Advertisement
E-Paper

আফ্রিকানরা নরখাদক, এ কথা তবে ভাবাই যায়

গত ২৪ মার্চ গ্রেটার নয়ডার এক হাউসিং সোসাইটি থেকে সতেরো বছর বয়েসি মণীশ খারিকে সন্ধে থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরিবারের লোকজন খোঁজাখুঁজি করলে সোসাইটিরই কয়েক জন জানান যে মণীশকে শেষ দেখা গিয়েছে পাঁচ জন নাইজেরীয় প্রতিবেশী যুবকের সঙ্গে।

অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
কেন: নয়ডায় আফ্রিকার মানুষদের নিগ্রহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন নানা দেশের ছাত্রছাত্রীরা। জালন্ধর, ২৯ মার্চ। পিটিআই

কেন: নয়ডায় আফ্রিকার মানুষদের নিগ্রহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন নানা দেশের ছাত্রছাত্রীরা। জালন্ধর, ২৯ মার্চ। পিটিআই

গত ২৪ মার্চ গ্রেটার নয়ডার এক হাউসিং সোসাইটি থেকে সতেরো বছর বয়েসি মণীশ খারিকে সন্ধে থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরিবারের লোকজন খোঁজাখুঁজি করলে সোসাইটিরই কয়েক জন জানান যে মণীশকে শেষ দেখা গিয়েছে পাঁচ জন নাইজেরীয় প্রতিবেশী যুবকের সঙ্গে। এই খবরের ভিত্তিতে পরিবার পুলিশের কাছে ওই পাঁচ জনের নামে অভিযোগ দায়ের করে। ২৫ মার্চ সকালে মণীশ নেশাসক্ত অবস্থায় বাড়ি ফেরত আসে, এবং পরে অসুস্থ বোধ করায় তাকে এক নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়। সে দিনই মৃত্যু হয় তার। পুলিশ অভিযুক্ত পাঁচ নাইজেরীয়কে ধরে নিয়ে যায়। আফ্রিকার ছাত্রছাত্রীরা এর বিরুদ্ধে থানার সামনে প্রতিবাদ জানালে পুলিশ অবশেষে আটক নাইজেরীয়দের প্রমাণাভাবে ছাড়তে বাধ্য হয়।

ইতিমধ্যে নয়ডায় রটে গেল, আফ্রিকাবাসীরা নরখাদক এবং সেটাই ছেলেটির মৃত্যুর কারণ। এমন একটা কথা বিশ্বাস করার মতো লোকের অভাব হয়নি। অন্য দিকে, অভিযুক্তদের ছেড়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে (এবং, ফের গ্রেফতার করার দাবিতে) বেশ বড়সড় একটা প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত হয় স্থানীয় স্তরে। মোমবাতি জ্বালিয়ে বেশ একটা সুশীল নাগরিক সমাজের বাতাবরণও তৈরি করা হয়। সেই সুশীলত্ব অবশ্য বেশি ক্ষণ টেকেনি। প্রতিবাদীদের একাংশ পরিণত হয় হিংস্র প্রতিশোধকামী ভিড়ে। তাদেরই কেউ কেউ ঢুকে পড়ে স্থানীয় একটি মলের ভেতরে। সেখানে দুই নাইজেরীয় ছাত্রকে প্রবল মারধর করে। ইন্টারনেটের দৌলতে অনেকেই সে ছবি দেখেছেন। ঘটনাপ্রবাহ অবশ্য থেমে থাকেনি। ২৯ তারিখ অটো থেকে নামিয়ে এক আফ্রিকান তরুণীকে মারধর করলেন কিছু বীরপুঙ্গব।

ঘটনাক্রমের অভিঘাত এমনই, অনেকেই স্তম্ভিত হয়ে ভাবছেন, ‘এ কোথায় যাচ্ছি আমরা?’ ২০১৭ সালে, কসমোপলিটান নয়ডায় দাঁড়িয়ে কি সত্যিই এমনটা ঘটতে পারে, যেখানে অনেক মানুষ এক সঙ্গে বিশ্বাস করবে যে আফ্রিকানরা নরখাদক? তার পর এমন নৃশংস ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে? স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক, তিন বছর আগে আপ-এর বড় মাপের নেতা সোমনাথ ভারতীর উপস্থিতিতেই দক্ষিণ দিল্লির এক জনবসতিতে একই রকমের হিংস্র ভিড় আফ্রিকা থেকে আসা মানুষদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল। যাঁরা খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের মতে, খিড়কি এক্সটেনশনে আফ্রিকান মানুষদের এই পুরনো ডেরা থেকে তাঁদের উৎখাত করাই ছিল সেই আক্রমণের উদ্দেশ্য। প্রোমোটাররা নাকি স্থানীয় ভারতীয়দের লোভ দেখিয়েছিলেন, ওখানে সাদা চামড়ার বিদেশিদের থাকার ব্যবস্থা হবে। ডলার বা ইউরোতে ভাড়া উপার্জন করে লাল হয়ে উঠবেন সাবেক বাড়ি ও জমির মালিকরা। এই খোয়াবে বাদ সাধছিলেন এই কালো মানুষগুলো, যাঁরা বহু কাল ওই এলাকায় সস্তা দরে থেকে অভ্যস্ত। তাঁদের উৎখাত করার জন্য দরকার ছিল একটা হাঙ্গামার। আর সেই হাঙ্গামার অজুহাত হিসেবে যথেষ্ট ছিল সেই পুরনো অভিযোগ— আফ্রিকানরা ড্রাগের ব্যবসা করেন আর ঘরে ঘরে দেহব্যবসা চালান।

দিল্লি নয়ডায় লোকে আফ্রিকানদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ সাক্ষ্যপ্রমাণের তোয়াক্কা করে না। প্রত্যেকেই ‘জানে’, আফ্রিকানরা এই রকমই। মারামারি করে, ড্রাগ পাচার করে, মেয়েরা যৌন ব্যবসা করে। গড়পড়তা দিল্লিবাসী জানে, আফ্রিকানরা আসলে সভ্য মানুষ নয়। তারা এখনও আদিম, মনুষ্যেতর। দিল্লির আফ্রিকান মহল্লায় কিছু দিন কাটালে বোঝা যায়, ভারতীয়দের বর্ণবিদ্বেষ কতখানি তীব্র।

দিল্লির মানুষ আফ্রিকানদের উল্লেখ করতে বলেন ‘হাবশি’। এই শব্দটার সঙ্গে আবিসিনিয়া (এখন ইথিয়োপিয়া) থেকে ভারতে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে আগত ক্রীতদাসদের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। আমেরিকায় ‘নিগার’ শব্দটা যেমন। সেখানে ‘নিগার’ বলা সামাজিক অপরাধ বলে গণ্য হয়। কিন্তু দিল্লিতে, গোটা উত্তর ভারতেই ‘হাবশি’ই প্রচলিত, মান্য। বর্ণবিদ্বেষটা লুকিয়ে রাখতে যতটুকু সচেতনতা প্রয়োজন, সেটুকুও দিল্লিতে নেই। আমরা সভ্য ভারতীয়, গায়ের রং ফরসা করার মলম মাখা আমাদের জন্মসিদ্ধ অধিকার।

কালো মানুষদের প্রতি এই বিদ্বেষ সবার ব্যবহারেই স্পষ্ট। অটো বা ট্যাক্সি চালক, বাজারে সবজি বিক্রেতা, সহপাঠী, সহকর্মী, বাড়িওয়ালা বা বাড়িওয়ালি— কালো মানুষকে সবাই সন্দেহের চোখে দেখে, সুযোগ পেলে ঠকায়ও। বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হওয়ার জলহাওয়া দিল্লিতে নেই। ফলে, যুগের পর যুগ পাশাপাশি বাস করার পরও আফ্রিকান আর ভারতীয়দের মধ্যে অপরিচয়ের অনতিক্রম্য বাধা থেকেই গিয়েছে। অপরিচয় থেকেই তো বিদ্বেষ জন্মায়। নয়ডায় যে পাঁচ নাইজেরীয়ের বিরুদ্ধে নরখাদক হওয়ার অভিযোগ করেছে স্থানীয় মানুষ, যদি সত্যিই তাঁদের সঙ্গে পরিচয় থাকত অভিযোগকারীদের, আফ্রিকান যুবকদের ঘর-গেরস্থালির খবর থাকত ভারতীয় যুবকদের কাছে, জানা থাকত বান্ধবীর জন্য কেমন মন-খারাপ হয় তাঁদের, তা হলেও কি নরখাদক হওয়ার অভিযোগ করা সম্ভব হত? বোধ হয়, না। কালো রঙের ছ’ফুট চার ইঞ্চি লম্বা যুবকটিও যে আমার মতোই নিতান্ত সাধারণ মানুষ, এই কথাটা বোঝার অবকাশই ভারতীয়দের হয়নি। তাগিদ ছিল না বলেই হয়তো।

বেশ কিছু আফ্রিকানের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, অনেকেরই ভারতের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে, সমাজ সম্বন্ধে প্রথম ধারণা তৈরি হয় হিন্দি ছবি দেখে। তার পর সত্যিই যখন তাঁরা ভারতে পৌঁছন, বর্ণবিদ্বেষী রসিকতার সম্মুখীন হয়ে সেই ধারণাটা ভাঙতে সময় লাগে না। ভাষা না বুঝলেও নিগ্রহের শারীরিক ইঙ্গিত খুব সহজেই ধরে ফেলেন তাঁরা।

দিল্লি-নয়ডার চোরাগোপ্তা এবং প্রকাশ্য বর্ণবিদ্বেষ সহ্য করেও যে আফ্রিকানরা ভারতেই থেকে যান, তাঁদের একটা বড় অংশের কাছে এই দেশ আপেক্ষিক রাজনৈতিক ও সামাজিক শান্তির প্রতিশ্রুতি স্বরূপ। গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত স্বদেশের চেয়ে পরবাসের ছোটখাটো নিগ্রহ সহ্য করে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার মূল্য চোকাতে রাজি তাঁরা। ছাত্র হিসেবে এ দেশে আসেন না তাঁরা— ছোট খাবারের দোকান, চুল কাটার সেলুন বা দরজির কাজ করে জীবিকা নির্বাহই তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য। প্রাত্যহিক অপমান আর মাঝেমধ্যে মারধর— তাঁরা জানেন, বেঁচে থাকার জন্য এই দাম তাঁদের চোকাতেই হবে।

এক সময় আলাপ হয়েছিল স্যামুয়েলের সঙ্গে। মাঝে মাঝে সন্ধ্যের দিকে যে সস্তা রেস্তোরাঁয় মোমো খেতে যেতাম, সেখানে স্যামুয়েলও আসত। উগান্ডার ছেলে স্যামুয়েল এক প্রাইভেট ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউটে পড়তে এসেছিল। কিছু কাল আলাপের পরে হঠাৎই এক দিন আমাকে জিগ্যেস করে, ‘তোমরা ভারতীয়রা আফ্রিকার মানুষদের যৌনাঙ্গের দৈর্ঘ্যপ্রস্থ নিয়ে এত মাথা ঘামাও কেন?’ সে দিন উত্তর দিতে পারিনি। স্যামুয়েলের সঙ্গে দেখা হলে আজও বলতে পারব না, আফ্রিকার কালো মানুষদের ‘মানুষ’ বলে ভাবার অভ্যেস আমাদের এখনও হয়নি।

Africans Man-eater
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy