Advertisement
E-Paper

আধিপত্য ও সম্মতি

মুম্বইয়ের সভাগৃহে হাজির দর্শকমণ্ডলীই এখন ভারতের মূলস্রোত। তাঁহারা জানেন, রাষ্ট্র(নায়ক) যাহাই করে(ন), তাহাই বৈধ। এবং, রাষ্ট্র(নায়ক)কে প্রশ্ন করা, প্রতিস্পর্ধী অবস্থান গ্রহণ করিবার মূল্য ভয়ানক হইতে পারে। যে ভাবে গত কয়েক বৎসর ধরিয়া লাগাতার প্রতিবাদীদের উপর ধরপাকড় চলিয়াছে, মহারাষ্ট্র এবং কর্নাটক এমনকি প্রতিবাদীর নিধনও দেখিয়াছে, তাহাতে এই ভীতি ছড়াইয়া পড়া স্বাভাবিক।

শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:২১
নরেন্দ্র মোদী।—ফাইল চিত্র।

নরেন্দ্র মোদী।—ফাইল চিত্র।

সর্বাধিপত্যকামী শাসনের বৃহত্তম সাফল্য প্রতিবাদী স্বরের কণ্ঠরোধে নহে। শাসকের পেশিশক্তি প্রবল। বিরোধীর কথা বলিবার পরিসর সেই পেশিশক্তিতেই কাড়িয়া লহিতে চাহিবে সর্বাধিপত্যকামী শাসন, তাহা মূলত জোরের জায়গা। কিন্তু অ্যাডল্‌ফ হিটলার সাক্ষী, শুধুমাত্র জোরের ভরসায় একনায়কের শাসন টেকে না। বৃহত্তর সমাজ যখন সেই জবরদস্তিকে ‘স্বাভাবিক’ বলিয়া মানিয়া লয়, তাহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিতে ভোলে— বস্তুত, প্রতিবাদই ‘অস্বাভাবিক’ বোধ হয়— সেই মুহূর্তটিই আধিপত্যকামী শাসনের জয়ের মুহূর্ত। সম্প্রতি মুম্বইয়ে তেমনই একটি মুহূর্ত রচিত হইল। প্রবীণ অভিনেতা অমোল পালেকর এক বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক সম্বন্ধে কিছু (মৃদু) সমালোচনা করিয়াছিলেন। আয়োজকরা তাঁহাকে ভাষণ শেষ করিবার সুযোগ দিলেন না। স্বাভাবিক। কেন্দ্রীয় সরকারকে চটাইবার বাসনা বা সাহস তাঁহাদের না-ই থাকিতে পারে। হয়তো তাহাতে ভবিষ্যৎ প্রাপ্তির ঘরে কাটা পড়িবে। অমোল পালেকরও বোধ করি সেই আচরণে ক্ষুব্ধ হইলেও অবাক হন নাই। তাঁহাকে বিস্মিত, বিষণ্ণ করিয়াছে সমবেত শ্রোতাদের অপার নৈঃশব্দ্য। এক জনও প্রতিবাদ করিলেন না। এক জনও বলিলেন না, আমন্ত্রিত অতিথিকে এই ভাবে মাঝপথে থামাইয়া দেওয়া যায় না। এক জনও বলিলেন না, প্রতিস্পর্ধী স্বর যতই তীব্র হউক, তাহাকে বাধা দেওয়ার অর্থ দাঁড়ায়, গণতন্ত্রকে অপমান করা। শ্রোতারা নির্বিকার নিশ্চুপ থাকিলেন। সেই নৈঃশব্দ্যকে কোনও প্রত্যক্ষ প্রাপ্তির সম্ভাবনার সঙ্গে জোড়া মুশকিল। প্রতিবাদ করিলে ক্ষতির ভয় থাকে বটে, বর্তমান শাসনে প্রতিবাদী হিসাবে চিহ্নিত হইবার ভয়কেও খাটো করিয়া দেখা যায় না। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও ভয়কেই এই চর্চিত নীরবতার যথেষ্ট কারণ হয়তো বলা চলে না। আরও বড় কারণটি সম্ভবত— প্রতিবাদ করিবার প্রয়োজনীয়তাটিই ক্রমে নাগরিক ভুলিতেছেন। এইখানেই ক্ষমতাতন্ত্রের সাফল্য, এইখানেই একনায়কের বৃহত্তম জয়।

দেশের সব মানুষ প্রতিবাদের গুরুত্ব বিস্মৃত হইয়াছেন, অবশ্যই এ কথা এখনও বলা চলে না। এই যেমন, পরিচালন সমিতি জিগ্নেশ মেবাণীর আমন্ত্রণ বাতিল করায় প্রতিবাদে আমদাবাদের এক কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদত্যাগ করিলেন। চাকুরির মোহ বা শাসকের প্রীতি অর্জনের হাতছানি তাঁহাদের নিকট বাক্‌স্বাধীনতা খণ্ডনের গুরুত্বকে লঘু করিয়া দিতে পারে নাই। প্রতিবাদীরা এখনও আছেন। তবে তাঁহারা আছেন, এই কথাটি যেমন সত্য, তাঁহারা ক্রমশ ব্যতিক্রম বা প্রান্তিক হইয়া পড়িতেছেন, ইহাও সত্য। মুম্বইয়ের সভাগৃহে হাজির দর্শকমণ্ডলীই এখন ভারতের মূলস্রোত। তাঁহারা জানেন, রাষ্ট্র(নায়ক) যাহাই করে(ন), তাহাই বৈধ। এবং, রাষ্ট্র(নায়ক)কে প্রশ্ন করা, প্রতিস্পর্ধী অবস্থান গ্রহণ করিবার মূল্য ভয়ানক হইতে পারে। যে ভাবে গত কয়েক বৎসর ধরিয়া লাগাতার প্রতিবাদীদের উপর ধরপাকড় চলিয়াছে, মহারাষ্ট্র এবং কর্নাটক এমনকি প্রতিবাদীর নিধনও দেখিয়াছে, তাহাতে এই ভীতি ছড়াইয়া পড়া স্বাভাবিক। রাষ্ট্র যে প্রশ্নাতীত নহে, বরং সুস্থ গণতন্ত্রে রাষ্ট্রকে নিরন্তর প্রশ্ন করিয়া চলাই নাগরিকের কর্তব্য— এই কথাটি সম্ভবত দ্রুত বিস্মৃত হইবার অনুশীলন চলিতেছে। এই সমাজ দ্রুত রাষ্ট্রের অনুগামী হইতে শিখিতেছে। অমোল পালেকর ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিতে পারেন যে সেই দিন তাঁহার কথা থামাইয়া দেওয়া হইয়াছিল মাত্র, শারীরিক হেনস্থা করা হয় নাই। হইতেই পারিত— কেননা, শাসকের বিরোধীকে অধিকাংশ মানুষই এখন শত্রু জ্ঞান করিতেছেন। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রনায়কের যে কোনও সিদ্ধান্তকে বিনাপ্রশ্নে মানিয়া লইতেছেন। এই জন্যই নরেন্দ্র মোদীর শাসন ভারতের ইতিহাসে কলঙ্কাক্ষরে লেখা থাকিবে। সর্বাধিপত্যকামী শাসকের বৃহত্তম জোরের জায়গা যে নীরব গণসম্মতি, সেখানে তিনি দেশকে লইয়া যাইতে সফল হইয়াছেন।

Narendra Modi Autocratic Rule Fascist Regime
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy