Advertisement
E-Paper

এই দেশে জন্ম নিক ভাঁওরি দেবীর মতো সাহসী মেয়েরা

প্রতিবাদটা কিন্তু বিশেষ কিছু নারীর মধ্যেই আটকে আছে। ফলে আন্দোলনের উদ্দেশ্য কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে ধন্দ থেকেই যাচ্ছে। লিখছেন দেবযানী ভৌমিক চক্রবর্তীপ্রতিবাদটা কিন্তু বিশেষ কিছু নারীর মধ্যেই আটকে আছে। ফলে আন্দোলনের উদ্দেশ্য কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে ধন্দ থেকেই যাচ্ছে। লিখছেন দেবযানী ভৌমিক চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:৫২
ভাঁওরি দেবী

ভাঁওরি দেবী

সমাজের শ্রমজীবী নারীরা প্রায়ই কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আর্থিক অসহায়তার কারণে তাঁরা মুখ খোলেন না।

ইটভাটার কর্মী, খনিতে কাজ করা মেয়েরা, সাফাইকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী থেকে শুরু করে লোকের বাড়ি-বাড়ি খেটে খাওয়া মেয়েরা অনেক সময়েই তাঁদের সহকর্মী বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্বারা যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েও মুখ খোলেন না। লজ্জা পান। আবার মাথা গোঁজার ঠাঁই হারানোর ভয়ও থাকে। স্বামী জেনে গেলে পাছে তাঁকে ছেড়ে দেন, এই ভয়টাও তাঁদের মধ্যে কাজ করে। তাঁরা এই জন্যই অনেক সময়ে অভিযোগ দায়ের করেন না। কারণ তাঁদের যে রোজগারও করতে হবে, আবার স্বামীর প্রতি যৌন ভাবে একনিষ্ঠও থাকতে হবে। তাই ইচ্ছের বিরুদ্ধেও অনেক সময়ে এক দিকে কর্তৃপক্ষ, অপর দিকে স্বামীর যৌন নিগ্রহ তাঁদের সহ্য করতে হয়। এটা যে সকলের ক্ষেত্রেই হচ্ছে, তা নয়। তবে যাঁদের এই অভিজ্ঞতা হচ্ছে, তাঁদের পক্ষে জীবনধারণ দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কেউ যদি সাহস করে প্রতিবাদও করেন, অনেক ক্ষেত্রে তার প্রতিকার মেলে না। কারণ ক্ষমতাবানেরা আইন প্রয়োগের প্রতিষ্ঠানকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

এই দুর্বৃত্তায়ন রোধেই অন্তত কর্মক্ষেত্রে যাতে মেয়েরা সুপরিবেশ পান, তার জন্য চালু হয়েছে যৌন হয়রানি বিরোধী আইন। ভারতে ১৯৯৭ সালে যৌন হয়রানি মোকাবিলায় তৈরি হয়েছিল ‘বিশাখা গাইডলাইনস’। ২০১৩ সালে সেটিই যৌন হয়রানি বিরোধী আইনে রূপান্তরিত হয়।

এই আইন গঠনের পশ্চাতে ছিলেন রাজস্থানের ভাঁওরি দেবী। রাজস্থান সরকারের নারী উন্নয়ন প্রকল্পে ‘সাথিন’ হিসেবে কাজ করতেন তিনি। গ্রামের ঘরে-ঘরে গিয়ে বাল্যবিবাহ, অনুপযুক্ত শৌচব্যবস্থা, মেয়েদের সর্বক্ষেত্রে অধিকারের খর্বতার বিরুদ্ধে বোঝানোই ছিল তাঁর কাজ। তাঁর প্রতি স্বামী মোহনলালের ছিল পূর্ণ সমর্থন। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে মরিয়া ছিলেন ভাঁওরি। গ্রামের অবস্থাপন্ন গুজ্জর রামকরণের এক বছরেরও কমবয়সি মেয়ের বিয়ে আটকাতে গিয়েই তাঁর জীবনে কালো দিন নেমে আসে। সেই দিনের মতো বিয়ে ঠেকানো গেলেও পরের দিন পুলিশের উপস্থিতিতেই বিয়ে হয় ওই দুধের শিশুর। রামকরণের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে ভাঁওরির উপরে। ফলস্বরূপ ভাঁওরি দেবীকে গণধর্ষণ করা হয়।

দিনটি ছিল ১৯৯২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। ভাঁওরি সাহস করে পুলিশে জানাতে গেলে পুলিশও তাঁকে হেনস্থা করে। সমাজ তাঁদের একঘরে করে। কিন্তু ভাঁওরি পথে নামেন, আদালতে যান। ১৯৯৫ সালের ২৫ নভেম্বর পাঁচ অভিযুক্তই প্রমাণাভাবে ছাড়া বেকসুর খালাস হয়ে যায়। ভাঁওরি হাইকোর্টে যান। পাশে পান জয়পুর ও দিল্লির বেশ কিছু নারী সংগঠন তথা সাধারণ মানুষকে। এই মামলার সূত্রেই ২০১৩-র আইনটি পাশ হয়। এটাই ভাঁওরির সবচেয়ে বড় জয়। তিনি ইংরেজি-শিক্ষিত নন, তাই হয়তো #মিটু বলতে পারেননি, কিন্তু তাঁর সাহসকে শ্রদ্ধা জানাতেই হয়। মেয়েদের মুখ খোলাটা যে কতটা জরুরি সেটা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। এবং তাঁর কাহিনি বার্কের অনেক আগের।

পরিবারের কোনও আত্মীয়ের দ্বারা যৌন লাঞ্ছনার অভিজ্ঞতাও প্রায় সব স্তরেরই কিছু নারীর রয়েছে। প্রশ্নটা নারী-পুরুষের মধ্যে কে ভাল কে খারাপ, তার নয়। মানসিকতার দিক থেকে অনেক নারীও অনুত্তমা কিন্তু এহেন লাঞ্ছনা যে নারীর ক্ষেত্রেই ঘটে, এটা নিশ্চয়ই মানবেন সমাজের প্রকৃত পুরুষেরা। ‘পুরুষ’ শব্দটি অত্যন্ত ইতিবাচক মানে রাখে। আমরা বিশ্বাস করি, যারা নারীদের দৈহিক ভাবে লাঞ্ছিত করে তারা পুরুষের মতো দেখতে হলেও আসলে পুরুষ নয়, দুর্বৃত্ত মাত্র। প্রকৃত পুরুষ সংখ্যায় এখনও বেশি বলেই নারীরা অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তাও পান। স্বাধীন ভাবে কাজও করতে পারেন। দুর্বৃত্তায়ন রোধ করা গেলেই সার্বিক ভাবে নারীরা নিরাপদ হবেন।

#মিটু আন্দোলনটি কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে শুরু হয়। মেয়েরা কি পরিবারের মধ্যেও সুরক্ষিত? ‘যৌনদাসী’ কথাটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় একটি পরিচিত প্রসঙ্গ। সমাজ নিজের স্বার্থে নারীদের সাধ্বীর মোড়কে মুড়ে দেখিয়েছে। স্বামীর সর্বক্ষণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেন যে নারী তিনিই সাধ্বী তথা সতী। অন্যথায় তিনি স্বৈরিণী। স্বামীর ইচ্ছে হলে তৎক্ষণাৎ তাঁর শয্যাসঙ্গিনী হতে হবে। তাঁকে না বলা মানে তো ধৃষ্টতা নারীর পক্ষে! নারীর তো কোনও ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই! কবি কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যে ‘স্বাধিকারপ্রমত্ত যক্ষ’ নির্বাসিত হয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু সংসারের কামুক পুরুষের তেমন নির্বাসনের রীতিকে হাস্যকর মনে করে আজকের সমাজ। আইন থাকে তালাবন্ধ হয়ে।

আমাদের সমাজে শুধু মাত্র প্রান্তিক নারীরাই নন, বহু শিক্ষিত অভিজাত নারীও অনেক সময়ে এগিয়ে এসে বলতে পারছেন না #মিটু। সঙ্কোচ বোধ করছেন। শুধু মাত্র শরীর স্পর্শ করাই নয়, এক জন নারীর উদ্দেশে কুরুচিকর বা যৌনতা-নির্ভর মন্তব্য করাটাও শাস্তিযোগ্য। কিন্তু অনেকেই এ হেন আইন বিষয়েও অজ্ঞ। কোথায় কী ভাবে অভিযোগ দায়ের করা যায়, সেটাও তাঁরা জানেন না। জানলেও তাঁরা সামাজিক লজ্জায় কুঁকড়ে থাকেন, ফলে অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

#মিটু আন্দোলন সে দিনই সার্থক হবে যে দিন লাঞ্ছিত মেয়েরা অনায়াসে প্রকাশ করবেন তাঁদের অভিজ্ঞতা। কোনও রকম সামাজিক বাধা তাঁদের সামনে আসবে না। ভাঁওরি দেবী যে সাহস দেখাতে পেরেছেন, সার্বিক ভাবে মেয়েরা তা দেখাতে পারলে সমাজ অনেকটাই অপরাধমুক্ত হবে। সঙ্গের

(শেষ)

বাংলা বিভাগীয় প্রধান, শ্রীপৎ সিংহ কলেজ

Bhanwari Devi Sexual Assault Sexual Harassment ভাঁওরি দেবী
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy