Advertisement
০৫ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

‘সর্বজন’ মুখে আছেন, মনে নেই

অনেককেই প্রবল বিস্মিত করে গত এক বছরে সর্বজনীন উন্নয়নের প্রবক্তা হয়ে উঠেছেন নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু, অর্থনীতি থেকে সমাজ, ছবিটা কোথাও বিশেষ বদলায়নি। সবার অন্তর্ভুক্তি এখনও কথার কথা মাত্র।ই নক্লুসিভ’ বা ‘সর্বজনীন’ শব্দটার প্রতি নরেন্দ্র মোদীর বেশ দুর্বলতা রয়েছে। গত এক বছরে তাঁর এমন একটা ভাষণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যেখানে ‘সর্বজনীন’ শব্দটা নেই। অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে অবধি বোঝাই যায়নি যে তাঁর কাছে সর্বজনীনতার ধারণাটি এত গুরুত্বপূর্ণ। বরং, উল্টো আশঙ্কা ছিল।

সর্বজনীন? নরেন্দ্র মোদী, ঢাকা, জুন ২০১৫। ছবি: এএফপি

সর্বজনীন? নরেন্দ্র মোদী, ঢাকা, জুন ২০১৫। ছবি: এএফপি

ভাস্কর চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৫ ০০:১৯
Share: Save:

ই নক্লুসিভ’ বা ‘সর্বজনীন’ শব্দটার প্রতি নরেন্দ্র মোদীর বেশ দুর্বলতা রয়েছে। গত এক বছরে তাঁর এমন একটা ভাষণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যেখানে ‘সর্বজনীন’ শব্দটা নেই। অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে অবধি বোঝাই যায়নি যে তাঁর কাছে সর্বজনীনতার ধারণাটি এত গুরুত্বপূর্ণ। বরং, উল্টো আশঙ্কা ছিল। গুজরাতে যেমন তিনি মুসলমানদের ব্রাত্য করে রেখেছিলেন, অথবা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যেমন কার্যত একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, তার ফলে প্রশ্ন উঠছিল যে, পারবেন তো তিনি সবাইকে নিয়ে চলতে?

মুখ থুবড়ে পড়া ভারতীয় অর্থনীতিকে তিনি ফের সচল করবেন, ঊর্ধ্বগামী করবেন, মূলত এই প্রতিশ্রুতির জোরেই দিল্লির মসনদ দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। অথচ, গত এক বছরে তিনি যত কথা বলেছেন, তাতে দ্রুত বৃদ্ধির তুলনায় সর্বজনীন বৃদ্ধির প্রসঙ্গ এসেছে অনেক বেশি। এক মার্কিন পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বললেন, ‘আমার, আমাদের দলের এবং সরকারের দর্শন হল ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’। এই দর্শনের মূল কথা হল, সবাইকে সঙ্গে নিতে হবে, এবং এগোতে হবে সর্বজনীন বৃদ্ধির দিকে।’

গত এক বছরে নরেন্দ্র মোদী যা-ই করেছেন, প্রায় সবের গায়েই সর্বজনীনতার আভা লেগেছে। এমনকী, বিদেশ সফরে গিয়েও সর্বজনের কথা উল্লেখ করতে ভোলেননি মোদী। জাপান সফরে গিয়ে বলেছেন, ‘আমি ভারতে যে সর্বজনীন উন্নয়নের স্বপ্ন দেখি, জাপান কী ভাবে তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, আমরা সেই সম্ভাবনা খতিয়ে দেখব।’ জার্মানিতে বললেন, ‘আমাদের লক্ষ্য শুধু আর্থিক বৃদ্ধি নয়, আমরা চাই সর্বজনীন উন্নয়ন।’ তিনি যে শুধু ভারতের সর্বজনের কথাই ভেবেছেন, তা-ও নয়। কোরিয়ায় বললেন, ‘দেশের মধ্যে যেমন আর্থিক বৃদ্ধি সর্বজনীন হওয়া জরুরি, আন্তর্জাতিক পরিসরেও তা-ই’। শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট শ্রীনিসেনার প্রশংসা করতে গিয়েও তাঁর কথায় এল সর্বজনের প্রসঙ্গ। মোদী বললেন, ‘তিনি যে ভাবে দেশের জন্য সর্বজনীন ভবিষ্যৎ নির্মাণ করছেন, আমরা সপ্রশংস দৃষ্টিতে সে দিকে নজর রাখছি।’ তবে, মোদী যে শুধু প্রশংসা করেছেন, তা নয়, প্রশংসা পেয়েছেনও। ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত রিচার্ড রাহুল শর্মা বলেছেন, ‘ভারত যে ভাবে সর্বজনীন আর্থিক বৃদ্ধির অনুকূল নীতি নির্মাণের মাধ্যমে আঞ্চলিক মহাশক্তি হয়ে উঠছে, তা লক্ষ করার মতো।’

গত এক বছরে তাঁর মুখে ‘ইনক্লুসিভ’ কথাটি এত বার শোনা গিয়েছে যে জানতে ইচ্ছে করবেই, তাঁর কাজে কথাটা কতখানি জায়গা পেল। অস্বীকার করার উপায় নেই, ভারত দীর্ঘ দিন ধরে ইনক্লুশন ডেফিসিট বা সর্বজনীন অন্তর্ভুক্তির ঘাটতিতে ভুগছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের ইকনমিক অ্যান্ড স্যোশাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক সম্প্রতি একটি ইনক্লুসিভনেস ইনডেক্স তৈরি করেছে। তাতে মোট ১৬টি দেশের মধ্যে ভারত রয়েছে চতুর্দশতম স্থানে। উন্নয়নের স্রোতে সাধারণ মানুষের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে শুধু কম্বোডিয়া আর পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে ভারত। কাজেই, উন্নয়নকে সর্বজনীন করে তোলা যে অত্যন্ত জরুরি, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হল, মোদীর নীতি কি সেই পথে হাঁটছে?

আগামী কয়েক বছরে ভারতের ইনক্লুসিভনেস ইনডেক্স ছাদ ফুঁড়ে বেরিয়ে যাবে, এমন কথা ভাবার বিশেষ কোনও কারণ নরেন্দ্র মোদীর শাসনের প্রথম এক বছরে পাওয়া গেল না। সব সূচক বলছে, অদূর ভবিষ্যতে দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধিই সরকারের লক্ষ্য হবে— শ্লথ, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঝামেলাবহুল, সর্বজনীন বৃদ্ধি নয়। মনে রাখা ভাল, সর্বজনীন বৃদ্ধি শুধু জিডিপি-র বৃদ্ধির হারে পরিমেয় একটি সংখ্যা নয়, বস্তুত তা কোনও নীতির ফলাফলও নয়— সর্বজনীন বৃদ্ধি একটি প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ায় দেশের আর্থিক বিকাশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় মানুষ যোগ দিতে পারেন, সেটাই সর্বজনীন বৃদ্ধির পথ। তাতে যেমন সর্বাধিক সংখ্যায় মানুষের যোগদান প্রয়োজন, তেমনই বৃদ্ধির ফলের সুষম বণ্টনও প্রয়োজন।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই কঠিন পথে হাঁটার আগে কি দেশের থমকে থাকা অর্থনীতিকে ফের গতিশীল করে তোলা জরুরি নয়? ঠিকই, সেই সিদ্ধান্ত করতে হবে। অতীতে যে দেশগুলির অর্থনীতি দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, কার্যত তার কোনওটিতেই গোড়ার দিকে বৃদ্ধি সর্বজনীন ছিল না। হাতে সম্পদ যেহেতু সীমিত, তাই যেখানে সবচেয়ে দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব, তেমন কিছু ক্ষেত্রকে, কিছু অঞ্চলকে, নাগরিকদের একটি নির্দিষ্ট অংশকে বেছে নিতে হয়েছিল।

নরেন্দ্র মোদী ভারতে উন্নয়নকে সর্বজনীন করার জন্য এখনও অবধি কী করেছেন, সেটা মূলত তিনটে পৃথক দিক থেকে বিচার করা সম্ভব।

প্রশাসনিক অন্তর্ভুক্তির কিছু কিছু মাপকাঠিতে মনে হওয়া সম্ভব, সত্যিই নরেন্দ্র মোদীর আমলে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতার কাঠামোটি চরিত্রে অনেকখানি বিকেন্দ্রিত হয়েছে, তাতে অনেক বেশি মানুষের অন্তর্ভুক্তির সুযোগ হয়েছে। মোদী রাজ্যগুলির হাতে অনেক বেশি ক্ষমতা ছেড়েছেন, অনেক বাড়তি টাকা দিয়েছেন। কিন্তু, খেয়াল করে দেখার, এই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার রাশ রয়েছে কেন্দ্রেরই হাতে। মোদীর প্রশাসন পরিচালনার ধরনটা লি কুয়ান ইউ-এর ঘরানার। যাঁরা তাঁর সহকারী, তাঁরা যে নির্ভয়ে তাঁর সঙ্গে তর্ক করবেন, তাঁর অবস্থানকে প্রশ্ন করবেন, এবং সব মিলিয়ে একটি বৃহত্তর নেতৃত্ব তৈরি হবে, যেখানে এক এক জনের ওপর এক এক গোত্রের দায়িত্ব ন্যস্ত হবে— নরেন্দ্র মোদীর আমলে সে সুযোগ নেই। বিদেশ নীতিই হোক অথবা বাজেট, বা আমলাতন্ত্রের সংস্কার, সবেতেই নরেন্দ্র মোদীর নিজস্ব ছাপ স্পষ্ট। নেতৃত্ব এবং প্রশাসনের এই মডেলের সঙ্গে সর্বজনীনতার দূরত্ব যে অনেকখানি, অস্বীকার করার উপায় নেই।

অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির ছবি বলছে, নরেন্দ্র মোদীর মন কোন দিকে, বোঝা অত্যন্ত সহজ। তিনি নির্মাণশিল্প বা পরিকাঠামোর মতো ক্ষেত্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তাঁর নজরে রয়েছে আরও বেশি বিদেশি লগ্নি। অর্থনীতির উন্নতির এটা একটা পথ, সন্দেহ নেই। কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা ঋণকে আরও বেশি করে সাধারণ মানুষের আওতায় আনাও উন্নয়নের পথ— প্রাথমিক ভাবে পরোক্ষ পথ, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত জরুরি পথ। এই বিষয়গুলির দিকে তাঁর তেমন নজর রয়েছে, এমন দাবি করা মুশকিল।

শিক্ষার কথাই ধরুন। গত বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ ১৬ শতাংশ কমানো হয়েছে। ভারতের জনসমষ্টি ক্রমে তরুণতর হচ্ছে। কিন্তু, সেই তরুণদের জন্য পেশামুখি শিক্ষা, বা একেবারে প্রাথমিক শিক্ষারও, অভাব প্রকট। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দের অবস্থা এমনিতেই খারাপ। ২০১২ সালে ভারতে জিডিপি-র ৩.৮ শতাংশ বরাদ্দ হয়েছিল শিক্ষাখাতে। তার দু’বছর আগে, ২০১০ সালে, গোটা দুনিয়ায় এই অনুপাতের গড় ছিল ৪.৯ শতাংশ। নরেন্দ্র মোদীর বাজেটে শিক্ষা নিয়ে কিছু বিচ্ছিন্ন প্রতিশ্রুতি আছে। যেমন, ২০২২ সালের মধ্যে ৫০ কোটি তরুণের পেশামুখি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হবে, তৈরি হবে আরও আইআইটি, আইআইএম। কিন্তু, বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা নিয়ে যে বাস্তবসম্পন্ন এবং গোছানো নীতির প্রয়োজন ছিল, তার চিহ্ন নেই।

স্বাস্থ্যক্ষেত্রের ব্যয়বরাদ্দেও কেন্দ্রীয় বাজেটে কাটছাঁট হয়েছে। দায়িত্বের অনেকটাই ঠেলে দেওয়া হয়েছে রাজ্যগুলির দিকে। পরিবেশের বিভিন্ন সমস্যা, যেমন ভারতের বড় শহরগুলিতে ক্রমবর্ধমান বায়ুদূষণ, অথবা দেশের সর্বত্র পরিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ গুরুত্ব পায়নি। শৌচাগার নির্মাণ নিয়ে প্রচুর ঢাকঢোল বেজেছে বটে, কিন্তু এই খাতে বর্তমান সরকারের রেকর্ড তার পূর্বসূরির তুলনায় খারাপ।

আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে অবশ্য কিছু উন্নতি হয়েছে। এক সপ্তাহে সর্বাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার রেকর্ড করেছে এই সরকার— প্রধানমন্ত্রী জনধন যোজনায় গত বছর অগস্টের ২৩ থেকে ২৯ তারিখের মধ্যে মোট ১,৮০,৯৬,১৩০টি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল। তবে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা সূচনামাত্র। সেটাকে সত্যিই উন্নয়নের হাতিয়ার করে তুলতে হলে অনেক কাজ এখনও বাকি।

সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ছবি আরও খারাপ। হিন্দুত্ববাদীরা যখন দাপিয়ে বেড়াতে আরম্ভ করলেন, নরেন্দ্র মোদী দিব্য অন্য দিকে তাকিয়ে ছিলেন। গত এক বছরে সংখ্যালঘুরা, বিশেষত মুসলমানরা, আরও বেশি কোণঠাসা হয়েছেন। মাঝেমধ্যে একটা টুইট অথবা মৃদু তিরস্কারের বেশি তাঁর কাছে কিছু পাওয়া যায়নি। সঙ্ঘ পরিবারকে বারদুয়েক বলেছেন, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ‘হেট স্পিচ’ বরদাস্ত করবেন না। কিন্তু, ওই পর্যন্তই। ঘটনাগুলিকে আটকানোর চেষ্টাও করেননি, অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেননি। বরং, গো-হত্যার ওপর নিষেধাজ্ঞা বা স্কুলের পাঠ্যক্রমে ভগবৎগীতার অন্তর্ভুক্তি আমাদের ক্রমে আরও ভিন্নতা-অসহিষ্ণু সমাজের দিকে ঠেলছে। সর্বজনীনতার উল্টো দিকে।

নরেন্দ্র মোদীর মুখে যতই সর্বজনীনতার কথা থাক না কেন, মনে সম্ভবত নেই। বলতেই পারেন, ভারতীয় রাজনীতিতে মুখে গরিবদের কথা না রেখে তাঁর, বা অন্য কারও, কোনও উপায় নেই। কিন্তু, মুখের আর মনের ফারাক যে মানুষ বেশি দিন বরদাস্ত করেন না, সেটাও প্রতিষ্ঠিত সত্য। কাজেই, মোদীর সামনে দুটো পথ খোলা রয়েছে। এক, তিনি জানিয়ে দিতে পারেন, তাঁর সম্বন্ধে বেশির ভাগ লোকের ধারণাই ঠিক— তিনি আসলে ট্রিকল ডাউন তত্ত্বে বিশ্বাসী। দুই, মুখে যেমন সর্বজনীনতার কথা বলেন, নীতিনির্ধারণে এবং অর্থবরাদ্দের ক্ষেত্রেও সেটাই করে দেখান।

নচেৎ, ইতিহাস হয়তো বলবে, নরেন্দ্র মোদীর প্রথম বছরের পরই তাঁর ‘অচ্ছে দিন’ ফুরিয়ে গিয়েছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টাফট্স ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার ইনস্টিটিউট ফর বিজনেস-এর ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস অ্যান্ড ফিনান্স বিভাগের অ্যাসোসিয়েট ডিন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE