় যোগ দেননি। কোনও সময় কবি হয়তো সমুদ্রপথে জাহাজে আছেন, সেখানেও উপাসনাপর্বটি তাঁর বাদ যেত না, চিঠিপত্রে এ রকম প্রচুর উল্লেখ আছে। প্রমথনাথ বিশী বলেছেন, ‘ইহার (শান্তিনিকেতনের) সম্যক রূপ অবগত হইতে হইলে ইহার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবি-জীবনকে মিশাইয়া লইয়া দেখিতে হইবে। তাঁহার কবি-জীবনের সঙ্গেই সমান তালে পা ফেলিয়া শান্তিনিকেতনের জীবন চলিয়াছে। রবীন্দ্র-জীবন ও শান্তিনিকেতন একই প্রবাহের সমান্তরাল দুই তটরেখা, একটিকে ছাড়িয়া অপরটিকে দর্শন একদেশ-দর্শন মাত্র।’ আশ্রমের পড়ুয়াদের জন্য রবীন্দ্রনাথের উপদেশ থেকে বোঝা যায়, কী ভাবে তাদেরকে আধ্যাত্মিক মনলোকে উচ্চ বিকাশের পথে তিনি চালিত করতে চেয়েছিলেন। ১৩১৬ বঙ্গাব্দে ক্ষিতিমোহন সেনকে কবি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘... কোনো অধ্যাপক ছাত্রদিগকে বিশেষভাবে ধর্মমত সম্বন্ধে কোনো সাম্প্রদায়িক পন্থায় চালনা করিবার চেষ্টামাত্র করিবেন না। ধর্মালোচনার ভার আপনি স্বয়ং লইবেন এবং যাঁহাকে উপযুক্ত [বোধ] করেন, অর্থাৎ এই আশ্রমের অসাম্প্রদায়িক ঔপনিষদ-মতে যাঁহাকে আস্থাবান মনে করেন, তাঁহার প্রতি ভাবার্পণ করিবেন।’
শিক্ষার্থীদের বিদ্যাশিক্ষার পাশাপাশি উপাসনাকে নিত্যকর্মের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ কোনও দিন আপস করেননি। তাঁর সময়েও মন্দির বা উপাসনায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েদের অনীহার কথা জানা যায়। সান্ধ্যপর্বে অনুষ্ঠিত মন্দিরে কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়ত, এমনকি ঘুমের মধ্যে নাক ডাকার কথাও জানা যায়। এর বিহিত করতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নাকি এক সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপাসনা প্রক্রিয়া চালানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রথম দিকে আশ্রমে সপ্তাহের প্রতিদিনই সকালে উপাসনার রীতি ছিল। পরে মহর্ষির দীক্ষা-দিবস বুধবার ছুটির দিন ধার্য হলে ওই দিন সকাল-সন্ধ্যায় উপাসনা আবশ্যিক হয়। তবে পাঠগ্রহণ শুরুর আগে ‘তাঁকে’ স্মরণ করে বৈতালিক আজও
নিয়মিত হয়।
কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিশ্বভারতীই একমাত্র স্থান, যেখানে পড়াশোনোর পাশাপাশি অধ্যাত্মচর্চা এ ভাবে অঙ্গীভূত। স্বাধীন ভারতে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের অন্তর্গত এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধীন আজকের বিশ্বভারতীতেও উপাসনা কার্যক্রম নিয়ে কোনও নীতি-নির্দেশ বা বিধি নিষেধের কথা কারোর জানা নেই। এমনকি বিশ্বভারতীর নিজস্ব সংবিধানেও এর সরাসরি কোনও উল্লেখ আছে কিনা— কেউ বলতে পারেন না। তবে কার্যপ্রণালী পরিচালনার ক্ষেত্রে উপাচার্য মহোদয় কর্তৃক গঠিত একটি ‘মন্দির কমিটি’ রয়েছে। আর রয়েছে পরামর্শ ও সহযোগিতা করার জন্য বিশ্বভারতীর সারা বছরের উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজক ‘কর্মীমণ্ডলী’।
সাম্প্রতিক অতীতে স্টিফেন হাউস বা আমরি হাসপাতালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরে সমবেদনা প্রকাশ করতে মন্দিরের ভাষণে উঠে এসেছে। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে রাজনৈতিক স্বৈরাচার, হিংসাশ্রিত তাণ্ডবলীলা, গণহত্যা, নৈতিকতার অবনমন বা চরম অবক্ষয়ের ঘটনায়, বিশ্বভারতী সমাজ বিক্ষোভ মিছিল বা প্রতিবাদে শামিল হয় এই মন্দিরেই। অতীতে জাপানের ভূমিকম্প, ভোপালে গ্যাস দুর্ঘটনা কিংবা সুনামির তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের প্রতি সমবেদনা জানাতে বিশ্বভারতী পরিবার কখনও ভুলে যায় না এই মন্দির-প্রাঙ্গণে আশ্রয় নিতে। অতি সাম্প্রতিক কালে কেরলের বন্যাদুর্গত কিংবা পুলওয়ামার জঙ্গিহানায় নিহত সৈনিকদের পরিবারের প্রতি, মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে সমবেদনা জানানো হয়েছে এই মন্দিরেই সমবেত হয়ে।
১৩২৮, মাঘ সংখ্যা ‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকা একটি গভীর আশা নিয়ে ব্যক্ত করেছে, ‘আশ্রমের মন্দিরের উপদেশ আলাপ আলোচনা অধ্যয়ন এখানকার (শান্তিনিকেতন) জীবনপ্রবাহের সহিত দূরে কর্ম্ম ক্ষেত্রে গিয়াও আমাদের বিচ্ছেদ না ঘটুক এই কামনা লইয়া আমরা কার্য্য ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইতেছি।’ আজ এত এত বছর ধরে যে আদর্শ নিয়ে এই পথ চলা— নিছক নিয়মরক্ষা বা ‘রিচ্যুয়াল’-এ পর্যবসিত ভেবে, দিক্ভ্রষ্ট না হয়ে বিশ্বভারতী তথা শান্তিনিকেতনের এই ঐতিহ্যের গৌরব যেন যুগে যুগে রক্ষা পায়!
(লেখক বিশ্বভারতীর গবেষক এবং গ্রন্থাগার কর্মী, মতামত নিজস্ব)রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলা থেকেই জীবনে চলার পথে আশ্রয় করেছিলেন গায়ত্রী মন্ত্রকে। পরিণত বয়সের ‘জীবনস্মৃতি’তে বাল্যবয়সের সেই উপলব্ধির কথা অকপটে প্রকাশ করেছিলেন, ‘আমার বেশ মনে আছে, আমি “ভূর্ভুবঃ স্বঃ” এই অংশকে অবলম্বন করিয়া মনটাকে খুব করিয়া প্রসারিত করিতে চেষ্টা করিতাম। কী বুঝিতাম, কী ভাবিতাম তাহা স্পষ্ট করিয়া বলা কঠিন, কিন্তু ইহা নিশ্চয় যে, কথার মানে বোঝাটাই মানুষের পক্ষে সকলের চেয়ে বড়ো জিনিস নয়।’ আজকের যুগে জীবনের জটিল আবর্তে আমাদের বেশি করে প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথের মতো করে ‘মনকে খুব করিয়া প্রসারিত’ করা। ১৩০ বছর ধরে ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শান্তিনিকেতনে তেমনই এক স্থান— উপাসনা মন্দির।
‘মন্দির’ শব্দটি সাধারণের কাছে যে অর্থ প্রতিপন্ন করে, মহর্ষির শান্তিনিকেতন বা রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী সেই গতানুগতিক অর্থ উপস্থাপিত করে না। এখানে মন্দির মানে কোনও দেবদেবীর অধিষ্ঠান নয়। মন্দির হল একটি অনুষ্ঠান— জীবনচর্যায় একটি উচ্চতর বোধের সাধনা। সে সাধনা বিশেষ কোনও ধর্ম বা সম্প্রদায়ের আচার-অনুষ্ঠান পালনের নিছক অনুসরণমাত্র নয়। পরিবারের কারওর মঙ্গল কামনায় নাম-গোত্র দিয়ে সংকল্প নিবেদন করে, মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে পূজো দেওয়াও নয়। এই মন্দির হল ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব নিয়ে বিশ্বের সৃষ্টি-স্থিতি-পালনকর্তার প্রতি এক নীরব আধ্যাত্মিক আত্মনিবেদন।
এর সূচনার ইতিহাস বলতে গেলে আমাদের ফিরে তাকাতে হয় প্রায় দু’শো বছর আগের বাংলা তথা পরাধীন ভারতের কথায়। ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায় একটি নবদিগন্তের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করে তিনি নির্যাস হিসেবে পেয়েছিলেন একটি সিদ্ধান্ত— পৃথিবীর সব ধর্ম একই সত্যের কথা বলে। পার্থক্য শুধু আচার-আচরণগত। শুরু করলেন এক ও অদ্বয় ব্রহ্মের উপাসনার মাধ্যমে এক ধর্মান্দোলন। তৈরি হল ব্রহ্মসমাজ। সেই সময় ব্রাহ্মসমাজ হয়ে উঠেছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের একটি আশ্রয়। রামমোহনের তিরোধানের পর মহর্ষি ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্বভার নিয়ে তার একটি বীজ রোপণ করলেন শান্তিনিকেতনে। ধীরে ধীরে সার-মাটি-জল দিয়ে লালন করে একটি ছায়াসুনিবিড় মহীরুহে পরিণত করেন। বৃহৎ শাখা-প্রশাখাময় সেই আশ্রয় হল শান্তিনিকেতনের ‘ছাতিমতলা’। পরবর্তী পরিণত রূপ হল শান্তিনিকেতনের ব্রহ্ম মন্দির বা উপাসনা গৃহ। ‘তিনি আমার প্রাণের আরাম মনের আনন্দ আত্মার শান্তি’— মহর্ষির জীবনবেদরূপ এই বাণীটি আজও অনুরণিত হয় এখানে। প্রতি বছর পৌষমেলার সূচনা এখানেই, ‘৭ই পৌষের উপাসনা’র মাধ্যমেই হয়। মহর্ষির আমলেই ঝড়-বৃষ্টি-রোদ এ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বাধাবিঘ্নের কারণে ১৮৯১ সালে গড়ে উঠেছিল ব্রহ্মমন্দির বা উপাসনা গৃহ। যাকে এখন আমরা শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যময় প্রাঙ্গণ ‘কাচমন্দির’ বলে জানি। এই মন্দিরের শিলান্যাস ঘটেছিল ১৮৯০ সালের ৭ ডিসেম্বর। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্দির স্থাপনার আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন, আর রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মসঙ্গীত গেয়েছিলেন। ১৮৯১-র ২১ ডিসেম্বর মন্দিরের আনুষ্ঠানিক শুভ উদ্বোধন করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, এ বারও রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মসঙ্গীত পরিবেশন করেন। যদিও সে সময় মহর্ষি শান্তিনিকেতনে থাকতে পারতেন না, তবু সব খবরাখবর রাখতেন। মন্দির নির্মাণের খরচ হিসেবে তৎকালীন মূল্যে ১৫,০০০ টাকা তিনি বরাদ্দ করেন। মন্দিরের গায়ে পূর্ব দিকে স্থাপিত হয়েছিল পঞ্চচূড়া— যার শীর্ষে তিনটি ছত্রে লেখা ছিল ‘ওঁ তৎ সত ঋতং সত্যং’। কালের ধর্ম গ্রাস করে বিস্মৃত করেছে সেই চূড়াকে, কিন্তু পুরনো দিনের ছবিতে তার স্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে।
রামমোহন প্রবর্তিত ব্রাহ্মসমাজে যে ট্রাস্টডিড গঠিত হয়েছিল— তা অনুসরণ করেই মন্দিরের মূল উদ্দেশ্য সাধিত হয়। সেই দলিল অনুসারে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আজও শান্তিনিকেতনবাসী নিয়মিত উপাসনাগৃহে যথাযথ গাম্ভীর্য, আবেগ ও ভক্তিকে আশ্রয় করে অখণ্ড অনন্ত পরমপুরুষের আরাধনায় মগ্ন হন। অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যে শিক্ষামূলক বক্তৃতা দেওয়া হয়, তা মানুষের নৈতিকতা দয়া করুণা ও মহানুভবতাকেই দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করে। এই মন্দিরে না থাকে কোনও দেববিগ্রহ, না থাকে নৈবেদ্যর ডালি। না প্রয়োজন কোনও ধর্মযাজক, মৌলবী কিংবা পুরোহিতের। পূজার্চনা বা আরতি এখানে স্থান নেয় পবিত্র বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ আর সুললিত সঙ্গীতের মূর্চ্ছনায়। আচার্যপদে আসন গ্রহণ করেন কোনও জ্ঞানতপস্বী।
আচার্য মহোদয়কে কেন্দ্র করে শ্বেত-শুভ্র পোশাকে সজ্জিত কচিকাচা থেকে বুড়ো, পড়ুয়া থেকে প্রবীণ আশ্রমিক সকলে সমবেত হন। এমন ঘটনা নাকি প্রায় বিরল ছিল যে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে আছেন অথচ উপাসনায় যোগ দেননি। কোনও সময় কবি হয়তো সমুদ্রপথে জাহাজে আছেন, সেখানেও উপাসনাপর্বটি তাঁর বাদ যেত না, চিঠিপত্রে এ রকম প্রচুর উল্লেখ আছে। প্রমথনাথ বিশী বলেছেন, ‘ইহার (শান্তিনিকেতনের) সম্যক রূপ অবগত হইতে হইলে ইহার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবি-জীবনকে মিশাইয়া লইয়া দেখিতে হইবে। তাঁহার কবি-জীবনের সঙ্গেই সমান তালে পা ফেলিয়া শান্তিনিকেতনের জীবন চলিয়াছে। রবীন্দ্র-জীবন ও শান্তিনিকেতন একই প্রবাহের সমান্তরাল দুই তটরেখা, একটিকে ছাড়িয়া অপরটিকে দর্শন একদেশ-দর্শন মাত্র।’ আশ্রমের পড়ুয়াদের জন্য রবীন্দ্রনাথের উপদেশ থেকে বোঝা যায়, কী ভাবে তাদেরকে আধ্যাত্মিক মনলোকে উচ্চ বিকাশের পথে তিনি চালিত করতে চেয়েছিলেন। ১৩১৬ বঙ্গাব্দে ক্ষিতিমোহন সেনকে কবি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘... কোনো অধ্যাপক ছাত্রদিগকে বিশেষভাবে ধর্মমত সম্বন্ধে কোনো সাম্প্রদায়িক পন্থায় চালনা করিবার চেষ্টামাত্র করিবেন না। ধর্মালোচনার ভার আপনি স্বয়ং লইবেন এবং যাঁহাকে উপযুক্ত [বোধ] করেন, অর্থাৎ এই আশ্রমের অসাম্প্রদায়িক ঔপনিষদ-মতে যাঁহাকে আস্থাবান মনে করেন, তাঁহার প্রতি ভাবার্পণ করিবেন।’
শিক্ষার্থীদের বিদ্যাশিক্ষার পাশাপাশি উপাসনাকে নিত্যকর্মের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ কোনও দিন আপস করেননি। তাঁর সময়েও মন্দির বা উপাসনায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েদের অনীহার কথা জানা যায়। সান্ধ্যপর্বে অনুষ্ঠিত মন্দিরে কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়ত, এমনকি ঘুমের মধ্যে নাক ডাকার কথাও জানা যায়। এর বিহিত করতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নাকি এক সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপাসনা প্রক্রিয়া চালানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রথম দিকে আশ্রমে সপ্তাহের প্রতিদিনই সকালে উপাসনার রীতি ছিল। পরে মহর্ষির দীক্ষা-দিবস বুধবার ছুটির দিন ধার্য হলে ওই দিন সকাল-সন্ধ্যায় উপাসনা আবশ্যিক হয়। তবে পাঠগ্রহণ শুরুর আগে ‘তাঁকে’ স্মরণ করে বৈতালিক আজও নিয়মিত হয়।
কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিশ্বভারতীই একমাত্র স্থান, যেখানে পড়াশোনোর পাশাপাশি অধ্যাত্মচর্চা এ ভাবে অঙ্গীভূত। স্বাধীন ভারতে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের অন্তর্গত এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধীন আজকের বিশ্বভারতীতেও উপাসনা কার্যক্রম নিয়ে কোনও নীতি-নির্দেশ বা বিধি নিষেধের কথা কারোর জানা নেই। এমনকি বিশ্বভারতীর নিজস্ব সংবিধানেও এর সরাসরি কোনও উল্লেখ আছে কিনা— কেউ বলতে পারেন না। তবে কার্যপ্রণালী পরিচালনার ক্ষেত্রে উপাচার্য মহোদয় কর্তৃক গঠিত একটি ‘মন্দির কমিটি’ রয়েছে। আর রয়েছে পরামর্শ ও সহযোগিতা করার জন্য বিশ্বভারতীর সারা বছরের উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজক ‘কর্মীমণ্ডলী’।
সাম্প্রতিক অতীতে স্টিফেন হাউস বা আমরি হাসপাতালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরে সমবেদনা প্রকাশ করতে মন্দিরের ভাষণে উঠে এসেছে। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে রাজনৈতিক স্বৈরাচার, হিংসাশ্রিত তাণ্ডবলীলা, গণহত্যা, নৈতিকতার অবনমন বা চরম অবক্ষয়ের ঘটনায়, বিশ্বভারতী সমাজ বিক্ষোভ মিছিল বা প্রতিবাদে শামিল হয় এই মন্দিরেই। অতীতে জাপানের ভূমিকম্প, ভোপালে গ্যাস দুর্ঘটনা কিংবা সুনামির তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের প্রতি সমবেদনা জানাতে বিশ্বভারতী পরিবার কখনও ভুলে যায় না এই মন্দির-প্রাঙ্গণে আশ্রয় নিতে। অতি সাম্প্রতিক কালে কেরলের বন্যাদুর্গত কিংবা পুলওয়ামার জঙ্গিহানায় নিহত সৈনিকদের পরিবারের প্রতি, মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে সমবেদনা জানানো হয়েছে এই মন্দিরেই সমবেত হয়ে।
১৩২৮, মাঘ সংখ্যা ‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকা একটি গভীর আশা নিয়ে ব্যক্ত করেছে, ‘আশ্রমের মন্দিরের উপদেশ আলাপ আলোচনা অধ্যয়ন এখানকার (শান্তিনিকেতন) জীবনপ্রবাহের সহিত দূরে কর্ম্ম ক্ষেত্রে গিয়াও আমাদের বিচ্ছেদ না ঘটুক এই কামনা লইয়া আমরা কার্য্য ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইতেছি।’ আজ এত এত বছর ধরে যে আদর্শ নিয়ে এই পথ চলা— নিছক নিয়মরক্ষা বা ‘রিচ্যুয়াল’-এ পর্যবসিত ভেবে, দিক্ভ্রষ্ট না হয়ে বিশ্বভারতী তথা শান্তিনিকেতনের এই ঐতিহ্যের গৌরব যেন যুগে যুগে রক্ষা পায়!
(লেখক বিশ্বভারতীর গবেষক এবং গ্রন্থাগার কর্মী, মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy