Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
ইট-বৃষ্টির মধ্যেই শুরু হয়ে গেল ড্রাই ডোল

মাঝে কাঁটাতার, ভারী বুটের প্রহরা, ও পারে পাকিস্তান

মাঝে কাঁটাতার, ভারী বুটের অনর্গল প্রহরা, ও পারে পাকিস্তান। দু’দেশের টানটান সম্পর্কের ইতিহাসে মাথা গুঁজে নৈসর্গিক রাজ্য কাশ্মীর, দু’দেশের সম্পর্কে তার ভূমিকাই খুঁজলেন প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, অভিজাত, সফল ও সম্পন্ন মুসলিম শিল্পপতি শ্রেণির প্রতিনিধি হিসপানি ও আব্দুর রহমান সিদ্দিকি ছিলেন মোহাম্মদ আলি জিন্নার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও মুসলিম লিগের নেতা।  তারা প্রায়ই বলতেন, হিন্দু মাড়োয়ারি বানিয়াদের প্রভাবাধীন ভারতে মুসলমানরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না, আর্থিক সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে না। 

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৯ ০২:২৯
Share: Save:

কাশ্মীরে বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পর সংঘর্ষ-পাথর ছোড়াছুড়ি-—পুলিশের ঘন ঘন টহল-ছড়রার আঘাত-কার্ফু—নিয়ে অশান্ত ছিল কাশ্মীর উপত্যকা। ঈদের নমাজ হয়নি সে বার। বাজার বসেনি, কেনাকাটা হয়নি। দেখুন এক বার এর পশ্চাৎভূমিতে আছে কারা। কে বা কারা তালগোল পাকিয়ে দিতে চায়। পাক-ভারত সম্পর্কের ইতিহাসে রক্তেভেজা এইসব পাতাগুলি মনে রাখার মত।

তাই স্মরণে আনতে ইচ্ছে করে, ভারত ভাগ কি অনিবার্য ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্ররোচনায় পাক-ভারত উপমহাদেশের পুঁজিপতি শ্রেণী তো ভারত ভাগ করেছে। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, অভিজাত, সফল ও সম্পন্ন মুসলিম শিল্পপতি শ্রেণির প্রতিনিধি হিসপানি ও আব্দুর রহমান সিদ্দিকি ছিলেন মোহাম্মদ আলি জিন্নার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও মুসলিম লিগের নেতা। তারা প্রায়ই বলতেন, হিন্দু মাড়োয়ারি বানিয়াদের প্রভাবাধীন ভারতে মুসলমানরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না, আর্থিক সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে না। তাদের জন্য স্বতন্ত্র খেলার মাঠ (পৃথক রাষ্ট্র) দরকার। অপর দিকে, গান্ধীজির ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতি বিড়লা ১৯৩৮ সাল থেকে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ এর কথা বলে আসছেন। ১৯৪৫ সালে টাটা কোম্পানির ম্যানেজমেন্টে দুই সদস্য হোমি মোদী ও জন মাথাই তাদের প্রতিবেদনে পাকিস্তান গঠনকে একটি প্রত্যাশিত পদক্ষেপ বলেই মন্তব্য করেন। প্রতিযোগিতা এড়ানোর তাগিদেই দুই সম্প্রদায়ের পুঁজিপতিরা ভারত বিভাজন চেয়েছিলেন। সেই পরিস্থিতি তৈরি করতে পাক-ভারত উপমহাদেশের মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণীর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।

অনুরূপ পরিস্থিতি দেখা যায় আধুনিক কাশ্মীরের জম্মু কাশ্মীরের ভূমি ও বনজ-সম্পদ নির্ভর হিন্দু রাজতন্ত্র ও পুলিশ সেনাবাহিনী প্রশাসনের ওপর তলায় প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ অনুগত হিন্দু আমলাতন্ত্র আধুনিক কাশ্মীরের রাজনৈতিক ক্ষমতার নির্ণায়ক শক্তি (পড়ুন মেধা ও বিত্তের ন্যায় শ্রেষ্ঠ সম্পদের অধিকারী কাশ্মীরি পণ্ডিত শ্রেণি)— এ বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না। কিন্তু একই সময়ে শালের বয়ন শিল্প, ব্যবসা, কাঠের ব্যবসা ও ব্রিটিশ ঠিকাদারদের সহায়ক শক্তি হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের মধ্যে থেকে উদীয়মান মুসলিম বুর্জোয়া শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে (পড়ুন শেখ আব্দুল্লাহ- বকসি গোলাম মোহাম্মদ অন্যরা)। গত ৭০ বছরের ডাল লেকে জল অনেক গড়িয়েছে। অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব আর সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব কোন কোন সময় মিলেমিশে একাকার হয়ে জটিল পরিস্থিতি করেছে। এই পন্ডিত শ্রেণির পুনরুত্থানের জন্য বিজেপি সরকার ক্লাস্টার অফ ফ্ল্যাট তৈরি করার পরিকল্পনা নিচ্ছে। প্রাক্তন সেনা প্রধান ও অফিসারদের জন্য নতুন ইন্দ্রপুরী তৈরির পরিকল্পনা হচ্ছে। সামনে নিরাপত্তা বলয়ের নামে একটা উদ্যোগ, কাশ্মীরে নিরাপত্তা বলয়ের পশ্চাতে আমেরিকা- অনুপ্রাণিত কর্পোরেট হাউস থাকবে। মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি শ্রেণির প্রভাব কে ঠেকাবে?

এই ধারাবাহিক উত্তাপ-উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে ভারত সরকার দুটো কাজ করেছে: (এক) কাশ্মীরের জনগণকে ড্রাই ডোল দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতে চেয়েছে, ড্রাই ডোল দিয়ে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করা যায় না। (দুই) ‘র‍্যাফাল’ দিয়ে সজ্জিত উন্নত মানের সামরিক বাহিনী দিয়ে কাশ্মীর উপত্যাকায় নিয়ন্ত্রণ মজবুত রাখতে চাইছে। কিন্তু কোনভাবেই ক্ষুধার্ত কাশ্মীরি ভাই বোনেরা বিদ্রোহের পথে পা বাড়ালে তাকে ফিরিয়ে আনতে পারছে না। গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার কাশ্মীরের স্কুলের ছাত্ররা কেন হাতে পাথর তুলে নেয়? সেখানে জঙ্গি সংখ্যা বাড়ছে কেন? সাইবার ক্রাইম এর সংখ্যা বাড়ছে কেন? জঙ্গিবাদের প্রতি তারা আকৃষ্ট হচ্ছে কেন? গত কয়েক বছরে ভারতের অন্যত্র সন্ত্রাস স্তিমিত হয়ে আসছে। অথচ কাশ্মীরে তা বাড়ছে কেন? একটা পরিসংখ্যানে দেখা যায় জঙ্গির সংখ্যা ২০১৫ ছিল ৬৬। ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয় ৮৮। ২০১৭ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১২৬, আর ২০১৮ তে তা হয় প্রায় ২০০। (সূত্র: আনন্দবাজার ২১শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯)। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আর গ্রেটার সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ঘটালে বা এমনকি যুদ্ধ বাধলেও কাশ্মীরে জঙ্গি প্রবণতা কমানো যাবে না। কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলা যায়—‘‘যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা, যুদ্ধ মানে তোমার প্রতি আমার অবহেলা।’’

সুতরাং যুদ্ধ নয়। নদীর জল বন্ধ করার হুমকি দিয়ে সমস্যার সমাধান হতে পারে না। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ বা অচল করার মাধ্যমে সমস্যা আরও বাড়বে। পিপল টু পিপল কন্ট্রাক্ট অক্ষুণ্ণ রেখে ভিন্ন পথের সন্ধান করা দরকার। জঙ্গি যত বাড়বে পাকিস্তান তাদের তত মদত দেবে। পাক-ভারত সম্পর্ক তার ফলে তত তিক্ত হবে।

তবু কাশ্মীর সহনশীল সংস্কৃতির তীর্থ, ইসলাম- বৌদ্ধ-হিন্দু- শৈব সংস্কৃতির বহুমুখী সমন্বয়ের তীর্থক্ষেত্র গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কাশ্মীরের সুফি মতবাদের অবদান অপরিসীম। অতীতে বীর যোদ্ধারা রাজা-সম্রাটেরা ভারতের স্নিগ্ধ সুফি সন্তের কাছে নতজানু হয়েছে। আগামীতে বন্দুকের নল শান্তির বাণীর কাছে স্তব্ধ হয়ে যাবে। পাকিস্তানের সংস্কৃতির সাথে তার মিলন সম্ভব নয়। ভারতের সুমহান সংস্কৃতির সঙ্গেই কাশ্মীরের সহাবস্থান সম্ভব। আর সে জন্যই পাকিস্তান কাশ্মীরকে সন্ত্রস্ত ও বিচ্ছিন্ন করতে চায়। পাক- ভারত সম্পর্কে সেটাই সবচেয়ে বড় বাধা।

মত লেখকের নিজস্ব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE