Advertisement
E-Paper

উন্নতি হয়েছে, তবে অনেক কিছুই বাকি

পশ্চিমবঙ্গে রেশন ব্যবস্থায় সম্প্রতি যতখানি উন্নতি হয়েছে, তা আগে কখনও হয়নি। কিন্তু, এখনও অনেক গরিব মানুষের রেশন কার্ড নেই, অনেক পরিবারে এক জন সদস্য বাদ পড়েছেন তালিকা থেকে। এখনও দোকানদাররা দুর্নীতি ছাড়েননি। সরকার কি বিপ্লব আনতে পারবে?সম্প্রতি বাংলা সংবাদমাধ্যমে ‘গণবণ্টন ব্যবস্থার বৈপ্লবিক উন্নতি’ নিয়ে বেশ কয়েকটা খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের সাফল্যের পিছনে এই উন্নতির ভূমিকার কথাও আলোচিত হয়েছে। এই খবরগুলির মধ্যে কয়েকটিতে কিছু বোঝার ভুল থেকে গিয়েছে।

জঁ দ্রেজ

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
উন্নতির পথে? কলকাতার একটি রেশন দোকানের ছবি।

উন্নতির পথে? কলকাতার একটি রেশন দোকানের ছবি।

সম্প্রতি বাংলা সংবাদমাধ্যমে ‘গণবণ্টন ব্যবস্থার বৈপ্লবিক উন্নতি’ নিয়ে বেশ কয়েকটা খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের সাফল্যের পিছনে এই উন্নতির ভূমিকার কথাও আলোচিত হয়েছে। এই খবরগুলির মধ্যে কয়েকটিতে কিছু বোঝার ভুল থেকে গিয়েছে। যেহেতু যে সমীক্ষার ভিত্তিতে এই খবরগুলি হয়েছে, আমরা সেই সমীক্ষাটির সঙ্গে জড়িত, তাই কয়েকটা কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি।

সমীক্ষাটি হয়েছিল এ বছর জুন মাসে, ভারতের ছ’টি দরিদ্রতর রাজ্যে— বিহার, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সমীক্ষায় পাওয়া ফলাফলগুলিকে বাস্তবের ‘সম্ভাব্য’ প্রতিফলনের চেয়ে খুব বেশি কিছু বলা দুটি কারণে মুশকিল। প্রথম কারণ হল, সমীক্ষাটি অপেক্ষাকৃত ছোট মাপের ছিল— বীরভূম ও বাঁকুড়া, এই দুটি জেলার মোট সাতটি গ্রামের সব বাড়িতে সমীক্ষা করা হয়েছিল। অন্যান্য রাজ্যেও নমুনার মাপ ছোটই ছিল, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গই একমাত্র রাজ্য, যার ক্ষেত্রে অন্য এমন কোনও সমীক্ষার ফলাফল পাওয়া যায়নি, যার সঙ্গে আমাদের সমীক্ষার ফল তুলনা করে দেখা যেতে পারে।

দ্বিতীয় কারণ, সমীক্ষাটি হয়েছিল বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক পরেই। এমনটা হতেই পারে যে শুধু নির্বাচনের কারণেই গণবণ্টন ব্যবস্থার ওপর ভাল ভাবে কাজ করার জন্য অস্বাভাবিক চাপ ছিল, এবং নির্বাচন মিটে যাওয়ার কিছু দিন পরেও সেই ভাল কাজের রেশ থেকে গিয়েছে। এই উন্নতি দীর্ঘস্থায়ী হবে, না কি নেহাতই সাময়িক, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে।

তবুও, সমীক্ষায় পাওয়া ফলাফলের তাৎপর্য অনস্বীকার্য। এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গের গণবণ্টন ব্যবস্থার কাজে বড় উন্নতির কথা শোনা গেল। রেশন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ চির কাল দেশের সবচেয়ে খারাপ রাজ্যগুলির তালিকায় থেকেছে। কারা রেশন পাবেন, তা স্থির করার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য নিয়ম ছিল না। বিপিএল তালিকার বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল না। কে কতটা রেশন পাবেন, তারও কোনও ঠিকঠিকানা ছিল না। রেশন দোকানের মালিকরা নিজেদের ইচ্ছায় চলতেন। অনেকেরই খাতারও হদিশ পাওয়া যেত না, আর দোকানের বাইরে যে বিজ্ঞপ্তি-বোর্ড লাগানোর নিয়ম, তার কথা না তোলাই ভাল। সব স্তরে স্বচ্ছতার অভাব ছিল। এবং, অসৎ রেশন ডিলার ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের যৌথ প্রচেষ্টায় গণবণ্টন ব্যবস্থায় আসা চাল ও গমের সিংহভাগই খিড়কির দরজা দিয়ে পাচার হয়ে যেত। ২০০৪-০৫ সালে পশ্চিমবঙ্গে রেশন দোকানে যত চাল-গম এসেছিল, জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্য বলছে, তার ৮১ শতাংশই চোরাবাজারে বিক্রি হয়েছিল। ২০১১-১২ সালে অনুপাতটি দাঁড়িয়েছিল ৬৫ শতাংশে। খানিক উন্নতি হয়েছিল, অনস্বীকার্য, কিন্তু ছত্তীসগঢ় বা ওড়িশার মতো রাজ্যে তত দিনে গণবণ্টন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার হয়ে গিয়েছে।

এই অতীতের কথা মাথায় রাখলে আমাদের ক্ষেত্রসমীক্ষার ফলাফলকে আশাব্যঞ্জক বলতেই হয়। ক্ষেত্রসমীক্ষায় আমরা দেখেছি, ৮৫ শতাংশ মানুষই জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের আওতায় নতুন রেশন কার্ড পেয়ে গিয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে বাদ পড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে— গরিব পরিবার রেশন কার্ড পায়নি— কিন্তু বছর দুয়েক আগেও অবস্থা যতখানি ভয়ঙ্কর ছিল, এই ভ্রান্তি সে তুলনায় কিছুই নয়। দু’বছর আগেও আমাদের সমীক্ষার পরিবারগুলির অর্ধেকের রেশন কার্ড ছিল না, এবং বহু ক্ষেত্রেই অতি দরিদ্র পরিবারগুলি রেশন কার্ড থেকে বঞ্চিত থাকত। এখন অন্ত্যোদয় ও প্রায়োরিটি কার্ড তৈরি হয় ২০১১ সালের আর্থসামাজিক ও জাতিভিত্তিক জনশুমারির পরিসংখ্যানের নিরিখে, একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ইন্টারনেটে এই তালিকা পাওয়া যায়— প্রত্যেক গ্রামের জন্য, প্রত্যেক রেশন ডিলারের জন্য। কিছু কাল আগেও রাজ্যে বিপিএল তালিকা নিয়ে যে ভয়ঙ্কর কাণ্ড হত, তার তুলনায় এটি বিপুল উন্নতি।

কার জন্য কতখানি বরাদ্দ, সেই হিসেবও জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন প্রবর্তিত হওয়ার পর নিতান্ত সহজ হয়ে গিয়েছে। মানুষ যখন নিজেদের প্রাপ্য বিষয়ে সম্পূর্ণ অবহিত থাকেন না, তখন তাঁদের ঠকানো সহজ হয়। এই সমীক্ষা চলাকালীন আমরা এক দিন জঙ্গলমহলে ছিলাম। সেখানে এখনও খাদ্য সুরক্ষা আইন চালু হয়নি। আমরা নিজের চোখে দেখে এলাম, প্রাপ্যের পরিমাণ বিষয়ে অস্বচ্ছতা থাকলে মানুষ কী ভাবে ঠকেন। তাঁদের কতটা পাওনা, বোঝা কার্যত অসম্ভব। তাঁরা বোঝেনও না। রেশন দোকান থেকে যা দেয়, তাঁরা সেটুকু নিয়েই বাড়ি ফেরেন। খাদ্য সুরক্ষা আইনে প্রাপ্যের পরিমাণ একেবারে স্পষ্ট—অন্ত্যোদয় পরিবারের জন্য প্রতি মাসে ৩৫ কিলোগ্রাম, আর প্রায়োরিটি পরিবারের জন্য সদস্যপিছু মাসে পাঁচ কিলোগ্রাম চাল-আটা। দুই ক্ষেত্রেই, কিলোগ্রামপ্রতি দু’টাকা দরে।

স্বচ্ছতা বেড়েছে, প্রাপ্যের পরিমাণ বোঝা সহজ হয়েছে, এবং অন্যান্য সংস্কারও হয়েছে। অনুমান করা চলে, এগুলির ফলেই রেশনে চুরির পরিমাণ অত্যন্ত দ্রুত কমেছে। আমাদের সমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত ছশোটির কাছাকাছি পরিবার গত মে মাসে গড়ে তাঁদের প্রাপ্য রেশনের ৯৫ শতাংশ পেয়েছেন। আমরা জানতে চেয়েছিলাম, অন্য মাসে তাঁরা কতটা রেশন পান। জানা গেল, তখনও প্রাপ্যের ৯৫ শতাংশ রেশন তাঁরা পেয়ে থাকেন। এই ছবিটি গোটা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেই এক কি না, তা নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু যদি সত্যিই গোটা পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা এই রকমই হয়, তবে সেটা রেশন ব্যবস্থায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা বিরাট বড় জয়। প্রতি মাসে বরাদ্দের পাঁচ শতাংশ চুরি হয়ে যাবে, এটাও কোনও কাজের কথা নয়— কিন্তু মনে রাখা ভাল, ২০১১-১২ সালে চুরি হত বরাদ্দের ৬৫ শতাংশ!

তা হলে কি এখন পশ্চিমবঙ্গের রেশন ব্যবস্থায় ‘অল ইজ ওয়েল’? একেবারেই নয়। রেশন প্রাপকের তালিকায় থাকা উচিত ছিল, এমন অনেক পরিবারই এই তালিকা থেকে বাদ পড়ে গিয়েছে— হয় জনশুমারিতে তাঁদের সম্বন্ধে ভুল তথ্য নথিভুক্ত হয়েছে, অথবা তাঁরা জনশুমারি থেকে সম্পূর্ণ বাদ পড়েছেন। যে সমস্যাটির বিস্তার তুলনায় আরও বেশি, তা হল: খাদ্য সুরক্ষা আইনের তালিকা থেকে পরিবারের এক বা একাধিক সদস্যের নাম বাদ পড়ে যাওয়া। আমাদের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, গড়ে সব পরিবারের ১৩ শতাংশ সদস্যের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ছে। অর্থাৎ, গড়ে ছ’জনের পরিবারে এক জনের রেশন কার্ড নেই। যেহেতু প্রায়োরিটি পরিবারে মাথাপিছু রেশন দেওয়া হয়, এই ভ্রান্তির ফলে পরিবারের রেশনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। স্পষ্টতই, খাদ্য সুরক্ষা আইনের অন্তর্গত নামের তালিকার সংশোধন ও পরিবর্ধনের কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

পশ্চিমবঙ্গে রেশন দোকান থেকে পাওয়া চাল-আটার মান নিয়ে মানুষের সন্তুষ্টি তুলনায় কম। মাত্র ৫৭ শতাংশ মানুষের মতে, চাল বা আটার মান ন্যায্য অথবা ভাল। অনেকেই বলেছেন, রেশনে পাওয়া আটা তাঁরা পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেন। আটার প্যাকেটের গায়ে কোনও এক্সপায়ারি ডেট লেখা নেই। সমস্যাটা চেনা— বেসরকারি কনট্রাক্টররা রেশন দোকানে নিম্নমানের পণ্য জোগান দিয়ে বাড়তি মুনাফা কামিয়ে নিচ্ছেন। আটার বদলে গম দেওয়া হলে সমস্যা কমবে। আরও ভাল হয় চাল দিলে। আটা যদি দিতেই হয়, তবে তার মান ভাল করতে হবে।

তবে, রেশন ব্যবস্থায় যে উন্নতি হয়েছে, সেটা ধরে রাখতে পারাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বেসরকারি রেশন ডিলারদের দায়বদ্ধ করতে পারাই প্রধান সমস্যা। তাঁদের মধ্যে অনেকেই যুগের পর যুগ রেশন দোকান থেকে ডাইনে-বাঁয়ে টাকা রোজগার করে চলেছেন। পশ্চিমবঙ্গে নাকি আবার রেশন দোকানের লাইসেন্স বংশানুক্রমে বজায় থাকে। আমাদের সমীক্ষায় এক রেশন ডিলার খোলাখুলিই বললেন, “হ্যাঁ, আমি চুরি করি। আমার বাবাও করতেন। আশা করি, আমার ছেলেও করবে।”

মাথার ওপর রাজনৈতিক নেতাদের আশীর্বাদী হাত আছে, অতএব রেশন দোকানের মালিকরা যা খুশি করেও পার পেয়ে যান। নেতারাও লুটের বখরা পান। বিধানসভা নির্বাচনের আগে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে রেশন দোকানের মালিকরা শুধরে গিয়েছিলেন। তবে, তাঁদের সততা দীর্ঘস্থায়ী হবে, তেমন কোনও গ্যারান্টি নেই। আমাদের সমীক্ষায় রেশন দোকানের মালিকদের দায়বদ্ধতার কোনও উন্নতি ধরা পড়েনি। কোনও দোকানেই বিজ্ঞপ্তি-বোর্ডটুকুও ছিল না।

বেসরকারি রেশন দোকানদারদের চুরি বন্ধ করার সেরা উপায় হল তাঁদের বিদায় করা। ছত্তীসগঢ়ে রেশন ব্যবস্থার সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রথম এবং সবচেয়ে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ এটাই ছিল। দোকানদাররা দু’বছর ধরে মামলা লড়েন— তাঁদের রেশন দোকান চালানোর ‘অধিকার’ ফেরত পাওয়ার জন্য। কিন্তু আদালতের রায় শেষ পর্যন্ত সরকারের দিকেই যায়। বেসরকারি দোকানদারদের বদলে রেশন দোকানের ভার দেওয়া হয় সমষ্টির হাতে— সমবায়, গ্রাম পঞ্চায়েত বা স্বনির্ভর গোষ্ঠী এই দায়িত্ব পায়। এগুলোর মধ্যেও দুর্নীতির ঘুঘুর বাসা তৈরি হতে পারে না, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু, সমষ্টির হাতে মালিকানা থাকলে দুর্নীতির পথে হাঁটা অপেক্ষাকৃত কঠিন।

আমাদের সমীক্ষার একটি গ্রামে— বাঁকুড়ার কিয়াসোলে— রেশন দোকান চালায় একটি সমবায়। সমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত অন্য গ্রামগুলির তুলনায় এখানে রেশন ব্যবস্থা বেশি ভাল চলে বলে দেখা গেল। বেশির ভাগ মানুষই সপ্তাহের পর সপ্তাহ তাঁদের বরাদ্দ রেশনের পুরোটা পাচ্ছেন, এবং রেশন ব্যবস্থা নিয়ে তাঁরা সন্তুষ্ট। এই গ্রামের রেশন দোকানের বাইরে বিজ্ঞপ্তি-বোর্ডও আছে।

এটা নিতান্ত সমাপতন হতেই পারে। কিন্তু, অন্য রাজ্যগুলি থেকে যে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে স্পষ্ট— ব্যক্তিগত মালিকানার বেসরকারি রেশন দোকানের মাধ্যমে গণবণ্টন ব্যবস্থা চালানোর দিন ফুরিয়েছে। স্থানীয় স্তরে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে রেশন দোকানের মালিকের পারস্পরিক স্বার্থের সম্পর্ক যেমন মজবুত, তাতে এই পরিবর্তনটি আনতে হলে বিলক্ষণ রাজনৈতিক সদিচ্ছার জোর প্রয়োজন। সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের স্বার্থ রেশন দোকানের মালিকের স্বার্থের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় কি না, সেটা এই রাজ্যের গণতান্ত্রিক রাজনীতির দৌড় কত দূর, তা বলে দেবে।

রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy