Advertisement
১১ মে ২০২৪
Editorial News

‘বুদ্ধিমান’ যন্ত্রেরা এ বার নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা তৈরি তো?

যন্ত্রের সঙ্গে যন্ত্র এ বার নিজেই যোগাযোগ করে নেবে, আমাদের ভবিষ্যৎ কী?সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ২৩টা দেশে ১৮,১৮০ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে, ২০১৬ সালের শেষ দিকে, অনলাইনে এই সমীক্ষা চালিয়েছিল প্যারিস কেন্দ্রিক গ্লোবাল মার্কেট রিসার্চ সংস্থা ইপসোস। লিখছেন সঞ্জীব সিন্‌হা

যার কম্পিউটার যত ‘বুদ্ধি’ ধরবে, বাজিমাত করবে তারাই।

যার কম্পিউটার যত ‘বুদ্ধি’ ধরবে, বাজিমাত করবে তারাই।

সঞ্জীব সিন্‌হা
শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৮ ১১:০০
Share: Save:

ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের সদস্যরা সমীক্ষার ফলাফলে কিছুটা চমকেই উঠেছিলেন। ভারত এখন এক নম্বরে!

সমীক্ষার বিষয় ছিল, ইন্টারনেটে আসক্ত— এমন মানুষের শতকরা হিসাবে কোন দেশ কত নম্বরে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ২৩টা দেশে ১৮,১৮০ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে, ২০১৬ সালের শেষ দিকে, অনলাইনে এই সমীক্ষা চালিয়েছিল প্যারিস কেন্দ্রিক গ্লোবাল মার্কেট রিসার্চ সংস্থা ইপসোস (Ipsos)।

দেখা যাচ্ছে, ভারত রয়েছে এক-এ। এ দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৮২ শতাংশ মানুষই ইন্টারনেটে তীব্র ভাবে আসক্ত। তাঁরা জানিয়েছেন, ইন্টারনেট ব্যবহার না করে তাঁরা থাকতে পারেন না।

দ্বিতীয় স্থানে ব্রিটেন আর দক্ষিণ আফ্রিকা। এই দুই দেশেই, ৭৮ শতাংশ করে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর কাছে, ওয়েববিহীন জীবন অতীব পানসে।

চারে চিন। ৭৭ শতাংশ। তালিকায় আট নম্বরে রয়েছে আমেরিকা। ৭৩ শতাংশ। একই র‌্যাঙ্কিং জার্মানি আর ব্রাজিলের। তালিকায় একদম শেষে, অর্থাত্ ২৩ নম্বরে আছে মেক্সিকো। তাও সেই সংখ্যা শতকরা ৫০ ভাগ। অ্যাভারেজ কষে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের এই ২৩টা দেশে সব মিলিয়ে এই শতকরা হিসাবটা ৭০ ছুঁইছুঁই।

কোনও সন্দেহ নেই, এই মুহূর্তে ইন্টারনেট বিশ্বের সব থেকে শক্তিশালী অস্ত্র। আমরা সবাই জেনে গেছি, ভবিষ্যতের যুদ্ধগুলো হবে সাইবার ওয়ার। যার কম্পিউটার যত ‘বুদ্ধি’ ধরবে, বাজিমাত করবে তারাই। যার কম্পিউটার যত তাড়াতাড়ি বিগ ডেটা অ্যানালিসিস করে বাজারের প্যাটার্ন ধরে ফেলতে পারবে, তারাই শেষ হাসি হাসবে বাণিজ্যের যুদ্ধেও। আর ঠিক সেটাই ঘটেছে।

লড়াইটা শুরু হয়ে গেছে। ‘বুদ্ধিমান’ কম্পিউটার কে আগে বানাতে পারে...

অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল

অ্যানালগ যুগ থেকে ডিজিটাল যুগে আমরা সদর্পে পা রেখেছি। টেপ, ক্যাসেট, রেকর্ড প্লেয়ার এমনকী সিডি-ডিভিডির দিনও শেষ। বই এবং কাগজ পড়ার অভ্যাস কমছে, এর পর হুড়হুড় করে কমবে বলেই ধারণা। স্মার্টফোনের মতো ডিজিটাল মিডিয়া, কিন্ডল (Kindle), ইপাব (ePUB), মোবি (Mobi)-র দাপটে মানুষের পড়ার অভ্যাসে ইতিমধ্যেই এসে গেছে বড়সড় বদল।

এটা ভাল না খারাপ? এ সব নীতির প্রশ্নকে দূরে সরিয়ে রাখলেও বলা যায়, এটা ছিল অবশ্যম্ভাবী।

কেন? উত্তর খুঁজতে গেলে, আমাদের একটু ইতিহাসের বুড়ি ছুঁয়ে আসতে হবে।

মানুষের জীবনে খুব বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে শুরু করে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের একটু আগে। ১৭৮৪তে বাষ্পচালিত রেলগাড়ি এসে প্রথম শিল্প বিপ্লবকে গতি দিল। প্রথম পাওয়ার লুমের হাত ধরে উদ্ভব হল শিক্ষিত ও অশিক্ষিত শ্রমিক শ্রেণির। মাথা চাড়া দিল ক্যাপিটালিজম। বিশ্বের মাত্র এক শতাংশ মানুষের হাতে পৃথিবীর প্রায় সব সম্পদ জমতে শুরু করল।

১৮৭০-এ ইলেকট্রিক এনার্জি সব হিসাব ফের বদলাল। পরিবর্তন হতে শুরু করল আরও দ্রুত। চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমায় আমরা প্রথম অ্যাসেম্বলি বেল্ট কনভেয়ার দেখি। কারখানার চেহারা আরও বড় হতে শুরু করে সেই সময় থেকে।

এর প্রায় ১০০ বছর পর, ১৯৭০ এর মুখে ইলেকট্রনিক্স এবং আইটি কমিউনিকেশন তৃতীয় শিল্প বিপ্লব ঘটাল। আমরা প্রথম পেলাম লজিক কন্ট্রোলার। কম্পিউটার। ফের সব হিসাব বদলাতে শুরু করল।

আর একটা জিনিসও হল। এই বদলের স্পিড কিন্তু আচমকা বেড়ে গেল। কারণ, কম্পিউটার মানুষের থেকে অনেক দ্রুত হিসাব করতেই শুধু পারে না, কম্পিউটার মানুষের অনেক কাজও করে দিতে লাগল। ফলে বুদ্ধিমান, ক্রিয়েটিভ মানুষরা আরও ভাবার সময় পেলেন। অবসর পেলেন নতুন কিছু উদ্ভাবনের।

ফলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবটির জন্য আমাদের আরও ১০০ বছর আর অপেক্ষা করতে হবে না। আশা করা যাচ্ছে, আর ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) বাস্তব হয়ে যাবে। একটি যন্ত্র আর একটি যন্ত্রের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারবে, চিন্তাও করতে পারবে, এখন যার জন্য মানুষের দরকার হয়, সেটুকুরও আর প্রয়োজন থাকবে না।

ইন্টারনেট যখন আর মানুষের নয়

হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, আগামী দশ বছরের ভিতর প্রায় ৪০ থেকে ৮০ কোটি নানা ধরনের কাজ স্রেফ আর থাকবে না। হাওয়ায় উড়ে যাবে।

যে ভাবে শিল নোড়ার দিন শেষ করে দিয়েছে মিক্সি, সে ভাবেই শ্রমিকেরা কাজ হারাবেন বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে। এর বদলি হিসাবে কাজের ধরন পুরোপুরি বদলাতে হবে প্রায় ৪০ কোটির মতো শ্রমশক্তিকে। ক’জন এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে টিকে যেতে পারবেন? যাঁরা পারবেন না, সেই বিশাল অংশটি কি সমাজে একটি বিরাট অস্থিরতার জন্ম দেবেন না?

আশার কথা, বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী মাধ্যম, যাকে এখন এক ধরনের অস্ত্র বা মারণাস্ত্রও বলা যায়, সেই ইন্টারনেটকে মানুষই এখন পর্যন্ত চালনা করছে। এখনও পর্যন্ত আমরা যা দেখছি, তাকে বলা যেতে পারে ইন্টারনেট অব পিপল। এর কোনও মালিক নেই, ফলে ক্যাপিটালিজমকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে এই ইন্টারনেট অব পিপল।

কিন্তু চিন্তার কথা হল, যা মনুষ্যচালিত ছিল এত দিন, তা আগামী দশ বছরের মধ্যে হয়ে যেতে চলেছে ইন্টারনেট অব থিংস। অর্থাৎ, মানুষের জায়গাটা নিতে চলেছে রোবট, নানা ধরনের ডিভাইস বা যন্ত্র। তারা তখন সিদ্ধান্ত নেবে। কারণ বড় বড় কোম্পানিগুলি তাদের ‘কৃত্রিম বুদ্ধি’ দিতে চলেছে। কারণ, তারা জানে, সাধারণ শিক্ষিত মানুষের হাতে এই ইন্টারনেট এক কালে তাদেরই মৃত্যুবাণ হয়ে উঠতে পারে। কার্ল মার্ক্স যা পারেননি, এই টেকনোলজিস্টরা যে তা করে ফেললেও করে ফেলতে পারেন, তা জানেন ক্যাপিটালের রক্ষকেরা। টেকনোলজিকে ব্যবসা ও যুদ্ধের কাজে না লাগিয়ে, শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের ভালর জন্যই কাজে লাগাতে পারেন এই কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা। এটা মুক্ত বাজারের প্রবক্তাদের কাছে শুভ সংবাদ নয়, কখনই।

স্টিফেন হকিংয়ের মতো বিজ্ঞানী মৃত্যুর আগে পর্যন্ত, সম্ভবত সেই কারণেই বলে গেছেন, এ ভাবে যন্ত্রকে বুদ্ধি দিও না। তার আগে ভাবো। আরও ভাবো। তিনি বলেছেন, প্রযুক্তিকে মানুষ মারার কাজে না লাগিয়ে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে কাজে লাগাও।

স্টিফেন হকিং ‘কৃত্রিম বুদ্ধি’ নিয়ন্ত্রণের পক্ষে সওয়াল করেছেন শেষ জীবন তক। কারণ, তিনি জেনে গিয়েছিলেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ের যে শিল্প বিপ্লবটি আসতে চলেছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে শেষ শিল্প বিপ্লবও হয়ে যেতে পারে। যদি তা শুধুমাত্র লোভ-তাড়িত হয়ে ওঠে।

কারণ, এই আসন্ন শিল্প বিপ্লবের বৃদ্ধি বা গ্রোথ হয়ে যাবে এক্সপোনেনশিয়াল। আগের সব কটি শিল্প বিপ্লবে এই বৃদ্ধির হার ছিল দুইকে ১০ দিয়ে গুণ করার মতো। এখন তা হয়ে গিয়েছে দুই-এর মাথায় পাওয়ার হিসাবে ১০-কে বসিয়ে দেওয়ার মতো। তফাতটা আকাশ আর পাতালের। প্রথমটি থেকে যদি পাই ২০, তা হলে দ্বিতীয়টির ভ্যালু হয় ১০২৪। মোদ্দা কথা হল, কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন যন্ত্র যদি চায়, নিমেষের মধ্যে গোটা বিশ্বকে ধ্বংস করে দিতে পারবে। তার বুদ্ধি থাকবে, কিন্তু নীতিবোধ থাকবে না। থ্রি-ডি প্রিন্টারের মতো টেকনোলজিকে কাজে লাগিয়ে তারা যত খুশি যন্ত্র তৈরি করে নিতে পারবে। তারা সম্ভবত নিজেদের মধ্যেও যুদ্ধ শুরু করে দিতে পারে। ব্যাপারটা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

যদি সেটি না ভেবেচিন্তে করা হয়, তা হলে তা হবে শুধুমাত্র বাজারচালিত লোভের তাড়নায়।


আমরা কতটা তৈরি?

ভবিষ্যতের এই ইন্টারনেটের জন্য আমরা কতটা তৈরি? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, আমরা আমাদের পরের প্রজন্মের জন্য কী রেখে যেতে চলেছি?

বড়রা ইন্টারনেট বিচার বিবেচনা করে ব্যবহার করবেন, এটা আশা করা যায়। তাঁরা ইন্টারনেটের অপার সুযোগ নিয়ে কতটা নিজের দক্ষতা বাড়াবেন, তাকে কতটা পড়াশোনার কাজে লাগাবেন, না কি পর্নোগ্রাফি দেখে সময় কাটাবেন, সেটা তাঁদের উপর ছেড়ে দেওয়াই ভাল। কিন্তু বাচ্চারা? ৮ থেকে ১২ বছরের বাচ্চারা? চিন্তাটা তাদের নিয়ে। দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালের মধ্যে কম করে ৪০ কোটি বাচ্চা ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছে। এই আসন্ন বিপদকে চিহ্নিত করা হচ্ছে সাইবার মহামারি হিসাবে।

জরুরি প্রশ্ন থাকছে বেশ কয়েকটি।

মনুষ্যচালিত সরকার কি বাজারচালিত বড় কোম্পানিগুলির এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারবেন ও টেকনোলজিকে শুধুমাত্র মানুষের ভালর কাজে লাগাতে পারবেন? না কি, তাঁরা এই সুযোগে সাধারণ মানুষের উপর আরও নজরদারি কায়েম করবেন?

আমেরিকায় একা স্নোডেন নন, একের পর এক প্রাক্তন এফবিআই (ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) ও এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি)-র কর্মী ও কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন মার্কিন সরকারের গোপন নজরদারির বিরুদ্ধে। উইলিয়াম বিনি এমনই একজন, দীর্ঘ দিন এনএসএর সঙ্গে কাজ করার পর যিনি জানিয়েছেন, কী ভাবে আমেরিকার এই গোয়েন্দা সংস্থাগুলিই সব কিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছে, স্রেফ টেকনোলজিকে অন্যায় ভাবে ব্যবহার করার সরকারি ছাড়পত্র পেয়ে।

ভবিষ্যতের ইন্টারনেট ও তার আসক্তি নিয়ে তাই একের পর এক প্রশ্নের পাহাড় জমছে।

ভবিষ্যতে টেকনোলজি, ইন্টারনেট কি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে চলেছে? কৃত্রিম বুদ্ধির মতো, এই ডিজিটাল-আসক্তিও কি কৃত্রিম ভাবেই, পরিকল্পিত ভাবেই তৈরি করা হচ্ছে? এটি কি আগের সব নেশার দ্রব্যকে হার মানাতে চলেছে? লোভের তাড়নায় আমরা কি এ বার একটু ডেটার জন্য শুকিয়ে মরব? আগের শিল্প বিপ্লবগুলি থেকে গরিবের খুব দ্রুত উপকার হয়েছে, প্রাকৃতিক সম্পত্তির ভাগ দরিদ্ররাও সমান ভাবে পেয়েছেন, এমন নিদর্শন নেই। বড়লোকদের পকেটই বেশি ভরেছে।

এই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য এত তাড়াহুড়ো কি সে জন্যই? এর পেছনে কি সেই উচ্চ ক্ষমাতাবানদেরই কারচুপি রয়েছে? না কি সত্যিই নতুন কিছু দিশা দিতে চলেছে এই আসন্ন বিপুল পরিবর্তন? দেখা যাক।

আর বছর দশেকের মধ্যেই এর উত্তর পাওয়া যাবে।

(লেখক ২০১১ সালে মাইক্রোসফটের কমিউনিটি কন্ট্রিবিউটর অ্যাওয়ার্ড জয়ী। তিনি সাইবার সিকিওরিটি, এথিক্যাল হ্যাকিং এবং সমাজে টেকনোলজির প্রভাব নিয়ে লিখে থাকেন)

অলঙ্করণ এবং গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

(ইতিহাসের পাতায় আজকের তারিখ, দেখতে ক্লিক করুন— ফিরে দেখা এই দিন।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE