Advertisement
০৯ মে ২০২৪
Atma Nirbhar

বিদেশি বর্জন?

নানা বহুজাতিক সংস্থার ব্র্যান্ড এত পরিচিত, দৈনন্দিন জীবনে সেগুলি এমন অপরিহার্য যে ভারতের অগণিত মানুষ সেগুলিকে বিদেশি বলিয়া ভাবিতে অভ্যস্ত নহেন।

ছবি সংগৃহীত।

ছবি সংগৃহীত।

শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

স্বদেশপ্রেম অতি উত্তম বস্তু, কিন্তু স্বদেশি বস্তু বলিতে কী বুঝায়? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক নির্দেশ জারি করিয়াছে, বিদেশি পণ্য বর্জনীয়। অতঃপর কেন্দ্রীয় পুলিশ কল্যাণ ভাণ্ডারে কোন পণ্যগুলি স্থান পাইবে, তাহার তালিকা প্রকাশিত হইল। এবং, বাতিল হইল। স্বদেশির তালিকায় এত বিদেশি পণ্য ঢুকিয়াছে, আর বিদেশির তালিকায় এতগুলি ভারতীয় ব্র্যান্ড স্থান পাইয়াছে যে তালিকাটি যুগপৎ বিস্ময় ও বিদ্রুপের লক্ষ্য হইয়াছে। পুলিশের প্রতি নাগরিকের সহানুভূতি সুলভ নহে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় পুলিশের প্রতি মায়া জাগিতে পারে। নির্ভেজাল স্বদেশি পণ্যের তালিকা প্রস্তুত করিবার নির্দেশ কি আদৌ পালন করা সম্ভব? প্রায় তিন দশক পূর্বে বিশ্বায়িত অর্থনীতি ও মুক্ত বাজারের অংশ হইয়াছে ভারত। আজ ভারতের বাজারে সুলভ মূল্যের একটি সাবান কিংবা একটি আলুভাজার প্যাকেটও হাতে তুলিয়া বলা চলে না, তাহা সম্পূর্ণ স্বদেশি। ভারতের কারখানায় উৎপন্ন হইলেও উৎপাদক সংস্থার মূল মালিকানা বিদেশি হইতে পারে। আবার নির্মাতা নির্ভেজাল ভারতীয় হইলেও, পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত উপাদান ও নির্মাণ-প্রযুক্তি বিদেশি হইতে পারে। স্বদেশি-বিদেশি ভাগ হইবে কী প্রকারে? এক মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষক পিয়েত্রা রিভোলি একটি ছয় ডলারের টি-শার্টের উৎপত্তি খুঁজিতে বাহির হইয়াছিলেন। নানা দেশ ঘুরিয়া চিনের কারখানায় দাঁড়াইয়া তিনি জানিতে পারেন, যে সুতায় জামাটি নির্মিত, তাহার তুলা চাষ হইয়াছে মার্কিন মুলুকের টেক্সাসে। ‘দ্য ট্র্যাভেলস অব আ টি-শার্ট ইন দ্য গ্লোবাল ইকনমি’ বইটি দেখাইয়াছে, নির্মাণের গতিপথ বিশ্ব ঘুরিয়া স্বদেশে ফিরিতে পারে।

এই সমস্যা আন্দাজ করিয়াই হয়তো কেন্দ্রীয় পুলিশ তালিকায় তিনটি বিভাগ রাখিয়াছিল। যে বস্তুগুলি ভারতীয় সংস্থার তৈরি ও ভারতে উৎপন্ন; যেগুলি বিদেশি সংস্থার পণ্য কিন্তু ভারতে উৎপাদিত; এবং, যেগুলি বিদেশি সংস্থার বিদেশে নির্মিত পণ্য। ইহার পরেও যে তালিকায় অনেকগুলি বহুজাতিক সংস্থার পণ্য ভারতীয় বলিয়া স্থান পাইল, সে জন্য ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকের হয়তো তিরস্কার জুটিয়াছে। কিন্তু সম্ভবত তাঁহার ভ্রান্তি এক বৃহত্তর প্রবণতার প্রতিফলন। নানা বহুজাতিক সংস্থার ব্র্যান্ড এত পরিচিত, দৈনন্দিন জীবনে সেগুলি এমন অপরিহার্য যে ভারতের অগণিত মানুষ সেগুলিকে বিদেশি বলিয়া ভাবিতে অভ্যস্ত নহেন। বস্তুত এই বাছবিচার ভারতীয় জীবনে অনেকটাই অবান্তর হইয়া গিয়াছে। চিনে প্রস্তুত গণেশমূর্তি স্বচ্ছন্দে পূজিত হয়, চিনা আলোকমালায় দীপাবলি সাজিয়া ওঠে। মার্কিন সংস্থা যখন ইটালির পিৎজ়াকে ‘পনির টিক্কা মসালা’-র স্বাদ-গন্ধে ভারতে বিক্রয় করে, তখন তাহার উৎপত্তির সন্ধান অর্থহীন হইয়া যায়। এমনকি খাদিও স্বদেশি কি না, প্রশ্ন উঠিতে পারে। কারণ তুলা চাষি সাধারণত বহুজাতিকের বীজ, সার, কীটনাশক ব্যবহার করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁহার বহু লেখায় বুঝাইয়াছেন, অন্ধ স্বদেশপ্রীতির বিপদ কোথায়। ঘরে-বাইরে উপন্যাসে দেখাইয়াছেন, স্বদেশি ব্যবহারের অনুজ্ঞা দরিদ্রের জীবনে কত সঙ্কট তৈরি করিতে পারে। বিদেশি পণ্যমাত্রই বিলাসদ্রব্য নহে। বহু অত্যাবশ্যক বস্তু বহুজাতিক সংস্থা সুলভে দিয়া থাকে। স্বদেশি শিল্পকে উৎসাহ দেওয়ার বহু উপায় আছে। কিসে দেশের সমাজের ভাল হইবে, তাহা আবিষ্কার করাই দেশের ভাল করিবার একমাত্র পথ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Atma Nirbhar India Globalisation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE