Advertisement
১১ মে ২০২৪

জাতির ভবিষ্যৎ যারা, তাদের বিষয়ে জাতির ভাবনা ঠিক কী?

পরিবারের কাঠামো বদলেছে। বদলে গিয়েছে সময়ও। বহু ক্ষেত্রেই আজ অবসাদ আর হতাশার শিকার শিশুরা। লিখছেন পাপড়ি গুহ নিয়োগীআজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।  শিশুদের মধ্যেই থাকে ভবিষ্যতের কবি, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক ইত্যাদি বিভিন্ন প্রতিভা। তবে আমাদের দেশের  বেশির ভাগ শিশু উপযুক্ত পরিবেশ থেকে বঞ্চিত।

প্রতীকী চিত্র।

প্রতীকী চিত্র।

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৯ ০৪:৫১
Share: Save:

এই সময়ের কিছু অভিভাবকের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই শিশুদের একা করে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সামান্য টিফিনটুকুও ভাগ না করে খাওয়ার কথা শেখানো হচ্ছে তাদের। যা নিজেদের অজান্তে নিজেদের কবর খোঁড়ার মতো হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শিশুরা নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। তারপর পারিবারিক অশান্তি। স্কুলগুলোয় ক্রমেই শিশুদের উপর চাপ বাড়ছে। তার অনেকটাই কারণ অতিরিক্ত সিলেবাসের বোঝা। অভিভাবকদের চাপ তো রয়েইছে। শুধু কি পড়ার চাপ? গান শেখা, নাচ শেখা, সাঁতার, ছবি আঁকা, আবৃত্তি ক্যারাটে, দাবা, ক্রিকেট ইত্যাদি।

শিশুর স্কুলের ব্যাগ এখন এতটাই ভারী থাকে যে, শিশুর পক্ষে তা বহন করা সম্ভব হয় না। এক সময় অসুখ বাঁধিয়ে ফেলে। এর ফলে ক্ষয়ে যাচ্ছে শিশুদের শরীর ও মন। শিশুদের মেরুদণ্ডের স্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে। যেটুকু অবসর পাওয়া যায়, তা চলে যায় কম্পিউটার গেম, কার্টুন বা টিভি দেখায়। যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে গিয়ে গড়ে উঠেছে একক পরিবার। ছেলেমেয়েদের সময় দিচ্ছেন না অভিভাবকেরা। নগরজীবনের এই বাস্তবতায় এ সব পরিবারের শিশুরা দীর্ঘ সময় একা একা কাটাচ্ছে। শিশুর হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিয়ে খাবার খাওয়ানো বা কান্না থামানো অভিভাবকদের নতুন চল। বিলাসিতা স্বরূপও স্মার্টফোন কিনে দিচ্ছেন অনেকে। আমরা জানি, শিশুরা অনুকরণপ্রিয়, তাদের সামনে যা করি আমরা, তাই তারা শেখে। আবার আমরা যা শেখাই, তাই শেখে। পরবর্তী কালে এই একাকীত্ব দূর করতে শিশুরা জড়িয়ে যাচ্ছে অনলাইন আসক্তিতে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী মানসিক রোগ বাড়ছে শিশুদের মধ্যে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আবার একটু

বড় হয়েই বা শৈশবেও হতাশ হয়ে জড়িয়ে পড়ছে নেশার সঙ্গে।

বর্তমানে এই ব্যস্ততম সময়ে প্রায় সব পরিবারেই পারিপার্শ্বিক সম্পর্ক তেমন ভাল না। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের ঘটনায় শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেমন, মা-বাবার ঝগড়ার প্রত্যক্ষদর্শী অনেক শিশু নানা অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকে। তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে, যা থেকে তারা পরবর্তী কালে হিংস্র বা অপরাধমূলক আচরণ করতে পারে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞেরা আরও বলেন, মানসিক অস্বাভাবিকতা হলে পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্যকে সময় দিতে হবে। বুঝতে এবং বোঝাতে হবে যে, তার গুরুত্ব পরিবারে অনেকটাই বেশি। শিশুর মানসিক বিকাশে মা-বাবার ভালবাসার কোনও বিকল্প নেই। মা-বাবার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক শিশুর মধ্যে নিরাপত্তাবোধ জাগায়। মা-বাবাকে তাই শিশুর মানসিক বিকাশে ভূমিকা রাখতে হবে। পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে বলতে হবে এবং বোঝালে শিশু সে অবশ্যই বুঝবে।

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশুদের মধ্যেই থাকে ভবিষ্যতের কবি, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক ইত্যাদি বিভিন্ন প্রতিভা। তবে আমাদের দেশের বেশির ভাগ শিশু উপযুক্ত পরিবেশ থেকে বঞ্চিত। খেলার জন্য পর্যাপ্ত মাঠ নেই, শিল্পকলা এবং সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ নেই। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য মুক্ত বাতাসে খেলাধুলো ও বিনোদন নেই। খেলার সাথি নেই। একটি শিশুকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তার শারীরিক বৃদ্ধির পাশাপাশি মানসিক বৃদ্ধি বা মনের বিকাশেরও সমান সুযোগ করে দিতে হবে। শিশুদের সময় দিতে হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তি শিশুদের জীবনে ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে। তাই শিশুরা সহজেই মানসিক চাপে ভেঙে পড়ে এবং তাদের মধ্যে ভীতি, অবসাদ বা হতাশাজনিত অসুখ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

একটি শিশুর মানসিক, শারীরিক বা সামাজিক গঠনের জন্য তার পরিবার বা পারিবারিক পরিবেশ যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার সমান গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে তার বিদ্যালয়েরও। মা-বাবার পর যাঁদের কাছে সব চেয়ে বেশি সময় থাকে শিশুরা, তাঁরা হলেন স্কুলের শিক্ষক। একই ভাবে স্কুলের সহপাঠীদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। তাই শিশুদের মধ্যে বিদ্যালয়ের পরিবেশ এবং শিক্ষক ও সহপাঠীদের প্রভাব পড়ে। মানবজীবনে শেখার সব চেয়ে উৎকৃষ্ট সময় যেহেতু স্কুলজীবন, তাই শিশুদের স্কুল নির্বাচনের আগে সেই সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়াটা জরুরি। বাড়িতে যেমন বাবা-মা বা অন্যান্য গুরুজনেরা শিশুর অভিভাবক, স্কুলে সেই দায়িত্ব শিক্ষকদের হাতে। ভারতীয় সভ্যতায় শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যেকার সম্পর্কের ঐতিহ্যময় ইতিহাস আছে। বাবা মা-সন্তানের সম্পর্কের মতো ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কও এক সুন্দর সম্পর্ক। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক হওয়া উচিত অভিভাবকত্বের এবং বন্ধুত্বের। এটা ভুলে চলবে না যে, এক জন সফল মানুষের পিছনে শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। শুধু বইয়ের শিক্ষায় নয়, জীবনের পাঠেও দীক্ষিত করেন আমাদের শিক্ষকেরা। একটি সভ্য দেশে জাতি গঠনের কারিগর শিক্ষকেরাই তাই শিক্ষক ও অভিভাবকদের মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষা ও বিকাশ সম্ভব নয় কোনও ভাবেই।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Depression Loneliness Infant Suicide Crime
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE