Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Digital Revolution

একাকিত্ব ছিল ক্রিয়েটিভিটির আঁতুড়ঘর, বিদ্রোহেরও, ইন্টারনেট তা মুছে দিয়েছে

হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীতে একাকিত্ব ছিল, তার যন্ত্রণা ছিল। বিরলে নিজের সঙ্গে অনেক অনেক কথা ছিল। ক্ষোভ অভিমান ছিল। আত্মরতি ছিল। জন্ম নিত নিজেকে বলার গল্প, নিজেকে শোনানোর কবিতা, গান। লিখছেন পার্থপ্রতিম মৈত্র

পার্থপ্রতিম মৈত্র
শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৮ ১১:০০
Share: Save:

অফিস আওয়ার্সে মেট্রোয় সিট পাওয়া লটারি পাওয়ার মতো। সে দিন বেড়ালের ভাগ্য সঙ্গে ছিল। বসে পড়তে পারলেই আমার ঘুম পায়। একা একা শহরের অন্য প্রান্তে যাওয়ার সময়টা আমি ব্যবহার করি নিজের সঙ্গে কথা বলে। সেই সময়ই দৃশ্যটা চোখে পড়ল। আশেপাশের প্রায় প্রত্যেকটা লোকের হাতে মোবাইল ফোন। কথা বলছে, গান শুনছে, গেম খেলছে, চ্যাট করছে, নানাবিধ কাজে ব্যস্ত তারা। পাশের লোক, কামরা ভর্তি লোকের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।

মনে পড়ল আমার ছেলেও ঠিক এমনি করে। বাসের জানালার ধারে বসে বাইরের দিকে ফিরেও তাকায় না। তখনও স্মার্টফোনের স্ক্রিনে চোখ সেঁটে আছে। বিশ্ব বলতে কিছু নেই, অথবা হাতের মুঠোয় ধরা রয়েছে বিশ্ব।

আমার ছেলের এ বার উচ্চমাধ্যমিক হবে। স্কুল এবং বন্ধুদের নিয়ে সে খুশি। ঘন ঘন পরীক্ষা নেওয়া ছাড়া স্কুলের বিরুদ্ধে তার কোনও অভিযোগ নেই। পাঠ্য বিষয়ক যেটুকু শেখার সে স্কুল থেকেই শেখে। বা নিজে পড়ে। পড়ার বিষয়ে স্কুল তাকে সাবলম্বী করে দিয়েছে। ছেলের কোনও প্রাইভেট টিউটর নেই। প্রয়োজনও নেই। ওর ধারণায় ইন্টারনেট ঘেঁটে যথেষ্ট ইনপুট পাওয়া সম্ভব। ও-ই বলে, বিজ্ঞান বুঝতে থ্রিডি অ্যানিমেশন ছাড়া অসম্ভব।

—ইউটিউবে সার্চ দিলে সব পেয়ে যাই। একটা পাঠের জন্য অনেকগুলো দৃষ্টিকোণ পাই। বার বার করে দেখতে পারি বোঝার জন্য, শেখার জন্য। কোন টিউটর আমাকে এতটা সময় দেবে? আর শুধু টিউব কেন? স্কুলের গুগল ক্লাসরুম রয়েছে। বিষয়ভিত্তিক এক একটা ক্লাস। তোমাদের যুগের মতো স্যারের নোট ফটোকপি করার ঝামেলা নেই। স্কুলটিচাররা ক্লাসরুমে নোট আপলোড করে দেন, তুমি ডাউনলোড করে নাও। টিচারকে প্রশ্ন করতে পারো, তিনি সময় মতো উত্তর দিয়ে রাখবেন। ডিসকাশনও করে নিতে পারো কো-স্টুডেন্টদের সঙ্গে। আর যদি তোমার আরও এগোবার ইচ্ছে থাকে তবে খান অ্যাকাডেমির মতো অসংখ্য এজুকেশনাল সাইট রয়েছে। বিষয়ভিত্তিক সাইট রয়েছে। কোনও একটাতে ঢুকে পড়ে, জেনে নাও যত প্রাণ চায়। অনেক সাইট, স্টুডেন্টের ক্ষমতা ক্যালকুলেট করে সেই অনুযায়ী ইনফরমেশন দেয়। শুধু স্টুডেন্ট নয়, বাবা-মায়ের জন্যও আলাদা গ্রুপ আছে। সেগুলিতে তো সাবস্ক্রাইব করতে পারো। ছেলেমেয়েদের সাইকোলজিকাল ট্রেন্ড সম্বন্ধেও প্রচুর ইনফরমেশন থাকে। আর কিছু দিন বাদে দেখবে ছেলেমেয়েরা বাড়িতেই লেখাপড়া করবে। স্কুলের কাজ হবে শুধু পরীক্ষা নেওয়া।

—কিন্তু এ ভাবে মানুষের জ্ঞানও তো শুধুমাত্র ইনফরমেশন ভিত্তিক হয়ে যাচ্ছে। ভারচুয়াল, বায়বীয়। একটা বই-এর যে স্পর্শ, অক্ষরগুলোর ওপর দিয়ে আঙুল বোলানোর যে তৃপ্তি তা তোরা পাচ্ছিস কোথায়? জানিস নতুন বই হাতে এলে আমরা প্রাণ ভরে তার গন্ধ নিতাম। এই যে আমার ঘর ভর্তি স্তূপাকৃতি বই, আমার তিলে তিলে গড়ে তোলা লাইব্রেরি তোরা তো কেউ ফিরেও দেখিস না। হোর্হে লুই বোর্হের ‘দ্য লাইব্রেরি অব বেবেল’ তো পড়িসনি। লাইব্রেরি হচ্ছে ব্রহ্মাণ্ড। বোর্হে তার সর্বজনীন লাইব্রেরির একটা বিবরণ দিয়েছেন ঐ গল্পে। লাইব্রেরিতে অসংখ্য বই, অসংখ্য পৃষ্ঠা এবং সম্পূর্ণ অর্থহীন পৃষ্ঠাগুলিও থাকবে। মানে যার মধ্যে প্রত্যেকটি বাক্যাংশ এবং প্রতিটি শব্দ যা লেখা হয়েছে এবং যা লেখা হতে পারে। মানব সভ্যতা বেঁচে থাকবে ওই লাইব্রেরিতে।

—তুমি ঐ পর্যন্ত পৌঁছেই আটকে গেছো। তোমাদের জেনারেশনের জন্য, বেবেল লাইব্রেরি ছিল কল্পবৈজ্ঞানিক কাহিনী মাত্র। তুমি এটা জানো না যে— প্রায় আমার বয়সী একটা ছেলে তার নাম বাসিল, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, দেখেছিলেন যে কম্পিউটার দিয়েই আসলে আমাদের দর্শনের বাস্তবতার বাস্তবায়ন সম্ভব। বাসিল ছয় মাস ধরে তাঁর গ্রন্থাগার তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। দুর্ভাগ্যবশত, তিনি আবিষ্কার করেছেন যে সমগ্র মহাবিশ্বের ডেটা স্টোর করার জন্য যে পরিমাণ ডিজিটাল স্টোরেজ প্রয়োজন সেটা তার অনায়াত্ত। এমনকি এই সীমাবদ্ধতার সাথেও, তিনি গণনা করেছিলেন যে ‘বইগুলি’র সংখ্যা প্রায় ১০ টু দ্য পাওয়ার দুই মিলিয়ন এর কাছাকাছি হবে। একবার libraryofbabel.info-তে সেই লাইব্রেরির খসড়া দেখে এসো।

—কিন্তু এতো শুধু তথ্যভাণ্ডার, এর মধ্যে দর্শন কোথায় ? তোদের জেনারেশনের তো ওটাই প্রবলেম। শুধু ইনফরমেশন। জ্ঞান মানে তো শুধু নিরস তথ্য নয়। বায়বীয় তথ্য নয়। এই যে হিউম্যান টাচ, শিক্ষকের ভালবাসা কিংবা ক্রোধের ছোঁয়া, এ সব বাদ দিলে জ্ঞান অসম্পূর্ণ থাকে। সত্যি-মিথ্যা বিচারের ক্ষমতা বিলোপ। অ্যাতো মেকানিজম ডেভেলপ করেছে, কিন্তু ফেক আর রিয়্যালের তফাত করার মেকানিজম আজও ডেভেলপ করল না। একটা কথা সব সময় মনে রাখবি, আমাদের ইন্টারনেট বিহীন শিক্ষায় শিক্ষিত জেনারেশনই এখনও তোদের ইন্টারনেট প্রজন্মকে চালনা করছে। কী পড়বি, কী দেখবি, কী পরবি, কী খাবি, কী চড়বি... পুরো নিয়ন্ত্রণটাই আমাদের নেটহীন প্রজন্মের হাতে। যখন তোদের জেনারেশন কন্ট্রোল নেবে, তখন দেখা যাবে পৃথিবী রূপ পরিবর্তন করে কিনা।

—তোমাদের সময় জ্ঞান কী ছিল? বায়বীয় ছিল না? অক্ষর মানেই তো অ্যাবস্ট্রাকশন। শিক্ষকের ভালবাসা কিংবা ক্রোধের ছোঁয়া, হিউম্যান টাচ, যত হিউম্যান বিয়িংকে পড়াশুনায় সতৃষ্ণ করেছে, তার চেয়ে ঢের বেশি সংখ্যককে বিতৃষ্ণ করে তুলেছে। আর তোমাদের আইডল মাও-জে-দং বলেননি প্রয়োগবিহীন জ্ঞান অর্থহীন? তোমাদের সময়ে ফিজিক্সে মাস্টার্স করে কতজন ব্যাঙ্কে চাকরি করছে তার ডেটা আছে? আসলে জানতেই না পড়াশুনা ছাড়াও আরও কিছু করার আছে। আমাদের জেনারেশন এটুকু অন্তত জানে— যা ভাল লাগে তা অর্জন করতে কী করতে হয়। জীবন এখন তোমাদের মতো ওয়ান ডায়মেনশনাল নয়, মাল্টি ডাইমেনশনাল। এ সব আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। আমাদের জেনারেশন ক্ষমতায় এলে কী হবে জানি না, ভাবিও না।

মেট্রোর সহযাত্রীরা প্রত্যেকে ডুবে আছে তাদের নিজ নিজ মহাবিশ্বে। তারা বাস্তবে একা, কিন্তু আসলে একা নয়। আন্তর্জালের ম্যাজিক রিয়্যালিটিতে। কখন এমন পরিব্যাপ্ত হল ইন্টারনেট? জালের মধ্যে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে একটা সভ্যতাকে! ভারচুয়াল আর রিয়্যালের মধ্যে দৃশ্যমান ব্যবধান ঝাপসা হয়ে আসছে। একা থাকার সময়টুকুও খেয়ে নিচ্ছে নেট। ইন্টারনেট যুগে একাকিত্বের যন্ত্রণা ঘুচে গেছে। যখনই একা লাগবে, নেট খুলে বসো, গান শোনো, সিনেমা দেখো, নিউজ পোর্টালে ঢুকে পড়ো, ব্রাউজ করো, মেল করো, ই-কমার্সের কাজ সারো ঘরে বসে। সব শেষে বা সব কাজের ফাঁকে স্যোশাল মিডিয়ার ভারচুয়াল পৃথিবী তো রয়েইছে। পাঁচ হাজার ভার্চুয়াল বন্ধু। সঙ্গে কয়েক সহস্র ফলোয়ার। তোমার একাকিত্বের সময় কোথায়? এখানে ‘কাউকে চেনো না তুমি, তোমাকে চেনে না কেউ, এই তো ভাল...’।

হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীতে একাকিত্ব ছিল, তার যন্ত্রণা ছিল। বিরলে নিজের সঙ্গে অনেক অনেক কথা ছিল। ক্ষোভ অভিমান ছিল। আত্মরতি ছিল। জন্ম নিত নিজেকে বলার গল্প, নিজেকে শোনানোর কবিতা, গান। নিজেকে জানা। আর ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না’। ইন্টারনেট একাকিত্ব মুছে দিয়েছে। মেটা ন্যারেটিভ আর গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ-এর যুগ ফিরে আসছে। মানুষ ছাঁচে ঢালা হয়ে উঠছে। হোমোজেনিয়াস। শক্তিশালী কেন্দ্র ক্রমশ প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে। সবজান্তা গুগল তথ্যভণ্ডার এনে দিয়েছে হাতের মুঠোয়। অনলাইন নজরদারিতে ব্যক্তিগত বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকছে না। এমন কোনও অ্যাপ বেরোয়নি, যা দিয়ে ফেক আর রিয়্যালের তফাত করা সম্ভব। সব ঝাপসা, বিচারবোধও। গড্ডলিকা প্রবাহে সমাজ চলমান। প্রত্যেকের এককবৃত্ত।

এত দিন একাকিত্ব ছিল সকল ক্রিয়েটিভিটির আঁতুড়ঘর। বিদ্রোহেরও। একা এবং কয়েকজন মিলেই সভ্যতার গতিপথ পরিবর্তন করতে পারত। এখন নেট গ্রাস করেছে মানুষের একাকিত্ব। গভীর নির্জন পথ হারিয়ে ফেলেছে মানুষ। হাতের মুঠোয় ধরা সেলফোনে রয়েছে যাপনের দিক নির্দেশ। এখন ব্যক্তি মানুষের বিলোপ সাধন এবং যৌথ যাপন হচ্ছে ইন থিং। এটাই কি চেয়েছিলাম আমরা? এই মণ্ড? সারা দিন কথা বলছি, কিন্তু নিজের সঙ্গে বলার মত কথা বা সময় কোনওটাই আর অবশিষ্ট নেই। সব বলে দেওয়া আছে। শুধু খুঁজে নাও আর খুঁজে পেয়ে তাকে অনুসরণ করে যাও। অনুকরণ করে যাও। ইন্টারনেট যুগে একাকিত্বের স্থান নেই। সব হাটখোলা। এখন যারা কবিতা লেখে তারাই পড়ে, যারা গান গায় তারা নিজেরাই শোনে, যারা স্বপ্ন দেখে তারা বলার মত কাউকে পায় না।

ইন্টারনেট সব দিয়েছে, বিনিময়ে নিয়েছে আমার আমিকে। আমার একাকিত্বকে। আমার একক অস্তিত্বকে। আন্তর্জালবিশ্ব থেকে শুধু কবি কেন, শিল্পীরাও নির্বাসিত। স্টাইল নির্বাসিত। এখন ফ্যাশনযুগ।

গ্রাফিক ও অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE