প্রতিবেশীদের সহিত কূটনীতির ময়দানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী খেলিতে নামিয়াই শতরান করিতে চাহিয়াছিলেন। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ কেবল ইতিহাস রচনা করে নাই, নূতন সম্ভাবনাও সৃষ্টি করিয়াছিল। আজ সেই চিত্রপটটি উত্তরোত্তর ছিন্ন হইতেছে। শ্রীলঙ্কায় তামিল নিধনের তদন্তকে কেন্দ্র করিয়া এক দিকে সে দেশের সরকার এবং অন্য দিকে তামিল রাজনীতি, এই দুইয়ের টানাপড়েন সামলাইতে দিল্লিকে যথেষ্ট কাঠখড় পুড়াইতে হইয়াছে। নেপালের নূতন সংবিধানকে কেন্দ্র করিয়া মধেশীয় বিক্ষোভ এবং ভারত নেপাল সীমান্তে অবরোধের পরিণামে দুই দেশের সম্পর্কে তিক্ততা বাড়িতেছে। ইতিমধ্যে মলদ্বীপে নূতন মেঘ। ভারত মহাসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রটিতে অস্থিরতা বাড়িতেছিল, অবশেষে জরুরি অবস্থা জারি হইয়াছে। গত মার্চ মাসে ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট মহম্মদ নাশীদ কারারুদ্ধ হইবার পরে ভারত উষ্মা প্রকাশ করে, নরেন্দ্র মোদী সফর বাতিল করেন। অথচ এখন জরুরি অবস্থা জারির পরেও দিল্লি নীরব। দিল্লীশ্বররা ভারত মহাসাগরের জল মাপিতেছেন। কেন এই অতিসতর্কতা?
উত্তর: চিন। মলদ্বীপে চিনের ভূমিকা দ্রুত প্রবল হইতে প্রবলতর। এত দিন মলদ্বীপে বিদেশিদের জমি কিনিবার অনুমতি ছিল না। এ বছরের জুলাই মাসে সে দেশের আইনসভায় কার্যত সর্বসম্মতিক্রমে একটি আইন পাশ করিয়া সেই অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। সমুদ্র ভরাট করিয়া নূতন ভূমি উদ্ধার করিয়া সেখানে প্রকল্প নির্মাণ করিলে ওই জমির মালিকানা অন্য দেশের বিনিয়োগকারীও পাইবেন। বিশ্ব উষ্ণায়নে বিলীয়মান এই দ্বীপরাষ্ট্রের পক্ষে এই আইনের গুরুত্ব বিরাট। ইহা চিনের পক্ষে বড় সুযোগ। চিন কেবল বিপুল বিনিয়োগের সামর্থ্যই রাখে না, সমুদ্র হইতে জমি উদ্ধারের প্রযুক্তিতে তাহারা বিশেষ অগ্রসর। চিন ভারত মহাসাগরে শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টা চালাইতেছে, মলদ্বীপ সেই কারণেই বেজিংয়ের নিকট মূল্যবান। প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে চিন ঘুরিয়া গিয়াছেন, চিনা রাষ্ট্রপ্রধানের এই প্রথম মলদ্বীপ সফর। লক্ষণীয়, নাশীদের কারাদণ্ডের সময়েও চিন সমালোচনা করে নাই, বরং নূতন সরকারের সহিত সুসম্পর্ক রচনা করিয়াছে। ভারত জরুরি অবস্থার প্রতিবাদ করিলে ইয়ামিন বেজিংয়ের দিকে আরও ঝুঁকিতে পারেন। সুতরাং মোদী সতর্ক।
চিনের ছায়া কেবল মলদ্বীপে নহে, অন্য প্রতিবেশগুলিতেও প্রকট। ইহা তাত্পর্যপূর্ণ যে, ভারতসীমান্তে অবরোধে বিপন্ন নেপালের ‘পাশে দাঁড়াইতে’ চিন সাগ্রহ পদক্ষেপে অগ্রসর হইয়াছে। এই প্রথম নেপাল চিন হইতে পেট্রোলিয়ম আমদানি করিতেছে। এই বাণিজ্য কার্যত প্রতীকী মাত্র। নেপাল ও চিনের সীমান্ত অতি দুর্গম। নেপালের পক্ষে ভারত ভৌগোলিক কারণেই অপরিহার্য। কিন্তু কূটনীতিতে প্রতীকের মহিমা অপার। ভারতকে এখন নেপালের সহিত সম্পর্কে নূতন তিক্ততা দূর করিবার জন্য বাড়তি উদ্যোগ করিতে হইবে। শ্রীলঙ্কায় চিনের বিনিয়োগ বিস্তর, ভবিষ্যতে সামরিক ঘাঁটি তৈয়ারির সম্ভাবনাও উড়াইয়া দেওয়া যায় না। বস্তুত, ভুটান এবং বাংলাদেশকে বাদ দিলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলিতে বেজিংয়ের ছায়া রীতিমত ঘনঘোর, ইদানীং তাহা ঘোরতর। নেপাল ও মলদ্বীপের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি প্রমাণ করিতেছে, এই ছায়ার মোকাবিলায় দিল্লির আরও অনেক বেশি দক্ষ ও দূরদর্শী হওয়া প্রয়োজন। ছায়ার সহিত যুদ্ধ সর্বদা সহজ নহে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy