Advertisement
E-Paper

ইরান: নতুন করে না ভেবে উপায় নেই

পশ্চিম এশিয়ায় সৌদি আরবের অর্থনৈতিক ও মতাদর্শগত কর্তৃত্ব ইরানের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গিয়েছে। রণনীতির স্বার্থকে ওবামা নতুন করে ফিরে দেখছেন। সাদ্দাম হুসেনের জন্মস্থান, ইরাকের টিক্রিত শহরকে গোঁড়া সুন্নি ইসলামি রাষ্ট্রবাদী আইএস-এর দখলমুক্ত করার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে ইরানের শিয়া মিলিশিয়া— পশ্চিম এশিয়ার রণাঙ্গনে এটা এক ঐতিহাসিক পরিহাস। নিজে সংখ্যালঘু সুন্নি সম্প্রদায়ের হয়েও সাদ্দাম তাঁর দীর্ঘ ইরাক শাসনপর্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়াদের মাথা তুলতেই দেননি।

গৌতম রায়

শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৫ ০০:০৩
পুনরুদ্ধার। টিকরিত দখলের পথে শিয়া মিলিশিয়ার সৈনিকরা। মার্চ ২০১৫। ছবি: রয়টার্স

পুনরুদ্ধার। টিকরিত দখলের পথে শিয়া মিলিশিয়ার সৈনিকরা। মার্চ ২০১৫। ছবি: রয়টার্স

সাদ্দাম হুসেনের জন্মস্থান, ইরাকের টিক্রিত শহরকে গোঁড়া সুন্নি ইসলামি রাষ্ট্রবাদী আইএস-এর দখলমুক্ত করার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে ইরানের শিয়া মিলিশিয়া— পশ্চিম এশিয়ার রণাঙ্গনে এটা এক ঐতিহাসিক পরিহাস। নিজে সংখ্যালঘু সুন্নি সম্প্রদায়ের হয়েও সাদ্দাম তাঁর দীর্ঘ ইরাক শাসনপর্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়াদের মাথা তুলতেই দেননি। উপরন্তু টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মিলন-মোহনা ‘শাত-এল-আরব’ জলধারার দখল নিয়ে শিয়া প্রতিবেশী ইরানের বিরুদ্ধে প্রায় এক দশক ব্যাপী (১৯৮০-’৮৮) রক্তাক্ত সংঘর্ষে অগণিত শিয়াকে হত্যা করেছেন। আজ তাঁর জন্মভূমিকে সুন্নি কট্টরপন্থীদের জেহাদি খিলাফত থেকে মুক্ত করতে ইরানের বিপ্লবী প্রহরীদের কমান্ডার কাসেম সোলেমানির নেতৃত্বে ইরাকি সেনাবাহিনী (যাদের অধিকাংশই শিয়া) এবং ইরানের শিয়া মিলিশিয়ার যৌথ লড়াই কেবল প্রতীকী তাৎপর্যেই অনন্য নয়, সমগ্র পশ্চিম এশিয়ায় শক্তির পরিবর্তমান ভারসাম্যে ইরানের নতুন ভূমিকা ও গুরুত্ব বৃদ্ধিরও দ্যোতনা বহন করছে।

লক্ষণীয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে তার পুরনো শত্রুতা সরিয়ে রেখে ইরাকের গৃহযুদ্ধেও তার নির্ণায়ক শক্তি হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় কোনও সচেতন বাধা সৃষ্টি করছে না। বরং টিক্রিত-এ ইরানি কমান্ডারের নেতৃত্বে শিয়া মিলিশিয়ার ক্ষমতা দখলের নীরব দর্শক হয়ে থাকছে। মার্কিন বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মার্টিন ডেম্পসি প্রকারান্তরে স্বীকারই করে নিয়েছেন যে, টিক্রিত-এর লড়াইটা তাঁদেরই লড়াই ছিল, কিন্তু প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নতুন করে ইরাক বা সিরিয়ায় স্থলযুদ্ধে জড়াতে নারাজ। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আকাশপথেই বোমারু হামলায় আইএস-এর মাজা ভেঙে দেওয়ার কাজটা নিপুণ ভাবে করছে। আর তার ফলেই দুর্বল হয়ে পড়া সুন্নি জেহাদিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে সুবিধে হচ্ছে শিয়া মিলিশিয়ার। ডেম্পসি মেনে নিয়েছেন, কয়েকশো জেহাদির পক্ষে ২৮ হাজার শিয়া মিলিশিয়ার মহড়া নেওয়া সম্ভব নয়।

মার্কিন সেনাপ্রধান ইরানের রাজনৈতিক উত্থানের প্রশ্নটা এড়িয়ে গেছেন, যে-প্রশ্নটা মার্কিন কংগ্রেসে তাঁর সাম্প্রতিক বহুবিতর্কিত ভাষণে প্রবল ভাবে উপস্থাপিত করেছেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বিনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি সিরিয়া, লেবানন, ইরাক এবং ইয়েমেনে ইরানের শিয়া প্রভাব-বলয়ের ক্রমিক বিস্তারে ইজরায়েলের বিপন্নতা বৃদ্ধির শঙ্কা জানিয়েছেন। নেতানিয়াহুকে মনে করিয়ে দেওয়া যায়, ইজরায়েলের বিপদ ইরান বা শিয়া ইসলাম থেকে নয়, প্যালেস্টিনীয়দের স্বদেশ জবরদস্তি দখল করে রাখার স্বৈরাচারের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। সে কথা না-হয় ছেড়ে দেওয়া গেল, কিন্তু ইরানের দানবায়ন ঘটাতে গিয়ে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী প্রাচীন ইতিহাস থেকে সাক্ষ্য টেনেছেন, তুলে এনেছেন পারস্যের ভাইসরয় হামান-এর প্রসঙ্গ, যিনি ইহুদিদের ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছিলেন। আর সেখানেই একটা খুব বড় প্রশ্ন ওঠে। তিনি কী করে ভুলে গেলেন পারস্য-সম্রাট সাইরাসের কথা, যিনি ব্যবিলনীয় সাম্রাজ্যের নির্বাসন থেকে ইহুদিদের মুক্তি দেন? এই ইচ্ছাকৃত বিস্মৃতি বা নির্বাচিত ইতিহাস-অধ্যয়ন সেই জায়নবাদী বাচনেরই লক্ষণ, যা প্রতিনিয়ত ইরানি বিপ্লবকে নাত্সি উত্থানের সঙ্গে তুলনা করে।

নেতানিয়াহু যে উৎস থেকে তাঁর ইতিহাস-জ্ঞান আহরণ করেছেন, সেই ‘বুক অফ এস্থার’-এর কাহিনিরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা চেপে গেছেন। ইহুদি রানি এস্থার তাঁর পারসিক স্বামী সম্রাট আসুয়েরাস-এর দয়াতেই ইহুদিদের অনিবার্য গণহত্যা থেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। এস্থারের আখ্যান অবশ্য নিছকই পুরাণের গল্প, ইতিহাসের নয়। ইতিহাসের সাক্ষ্য মিলবে পারস্যসম্রাট সাইরাসের কীর্তিতে, যিনি ৫৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যবিলন দখল দখল করার পর সেখানে দাস করে রাখা সব ইহুদিকে মুক্তি দেন। ৪০ হাজার ইহুদি তাঁদের স্বদেশ জুডিয়ায় ফিরে যান, সেখানে জেরুজালেমে তাঁদের মন্দির গড়ার অর্থও সাইরাসের রাজকোষ থেকেই বরাদ্দ করা হয়। নেতানিয়াহু এই ইতিহাস বেমালুম চেপে গেলেন, কারণ এটা ‘ইরানিদের চিরাচরিত ইহুদি-বিদ্বেষ’ সংক্রান্ত তাঁর তত্ত্বে কোনও ঐতিহাসিকতা দেয় না। ২০১২ সালে হোয়াইট হাউসে তাই বারাক ওবামাকে তিনি ‘বুক অব এস্থার’ পড়তে দিয়ে বলেছিলেন, ‘পড়ে দেখুন, অতীতেও ইরানিরা ইহুদিদের ধ্বংস করতে চেয়েছিল’।

কিন্তু এস্থার-এর এই ইহুদি পুরাণও কি নেতানিয়াহু পুরোটা পড়তে দিয়েছেন? মনে হয় না। কারণ রানি এস্থারের অনুরোধে পারস্যরাজ ইহুদি নির্যাতন ও বিতাড়নের কর্মসূচি রদ করার পরের ঘটনাক্রম অন্য রকম। পারসিক রাজানুগ্রহে বেঁচে যাওয়ার পর এস্থার ও তাঁর কাকা মরদেচাই প্রভূত ক্ষমতা অর্জন করেন এবং ডিক্রি জারি করেন— ভবিষ্যতে ইহুদিদের বিপদগ্রস্ত করতে পারে, এমন সকলকে হত্যা করা হোক। সেই কাল্পনিক বিপন্নতাবোধ থেকে ৭৫ হাজার পারসিককে ‘ইহুদিদের সম্ভাব্য শত্রু’ শনাক্ত করে হত্যা করা হয়। আগ্রাসী ও আক্রমণকারী ইহুদিদের এই আখ্যান উহ্য রেখে নেতানিয়াহু কি জায়নবাদের আধুনিক, প্যালেস্টিনীয়-পীড়ক অবতারের ভজনাই জারি রাখছেন? রিপাবলিকান মার্কিন সেনেটররা কত দূর ইতিহাস-পুরাণ পড়েন, জানা নেই। কিন্তু এস্থার কাহিনীর আদ্যোপান্ত (ইহুদি-বিদ্বেষী সন্দেহে পারসিকদের গণহত্যার গল্প সহ) তো সব ইহুদিরই জানা। এস্থারের পৌরাণিক কীর্তিকথা স্মরণে যে বাৎসরিক ‘পুরিম’ উৎসব ইজরায়েলে পালিত হয়, তার গভীর গহনে ইহুদি-শত্রু সন্দেহে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে আগাম নিশ্চিহ্ন করে বিপন্মুক্ত হওয়ার সংকেতবার্তাও সুকৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পুরাণ-স্মৃতি আধুনিক ইতিহাসের গতিমুখ নির্ধারিত করে।

ইরান নিয়ে নেতানিয়াহুর সতর্কবাণী অবশ্য অন্য কারণে প্রণিধানযোগ্য। আয়াতোল্লা খোমেইনির ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমী গণতন্ত্রের অর্থনৈতিক অবরোধ, আন্তর্জাতিক মঞ্চে একঘরে করে দেওয়ার রাজনৈতিক তৎপরতা তাকে শেষ পর্যন্ত দমিয়ে রাখতে পারেনি। খোমেইনির ইরানের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সাদ্দামকে অস্ত্র, অর্থ, যুদ্ধ-সরঞ্জাম দিয়ে আমেরিকা সাহায্য করেছিল। ইরান তখন রিপাবলিকান মার্কিন প্রেসিডেন্টদের কাছে ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’, উত্তর কোরিয়ার মতোই ‘শয়তানি অক্ষ’-র অন্তর্ভুক্ত। ইজরায়েলের মতো মার্কিন প্রশাসনও ১৯৭৯ সালে তার সাধের শাহ রেজা পল্লভি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ইরানের নিরবচ্ছিন্ন দানবায়ন করে গেছে। অথচ ইরান কিন্তু কখনওই সৌদি আরবের মতো দেশ নয়, যে-দেশ ইসলামের সবচেয়ে গোঁড়া ও প্রতিক্রিয়াশীল ওয়াহাবি প্রকরণ অনুশীলন করে। ইরান মহান ও সমৃদ্ধ পারসিক সভ্যতার উত্তরাধিকার নিয়েই ইসলামকে বরণ করেছিল। তাই শরিয়ত মানলেও ইরানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই ছাত্রী, মেয়েরা এ দেশে কেবল নিজেদের গাড়িই চালায় না, ট্যাক্সি পর্যন্ত চালায়। তেহরানে দমকল বাহিনীতেও ইরানি মহিলারা দিব্যি কাজ করেন। আর বোরখার তাঁবু নয়, ইরানি মহিলারা নিজেদের মুখ পুরুষদেরও দেখাতে পারেন বলে এক দিকে যেমন তাঁদের ‘হিজাব’ বা চুল-ঢাকা ওড়না হয়ে ওঠে একটা ‘ফ্যাশন স্টেটমেন্ট’, অন্য দিকে তেমনই নাক-চোখ-ঠোঁটের প্লাস্টিক সার্জারি করাতে শল্য-চিকিৎসকদের চেম্বারে লম্বা লাইন পড়ে। এই ইরান যদি মার্কিন তথা পাশ্চাত্য অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে রেহাই পায়, তবে শুধু তেল রফতানি বাবদ তার মাসিক প্রাপ্য ১৬০ কোটি ডলার যে বিপুল সম্পদ তার হাতে তুলে দেবে, তা দিয়ে পশ্চিম এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্য ও সমীকরণে অনেক হিসাবই সে পাল্টে দিতে পারে। সে দিক থেকে দেখলে নেতানিয়াহু কিংবা সৌদি আরবের শাসকদের আশঙ্কা অমূলক নয়। সৌদি রাজাদের দুশ্চিন্তা ইজরায়েলের চেয়ে কম নয়। সে দেশের বিদেশমন্ত্রী যুবরাজ সৌদ আল-ফয়জল তাই মার্কিন বিদেশ সচিব জন কেরির কাছে কাতর অনুনয় করেছেন— এ ভাবে চললে ইরান তো গোটা ইরাকটাই দখল করে ফেলবে। আমেরিকা ও তার পশ্চিমী মিত্ররা কেন নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে? কেন এখনই তাদের সম্মিলিত স্থলবাহিনী ইরাকের মাটিতে নামছে না? জন কেরি অবশ্য সৌদি আরবের এই আশঙ্কাকে বিশেষ আমল দেননি।

পশ্চিম এশিয়ায় সৌদি আরবের অর্থনৈতিক ও মতাদর্শগত কর্তৃত্ব ইরানের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গিয়েছে। আইএস-এর রাষ্ট্রবাদী জেহাদিরা তো সৌদি প্রশ্রয়ে বিকশিত ওয়াহাবি-সালাফি ইসলামই সকলের উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। প্রথম দিকে এদের সৌদি আরব টাকাপয়সা দিয়ে বাড়তে সাহায্যও করেছে। কিন্তু এখন পাছে জেহাদিরা ইসলামের ভুবনে সৌদি কর্তৃত্বকেও চ্যালেঞ্জ করে বসে, তাই তাদের বিরুদ্ধে বহুজাতিক সামরিক জোটে অনিচ্ছুক শরিক হয়েছে। কিন্তু ওই জোটের নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্য ইউরোপীয় দেশগুলি কেউই আর একটা স্থলযুদ্ধে নামতে প্রস্তুত নয়। ইরাক ও আফগানিস্তানে সুন্নি ও তালিবান গেরিলাদের মোকাবিলা করার দুঃস্বপ্নস্মৃতি এখনও তাদের তাড়া করে ফেরে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছে তদুপরি ইরাক যুদ্ধ নিয়ে একটা প্রায়শ্চিত্তের তাগিদও কাজ করে বলে মনে হয়। সব মিলিয়ে পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন রণনীতির স্বার্থকে ওবামা নতুন করে ফিরে দেখছেন বলে মনে হয়।

gautam roy anandabazar editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy