Advertisement
১১ মে ২০২৪

সলিলের সঙ্গে নদিয়ার যোগসূত্র স্থাপন গণনাট্যের মাধ্যমেই

১৯৪৩-এর মন্বন্তর সলিল চৌধুরীকে এক বাঁকের মুখে দাঁড় করাচ্ছে, তিনি যোগ দিচ্ছেন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘে। কৃষক আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে বিচ্ছুরণ ঘটছে তাঁর প্রতিভার। লেখালেখির সঙ্গে পুরোদস্তুর চলছে গানে সুর দেওয়ার কাজ। লিখলেন দেবোত্তম চক্রবর্তী১৯৪৪ সালে অসমের আদিগন্ত সবুজ ছেড়ে ইট-কাঠের জঙ্গলে ঠাসা কলকাতায় এসে সলিল যখন ভর্তি হচ্ছেন বঙ্গবাসী কলেজে, তখন বাংলায় অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। ইতিমধ্যে ১৯৩৬ সালের এপ্রিল মাসে প্রতিষ্ঠিত ‘সারা ভারত কৃষক সভা’র নেতৃত্বে ভারতে কৃষক আন্দোলনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।

সলিল চৌধুরী

সলিল চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৯ ০১:২৮
Share: Save:

বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরীর চাকরির দৌলতে অসমের লতাবাড়ি চা বাগানে ক্রমশ বড় হচ্ছেন সলিল। পাশাপাশি কানে গেঁথে নিচ্ছেন সেখানকার ঐশ্বর্যশালী লোকসঙ্গীত। তাঁর ডাক্তার বাবার পাশ্চাত্য সঙ্গীত শোনার সূত্রে অল্প বয়সেই সলিলের হাতেখড়ি হচ্ছে ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সঙ্গীতের পুরোধা বাখ, বিঠোফেন, চাইকোভস্কি, শপ্যাঁ এবং মোৎজার্টের কাছে। ভবিষ্যতে সলিলের সুরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের যে মেলবন্ধন দেখে অভ্যস্ত হয়ে উঠব আমরা, তার শুরুটা হচ্ছে এখান থেকেই।

১৯৪৪ সালে অসমের আদিগন্ত সবুজ ছেড়ে ইট-কাঠের জঙ্গলে ঠাসা কলকাতায় এসে সলিল যখন ভর্তি হচ্ছেন বঙ্গবাসী কলেজে, তখন বাংলায় অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। ইতিমধ্যে ১৯৩৬ সালের এপ্রিল মাসে প্রতিষ্ঠিত ‘সারা ভারত কৃষক সভা’র নেতৃত্বে ভারতে কৃষক আন্দোলনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। জাতীয় আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে কৃষক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে কৃষক সভার পক্ষ থেকে গৃহীত হয়েছে এক বৈপ্লবিক গণতান্ত্রিক কর্মসূচি— যার অন্যতম মূল ধ্বনি হল জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ এবং ভূমিদাসত্ব, বেগার প্রভৃতি মধ্যযুগীয় শোষণ প্রথার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ।

এর কয়েক বছরের ব্যবধানে ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয়েছে ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্ট। তাতে জানা গিয়েছে, বাংলার ৭৫ লক্ষ কৃষিজীবী পরিবারের মধ্যে ৩০ লক্ষ পরিবারের জমিতে প্রজাস্বত্বের অধিকার নেই, তাঁরা নেহাতই মজুরিজীবী কিংবা ভাগচাষি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বছরগুলিতে ইংরেজদের ধারাবাহিক হৃদয়হীন শোষণনীতির ফলে ৪৩-এর ভয়াবহ মন্বন্তরের প্রথম বলি হয়েছেন এই অগণিত দরিদ্র ভূমিহীন ভাগচাষিরাই। আর চাষিদের এই দুর্দশার সুযোগ নিয়ে গ্রামাঞ্চলে ফুলেফেঁপে উঠেছে জোতদার-মহাজন শ্রেণি। এ হেন পরিস্থিতিতে সলিল আগ্রহী হয়ে উঠছেন কমিউনিস্ট মতাদর্শে। চব্বিশ পরগনার সোনারপুর বারুইপুর অঞ্চলের খগেন রায়চৌধুরী (ক্ষেপুদা), হরিধন চক্রবর্তী ও নিত্যানন্দ চৌধুরীর মতো কমিউনিস্ট নেতাদের পরিচালনায় সলিল চৌধুরী, রঘু চক্রবর্তী ও অনিল ঘোষের মতো তরুণেরা সক্রিয় রাজনীতিতে নেমে পড়ছেন। যুক্ত হচ্ছেন বাংলার কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে। পাশাপাশি, ১৯৪৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ। ওই সংগঠনে তখন একে একে জড়ো হচ্ছেন বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের তাবৎ দিকপাল— বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, ঋত্বিক ঘটকের মতো শক্তিশালী অভিনেতা-পরিচালক। সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর মতো গায়ক-সুরকার। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে-র মতো কবি-কথাকার। বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে অভিনীত হচ্ছে ‘নবান্ন’। ১৯৪৩-এর মন্বন্তর সলিলকে এক বাঁকের মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, তিনি যোগ দিচ্ছেন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘে। কৃষক আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে বিচ্ছুরণ ঘটছে তাঁর সৃজন প্রতিভার। গান-কবিতা-গল্প-নাটক লিখছেন, আর তারই সঙ্গে পুরোদস্তুর চলছে গানে সুর দেওয়ার কাজ।

১৯৪৫ সালে বিদ্যাধরী নদীর বানভাসি অঞ্চলে বন্যায় আক্রান্ত কৃষকদের উপর প্রশাসনের অত্যাচারের প্রতিবাদে সলিল সৃষ্টি করছেন তাঁর প্রথম গণসঙ্গীত, ‘দেশ ভেসেছে বানের জলে ধান গিয়েছে মরে’। ওই একই সময়ে কৃষক আন্দোলনের ফসল হিসেবে সলিল তৈরি করছেন ‘কৃষক সেনাদের মুষ্টি তোলে আকাশে’, ‘তোমার বুকে খুনের চিহ্ন খুঁজি এই আঁধারের রাতে’, ‘পৌষালি বাতাসে পাকা ধানের বাসে’, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে’ ইত্যাদি অগণিত গণসঙ্গীত। ১৯৪৬ সালের ২৯ জুলাই নৌ-বিদ্রোহকে সমর্থন করে দেশব্যাপী ধর্মঘটের দিনে সলিল লিখছেন— ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে’ এবং সেই দিনই মনুমেন্টের নীচে অজস্র মানুষের সমাবেশে গানটি গাওয়া হচ্ছে।

১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার আহ্বানে অবিভক্ত বাংলায় শুরু হচ্ছে তেভাগা আন্দোলন। দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, রংপুর, যশোহর, পাবনা, মালদহ, হুগলি, নদিয়া, চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর, ময়মনসিংহ-সহ ১৯টি জেলার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ৬০ লক্ষ কৃষক ও কৃষকরমণী উৎপন্ন ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ মালিকানার দাবিতে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। আর এই পর্যায়ে সলিল সৃষ্টি করছেন ‘হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো’, ‘মানব না এ বন্ধনে, মানব না এ শৃঙ্খলে’ কিংবা ‘ও আলোর পথযাত্রী’-র মতো অসংখ্য অবিস্মরণীয় গান। সম্পূর্ণ নতুন কথা, সুর আর অর্কেস্ট্রেশনের ত্রিবেণীসঙ্গমে এক ঝটকায় সাবালক হয়ে উঠছে বাংলা গান।

১৯৪৮ সাল। তত দিনে দেবব্রত বিশ্বাস আর বিনয় রায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে টেনে এনেছেন গণনাট্যের বৃত্তে। সেই সুবাদে ভূপতি নন্দী সলিলকে নিয়ে যাচ্ছেন হেমন্তর কাছে। সেই দিন যে সব গান তাঁকে শোনাচ্ছেন সলিল, হেমন্ত বুঝতে পারছেন রাজনৈতিক কারণেই এ সব গান রেকর্ড করা মুশকিল। হতাশ সলিল যখন রাস্তায়, তখন হঠাৎই তাঁর মনে পড়ছে অর্ধসমাপ্ত একটা গানের কথা। দ্রুত ফিরে গিয়ে সলিল সেই গান শোনাচ্ছেন হেমন্তকে। হেমন্তর পছন্দ হওয়ায় দু’দিনের মধ্যেই অর্ধসমাপ্ত গানটি পুরোটা লিখছেন, সুরও করছেন। যে দিন সেই গান দিয়ে আসছেন হেমন্তর কাছে, সেই রাতেই পুলিশ আসছে সলিলের সন্ধানে। গা ঢাকা দিতে সলিল চলে যাচ্ছেন সন্দেশখালির ভাঙড় অঞ্চলে। সুর করলেও সে গানের অর্কেস্ট্রেশন করার সুযোগ আর পাচ্ছেন না তিনি।

১৯৪৯-এ হেমন্ত নিজেই অর্কেস্ট্রেশন সম্পন্ন করে রেকর্ড করছেন সেই গান ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’। সুরকার হিসেবে নাম দিচ্ছেন শুধু সলিলেরই। হেমন্তর শিল্পীসুলভ উদারতায় আপ্লুত হচ্ছেন তিনি। চারদিকের প্রাথমিক হইহই মেলাতে না মেলাতেই একের পর এক ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে ‘রানার’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’ বা ‘পথে এবার নামো সাথী’। তত দিনে হেমন্ত-সলিল বাংলা গানের জগতে অনন্যসাধারণ জুটিতে পরিণত।

১৯৪৮ সালের পরে আবারও পালাবদল ঘটছে সলিলের জীবনে। পূরণ চাঁদ যোশীর বদলে কমিউনিস্ট পার্টির সর্বময় কর্তা হচ্ছেন কট্টরপন্থী বি টি রণদিভে। পার্টির অনুমোদন ছাড়া প্রকাশ্যে সলিলের গান গাওয়া নিষিদ্ধ হচ্ছে। একই সময়ে মারা যাচ্ছেন তাঁর বাবা। মা ও ছয় ভাইবোনের দায়িত্ব চাপছে তাঁর কাধে। এই সময়ে নেহাতই সমাপতন হিসেবে মুম্বই থেকে বিমল রায়ের আহ্বান আসছে সলিলের কাছে। সৃষ্টিসুখের প্রত্যাশায় কলকাতার পিছুটান ঝেড়ে ফেলে তিনি পাড়ি জমাচ্ছেন মুম্বই। কলকাতায় রেখে যাচ্ছেন তাঁর তিন সহযোদ্ধা দেবব্রত-হেমাঙ্গ-ঋত্বিককে। যাঁরা অপেক্ষা করবেন নতুন জগতে সলিলের সাফল্যের জন্য।

সলিলের লেখা ‘রিক্সাওয়ালা’ গল্প অবলম্বনে বিমল রায় হিন্দিতে তৈরি করলেন ‘দো বিঘা জমিন’, সলিল থাকলেন ছবির চিত্রনাট্যকার ও সুরকার হিসেবেও। ছবিটি মুক্তি পাওয়া মাত্র সারা দেশে বিপুল সাড়া পড়ে গেল। জীবনের নতুন ইনিংস শুরু করলেন তিনি। এর অব্যবহিত পরে এই প্রথম দিলীপকুমারের জন্য ‘মধুমতী’ সিনেমায় সুর বাঁধলেন সলিল— ‘আজা রে পরদেশি’, ‘ঘড়ি ঘড়ি মেরা দিল ধড়কে’, ‘দিল তড়প তড়প কে’, ‘সুহানা সফর ঔর ইয়ে মৌসম হসিন’ …। গোটা ভারত আরও এক বার উদ্বেলিত হল তাঁর সুরের ঝর্নাধারায়।

সলিলের সঙ্গে আমাদের নদিয়ার যোগসূত্রও স্থাপিত হয়েছিল গণনাট্যের মাধ্যমেই। বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ, কৃষ্ণনাগরিক অমিয়নাথ সান্যালের কন্যা রেবা মুহুরীর সঙ্গে সলিলের হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল সঙ্গীতের সূত্র ধরে। আর এক কৃষ্ণনাগরিক দিলীপ বাগচি কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে গণনাট্যের নদিয়া জেলা শাখার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৬ সালের প্রবল বন্যায় হারমোনিয়াম নিয়ে গানের দলের সঙ্গে গ্রামেগঞ্জে বন্যাদুর্গতদের সাহায্যার্থে তিনি গান গেয়েছেন দিনের পর দিন। পরের বছরে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণও করেছেন। পরিবার থেকে তাঁকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার জন্যে মুম্বইয়ে পড়াশোনার জন্যে পাঠানো হলে সেখানে তাঁর সঙ্গে নিবিড় সখ্য গড়ে ওঠে সলিলের।

হিন্দি ও বাংলা-সহ ভারতের চোদ্দোটি ভাষায় গান বেঁধেছিলেন সলিল। তাঁর মৃত্যুর পরে নৌশাদসাব বলেছিলেন, “From our seven notes, one is no more”।

সপ্তসুরের এক সুর সলিল আজ ৯৫-এ পা দিলেন।

আমঘাটা শ্যামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

IPTA Salil Chowdhury Nadia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE