Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
lock down

ব্যাঙ্কিং শিল্পে এই সঙ্কটের দাওয়াই সরকারি বিনিয়োগ

সরকারি ক্ষেত্রই সব সময়ে এগিয়ে আসছে দেশের আমজনতার আমানতের সুরক্ষায়। অন্য দিকে, বাজেটে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে বিলগ্নিকরণের মাধ্যমে ২ লক্ষ কোটি টাকার বেশি সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে।

সঙ্কটের খবর আসার পরে ব্যাঙ্কের সামনে ভিড়। ফাইল ছবি

সঙ্কটের খবর আসার পরে ব্যাঙ্কের সামনে ভিড়। ফাইল ছবি

চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২০ ০৪:৫২
Share: Save:

আমাদের রাজ্য-সহ সারা দেশে কয়েক বছর ধরে বেশি সুদের আশায় সাধারণ মানুষ বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থায় বিনিয়োগ করেছিলেন। গরিব কৃষক, রিকশা চালক, ছোট দোকানি, কারখানার শ্রমিক, মধ্যবিত্ত সরকারি-বেসরকারি কর্মী, অবসরপ্রাপ্ত মানুষ— প্রায় সকলেই নানা অর্থলগ্নি সংস্থায় বিনিয়োগ করেছিলেন। কালক্রমে সে সব সংস্থা লাটে উঠেছে; টাকা ফিরে পাননি অনেকেই। এই এক বছরের মধ্যে কয়েকটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি ইয়েস ব্যাঙ্ককে নিয়ে সঙ্কট ঘনিয়েছে। সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। ইন্দিরা গাঁধীর ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের পরে ১৯৯১ সালে উদারিকরণের হাত ধরে ভারতে আবার ব্যাঙ্ক-সহ নানা বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা শুরু হয়। আমানতকারীদের বেশি সুদ দেওয়ার পাশাপাশি, নানা সুযোগসুবিধা দিয়ে থাকে এরা। ব্যাঙ্কের কাজই হল আমানতকারীদের জমানো টাকা বাজারে ধার দিয়ে মুনাফা অর্জন করা। এই লক্ষ্যে তারা সহজ শর্তে ধার দিয়ে থাকে এবং নানা জায়গায় লগ্নি করে থাকে। এর মধ্যে ঝুঁকির বিনিয়োগও থাকে বলে অভিযোগ।

পরাধীন ভারতে ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠার সময়ে বেসরকারি ব্যাঙ্কই ছিল একমাত্র আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সেই সব ব্যাঙ্কে টাকা রেখে সর্বস্ব খুইয়ে পথে বসার ইতিহাস আমরা সাহিত্যে পড়েছি, চলচ্চিত্রে দেখেছি। স্বাধীন ভারতেও সর্বস্ব খোয়ানোর পরিস্থিতি বজায় ছিল। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর হাত ধরে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ হয় এবং সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকা সুরক্ষিত হয়। গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে দেশের অর্থনীতির খারাপ পরিস্থিতির মোকাবিলায় উদারিকরণের দরজা খুলে দেয় নরসিংহ রাওয়ের সরকার। প্রধান ভূমিকায় ছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। অনেকের অভিযোগ, বিশ্বব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডার (আইএমএফ) পরামর্শ এর পিছনে কাজ করেছিল। শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠানই নয়, শিল্পের নানা ক্ষেত্রে দেশি, বিদেশি বেসরকারি সংস্থার লগ্নির সুযোগ তৈরি হয়। বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাঙ্ক ও বিমা সংস্থাও আত্মপ্রকাশ করে। এর ফলে কর্মসংস্থান বেড়েছে। তবে অধিকাংশ অস্থায়ী এবং চুক্তিভিত্তিক।

পুঁজিবাদের নিয়ম অনুসারে উদার অর্থনীতি মন্দায় আক্রান্ত হয় হামেশাই। যেমন, ২০০৮ সালে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা। তখন আমেরিকা-সহ ইউরোপের বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি যে ঋণ দিয়েছিল তার পরিশোধের সম্ভাবনা কমে গিয়েছিল। কারণ, প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার জন্য ঋণ দেওয়ার সময়ে ঋণগ্রহীতার পরিশোধের ক্ষমতা যাচাই করা হয়নি। ফলে, আর্থিক সংস্থাগুলির অনুৎপাদনকারী সম্পদের পরিমাণ এতটা বেড়ে যায় যেটা তাদের এবং বিশ্ব অর্থনীতির স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। ভারতের কয়েকটি ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রেও এখন একই অবস্থা তৈরি হয়েছে। এমনিতেই বেশ কয়েক বছর ধরে এখানে অর্থনীতির হাল খারাপ। জিডিপি বৃদ্ধির হার ক্রমশ নীচের দিকে। শিল্প উৎপাদনের হার কখনও কখনও ঋণাত্মক। কৃষকেরা ফসলের দাম পাচ্ছে না। বেকারির হার গত কয়েক দশকে সর্বোচ্চ। জিনিসপত্রের দাম উর্দ্ধমুখী। কিন্তু বাজারে পর্যাপ্ত চাহিদা নেই।

অর্থনীতির নিয়মে চাহিদা বাড়াবার জন্য আর্থিকনীতি এবং মুদ্রানীতি উভয়ই প্রয়োগ করা যায়। আর্থিকনীতিতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করে চাহিদা বাড়াতে হয়। যেমন, ১০০ দিনের কাজে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে গরিব মানুষের হাতে খরচ করার টাকার যোগান দেওয়া। গরিব মানুষদের প্রান্তিক ভোগ প্রবণতা বেশি এবং সেটা জীবনধারণের জন্য। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, যেমন, চাল, ডাল, তেল, নুন, সাবান, বিস্কুট ইত্যাদি, অর্থাৎ তাঁদের আয়ের প্রায় সবটাই তাঁরা এই সব জিনিস কিনতে খরচ করেন। এর ফলে, বাজারে চাহিদা বাড়ে। কিন্তু এতে সরকারের আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ বাড়ে। আমাদের দেশ জিডিপি-র ৩ শতাংশ পর্যন্ত আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ বেঁধে রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাই এই ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি করে চাহিদা বাড়ানোর উপায় গ্রহণ করেনি। পক্ষান্তরে মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে। সময়ে সময়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এর একটি উপায় হল সুদের হার কমানো। সুদের হার কমলে ঋণ দেওয়ার সুযোগ বাড়ে। আশা করা হয়েছিল, সুদের হার কমলে মধ্যবিত্তেরা বাড়ি, গাড়ি-সহ নানা বিলাসদ্রব্য যেমন মোবাইল, ফ্রিজ, এসি ইত্যাদি কিনতে বেশি ঋণ নিতে উৎসাহী হবেন আর এর কারণে বাজারে চাহিদা বাড়বে। কিন্তু দেখা গেল, তা কাজ করল না। অনেক ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ক্ষেত্রে ঋণ দিতেও পরামর্শ দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তবে কৃষক এবং ছোট ও মাঝারি শিল্পের মালিকেরা সহজে ঋণ পাননি।

কম সুদের লাভ উঠিয়েছেন ধনী এবং বড় শিল্পপতিরা। তাঁরা বিনিয়োগের জন্য টাকা ধার নিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যবসার লাভ-ক্ষতির খতিয়ান দেখা হয়নি; দেখলেও আমল দেওয়া হয়নি। বছরের পর বছর ক্ষতিতে চলছে এমন সংস্থাকেও আবার বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়েছে। আসলে এখানে একটি দুষ্টচক্র কাজ করেছে। এমনিতেই ধার নিয়ে শোধ করেনি বা করতে পারেনি এমন সংস্থাগুলি আবার ঋণ দেওয়া হয়েছে এই আশায় যে লাভজনক হয়ে তারা আগের এবং এখনকার ঋণ শোধ করবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক কর্তাদের সুপারিশ বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঘনিষ্টতা কাজে লাগানো হয়েছে। ঋণ শোধ না করে ঋণ খেলাপি হয়েছে অনেকে। তাঁদের ঋণ দিয়ে অনেক ব্যাঙ্কের অনুৎপাদনকারী সম্পদের পরিমাণ আরও বেড়েছে। এই দোষে দুষ্ট সরকারি, বেসরকারি— সব ব্যাঙ্কই। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে টিকে থাকার লড়াইয়ে অনেক সরকারি ব্যাঙ্কও এই দুষ্টচক্রে পড়েছে। আঙুল উঠেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দিকেও । কয়েক বছর ধরে এ ভাবে অনুৎপাদনকারী সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া কী রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নজর এজর এড়াল?

দেশের অনেক নামী শিল্পপতির নাম এই ঋণ খেলাপির তালিকায় আছে। অনেকে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। গত কয়েক বছরে এই প্রবণতা বাড়ছে। দেশের সাধারণ মানুষের আমানত ফেরত পাওয়া অনিশ্চয়তার মুখে। সরকার থেকে প্রতিষেধক হিসেবে ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের উপায় বাতলেছে। ১০টি বড় সরকারি ব্যাঙ্ককে যুক্ত করে চারটি ব্যাঙ্কে পরিণত করা হয়েছে যা এই এপ্রিল থেকে কার্যকরী হয়েছএ। ব্যাঙ্কগুলিকে এক করে ঠিক ভাবে পরিচালনা করে তাদের অনুৎপাদনকারী সম্পদের পরিমাণ কমাতে পারবে এই লক্ষ্যে। স্টেট ব্যাঙ্কের উপরে দায়িত্ব বর্তেছে ইয়েস ব্যাঙ্ককের ৪৯ শতাংশ শেয়ার কেনার। ভারতীয় জীবন বিমা নিগম কয়েক হাজার কোটি টাকার সুরক্ষা কবচ দিয়েছিল আইডিবিআই ব্যাঙ্কের উদ্ধারে। ২০০৮-এ আমেরিকাতেও বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলিকে উদ্ধারে সরকার থেকে ‘বেল আউট’ প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল।
দেখা গিয়েছে সরকারি ক্ষেত্রই সব সময়ে এগিয়ে আসছে দেশের আমজনতার আমানতের সুরক্ষায়। অন্য দিকে বাজেটে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে বিলগ্নিকরণের মাধ্যমে ২ লক্ষ কোটি টাকার বেশি সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। এমনকি, যে ভারতীয় জীবন বিমা নিগম থেকে সরকার বছরের পর বছর লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা রয়্যালটি পেয়েছে সেখানেও শেয়ার বিক্রি করে এক লক্ষ কোটি টাকার বেশি সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। আধুনিক পুঁজিবাদের সংকট ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে উৎপাদন ক্ষেত্রে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সর্বত্র। বিলগ্নিকরণ, বেসরকারিকরণ, সরকারি ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ ইত্যাদি উপায়গুলি সঙ্কটকে আরও তীব্র করছে। এই সঙ্কটের মোকাবিলা একমাত্র করতে পারে সরকারি বিনিয়োগ। তাই সরকারকেই আবার পরিত্রাতার ভূমিকায় নামতে হবে যা অর্থনীতিবিদ কেনস ১৯৩০-এর বিশ্বমন্দার সময়ে বলেছিলেন।

কাজী নজরুল মহাবিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

banking investment Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE