যখন যেমন ভাবলে সুবিধা, সোশ্যাল মিডিয়াকে আমরা তখন তেমনই ভাবছি।
বাস্তব, নাকি কল্পরাজ্য? ধন্দটা বোধ হয় আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি এখনও। অথবা ইচ্ছা করেই কাটিয়ে উঠছি না। যখন যেমন ভাবলে সুবিধা, সোশ্যাল মিডিয়াকে আমরা তখন তেমনই ভাবছি। শ্লাঘার বিষয় খুঁজে পেলেই সোশ্যাল মিডিয়াকে বাস্তব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে ধরে নিচ্ছি। আর অগৌরবের আভাস পেলেই ভাবছি, ও তো কল্পনার পৃথিবী। এই সুবিধাবাদে দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যেতেও বেশ সুবিধা হয়। যে ভাবে এড়িয়ে গেল মৌসুমী মিস্ত্রির সোশ্যাল মিডিয়া বান্ধবরা।
মর্মান্তিক ঘটনা ঘটিয়েছে সোনারপুরের কিশোরী মৌসুমী। ফেসবুক লাইভে জগতের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কড়ি-বরগায় বাঁধা ওড়নার ফাঁস গলায় পরে ঝুলে পড়েছে সে। রাতের ঘটনা সম্ভবত। দূর-দূরান্তে থাকা বন্ধুমহল দেখে নিয়েছিল ভয়াবহ দৃশ্য, জেনে গিয়েছিল মৌসুমী আর নেই। কিন্তু সকাল পর্যন্ত পরিবার জানতেই পারেনি, বাড়িতেই ঝুলে রয়েছে মৌসুমীর নিথর দেহ।
এ ঘটনায় মৃত্যুর ভয়াবহতা তো রয়েইছে। কিন্তু সামাজিক ঔদাসীন্য, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, আত্মকেন্দ্রিকতাও কি তার ভয়াবহ চেহারা নিয়ে ধরা দিল না? সোশ্যাল মিডিয়া-জাত সম্পর্কগুলোর একটা শীতল, আত্মকেন্দ্রিক, নিষ্প্রাণ, নিষ্ঠুর ছবিও কি উঠে এল না?
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
মৌসুমীর মৃত্যু যখন ফেসবুকে লাইভ, তখন অনেকেই দেখছিলেন তাকে। কড়ি-বরগায় বাঁধা ওড়না থেকে গলায় ফাঁস দিতে চলেছে মৌসুমী, নিশ্চয়ই অনেকেই বুঝতে পেরেছিলেন তা। কেউ কি তাকে থামানোর চেষ্টা করেছিলেন? কেউ কি লাইভ কমেন্টে কিছু লিখে মৌসুমীকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন? যাঁরা দেখলেন, মৌসুমী আত্মহত্যা করতে চলেছে, তাঁদের কারও কাছে কি মৌসুমীর ফোন নম্বর ছিল না? ফোন নম্বর না-ই থাক, একটা ফেসবুক কলও কি করা যেত না?
ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকেই হয়তো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। মৌসুমী মিস্ত্রি সত্যিই আত্মহত্যা করবে না, অনেকেই হয়তো এমনটা ভেবেছিলেন। তাই হয়তো আর বাধা দেওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ওড়নার ফাঁস থেকে মেয়েটাকে ঝুলে পড়তে দেখার পর কেউ কি তত্পর হয়েছিলেন? মৌসুমীর পরিবারকে কি কেউ দ্রুত খবরটা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন? মেয়েটাকে বাঁচানোর একটা শেষ চেষ্টা কি কাউকে করতে দেখা গিয়েছিল? সব কটা প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত— ‘না’। সোশ্যাল মিডিয়ার এই ঔদাসীন্য বা নিষ্ঠুরতা বা আত্মকেন্দ্রিকতা ভাবাচ্ছে।
আরও পড়ুন: ফেসবুকে লাইভ করে সোনারপুরে আত্মঘাতী কিশোরী
আরও পড়ুন: ‘লাইভ’ আত্মহত্যা দেখেও কেন চুপ ফেসবুক ‘বন্ধুরা’? উঠছে প্রশ্ন
সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ভাল কাজ কি কিছুই হচ্ছে না? অনেক হচ্ছে। ইতিবাচক লক্ষ্যে কেউ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। কারও অসহায়তার খবর পেয়ে অন্য অনেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়ার এই মুখটা খুব প্রশংসিতও হচ্ছে। কিন্তু মৌসুমীর ক্ষেত্রে যে মুখটা দেখা গেল, সোশ্যাল মিডিয়ার সেই মুখ বেশ নেতিবাচক। আত্মহত্যার লাইভ ওয়েবকাস্ট দেখতে দেখতে প্রায় অবিচল থাকায় সোশ্যাল মিডিয়ার যে দায়িত্বজ্ঞানহীন মুখটা ধরা পড়ল, তা বেশ বিপজ্জনক।
কতটা বাস্তব সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়া, কতটা গুরুত্ব সে দুনিয়াকে আমরা দেব, কতটা দায়িত্বশীলতা আমরা পরস্পরের থেকে আশা করব— সে সব নিয়ে এ বার একটা গুরুতর চর্চা শুরু হওয়া দরকার। সোশ্যাল মিডিয়াকে সম্পূর্ণ অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করা আজকের দিনে একটু কঠিন। কিন্তু পরাবাস্তবের মতো হয়ে ধরা দেওয়া এই জগতে আমাদের সকলকে যদি থাকতেই হয়, তা হলে আরও দায়িত্বশীল, আরও সংবেদনশীল হয়ে যেন থাকতে পারি আমরা, সেই লক্ষ্যে কোনও বড়সড় পদক্ষেপ এ বার হওয়া জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy