Advertisement
E-Paper

জনপরিষেবা ঠিক কার জন্য

বিশুদ্ধ বিদ্যোৎসাহী বলবেন, খাবারের লোভে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে কেন? যাবে তো লেখাপড়ার টানে। তাঁদের কাছে নিবেদন, পুত্রকন্যা নাতিনাতনিকে এক দিন সকাল থেকে না-খাইয়ে রাখুন। শরীরের কোনও ক্ষতি হবে না, কিন্তু দেখবেন সন্ধ্যাবেলা তাদের হোমটাস্কে কেমন মন বসে।

সুকান্ত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:২১
—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

প্রজাতন্ত্র দিবসের পর প্রথম দিনের কাগজেই খবরটা পড়লাম। হাওড়া জেলার চারটি প্রাথমিক স্কুলে এক-দেড় বছর মিড-ডে মিল বন্ধ। বঞ্চিত প্রায় ৬০০ শিশু। অবধারিত ভাবে তাদের বড় অংশ স্কুলছুট, অনেকে শিশুশ্রমে নিযুক্ত, বিপথে-কুপথে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা। অবস্থার হেতু, অভ্যন্তরীণ বিবাদের ফলে স্থানীয় কাউন্সিলর কাগজপত্র সই করছেন না। এমনটাই প্রতিবেদন; ভদ্রলোকের নিজের ব্যাখ্যা নিশ্চয় অন্য রকম। মোদ্দা কথা, তাঁর সইয়ের অভাবে ৬০০ শিশুর একবেলা খাওয়া জুটছে না, অনেকের লেখাপড়া বন্ধ। ধরে নেওয়া যায়, অবস্থার প্রতিকার হলেও অনেকে স্কুলে ফিরবে না। সংশ্লিষ্ট সরকারি আধিকারিক মন্তব্যে নারাজ, কর্তব্য পালনে স্পষ্টত অপারগ বা অসহায়। জেলা প্রশাসন ও স্কুলশিক্ষা দফতর তথৈবচ, হয়ত বিষয়টা তাঁদের কানে পৌঁছয়নি। কেন পৌঁছয়নি, সেটাও তবে প্রশ্ন।

কিছু বিশুদ্ধ বিদ্যোৎসাহী বলবেন, খাবারের লোভে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে কেন? যাবে তো লেখাপড়ার টানে। তাঁদের কাছে নিবেদন, পুত্রকন্যা নাতিনাতনিকে এক দিন সকাল থেকে না-খাইয়ে রাখুন। শরীরের কোনও ক্ষতি হবে না, কিন্তু দেখবেন সন্ধ্যাবেলা তাদের হোমটাস্কে কেমন মন বসে। দরিদ্রতম পিতামাতা আজ সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে উদ্‌গ্রীব, সে জন্য বহু কৃচ্ছ্রসাধন করেন। তাঁরা সন্তানকে স্কুল থেকে ছাড়ান অনেক অন্তর্দহের পর— কিংবা (যা আরও মর্মান্তিক) নিরুত্তাপ ভাবে, গরিবের সন্তানের ভবিতব্য মেনে। তাঁরা সংবিধান পড়েননি, তাঁদের আশা-স্বপ্ন যে আইনসিদ্ধ অধিকার তা জানেন না। আমরা যারা জানি, এমন খবরে আমরাই বা উত্তপ্ত হচ্ছি কই?

স্বাধীন ভারতে দরিদ্রতম শ্রেণিরও কিছু মৌলিক উন্নতি অবশ্যই ঘটেছে। প্রাপ্যের অল্পবিস্তর অংশ জুটছে, জুটছে ন্যূনতম শিক্ষার সুযোগ। গত পাঁচ-ছয় বছরে এ-রাজ্যে স্কুলশিক্ষা, শিশুকল্যাণ আর সামাজিক উন্নয়নে সত্যিকারের জনহিতকর কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে। সেই কর্মকাণ্ড নস্যাৎ করতে নয়, ত্রুটিমুক্ত করতেই কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলতে হয়। এত প্রচার, এত নির্ঘোষিত সদিচ্ছা, কিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্য সত্ত্বেও বঞ্চনা ও অপশাসনের নজির মাঝে-মাঝেই খবরে উঠে আসে কেন? খবর হচ্ছে না, হিমশৈলের সেই অদৃশ্য অংশটাই বা কত?

বিপত্তি বাধিয়েছেন এক জনপ্রতিনিধি। গণতন্ত্রের কেতাবি পাঠ বলে, জনকল্যাণ সম্বন্ধে জনপ্রতিনিধিরা সজাগ থাকেন, কর্তব্যের তাড়নায় না হলেও ভোটের তাগিদে। এই কাউন্সিলর মহোদয় স্পষ্টই সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত। হতে পারে ৬০০ ছেলেমেয়ের অভিভাবক ভোটের হিসাবে অল্প; অতএব ব্যাপারটা, রাজনীতিকদের অভ্যস্ত ভাষায়, ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’। বা হতে পারে, সেই অভিভাবকরা এত সত্ত্বেও ভবিষ্যতে এঁকেই ভোট দেবেন: হয়তো হিংসা-হুমকির ফলে, হয়তো কোনও প্রাপ্তি বা প্রলোভনের বিনিময়ে, হয়তো নিছক স্রোতের টানে। সবগুলি কারণের মূল তাৎপর্য এক: নাগরিকের আত্মসম্মান ও অধিকারবোধ দুর্বল, ক্ষমতাবানের কর্তৃত্ব সার্বিক ও নিরঙ্কুশ। নিচুতলার নেতারাও তাই প্রবল হয়ে ওঠেন, ক্ষুদ্র মানুষের উপর ক্ষুদ্রমনা স্বৈরাচার অধিকার নয়, প্রায় কর্তব্য জ্ঞান করেন।

এমন অবস্থায় হিতকর প্রকল্পও হয়ে পড়ে দয়ার দান বা দৈবের আশীর্বাদ: নাগরিক অধিকারের প্রাপ্তি নয়, ব্যক্তি বা দল-বিশেষের দাক্ষিণ্য। দাক্ষিণ্যের উপর কারও দাবি থাকে না: পেলে কৃতার্থ হই, না পেলে নালিশ করা চলে না। ভিক্ষার চাল আবার কাঁড়া আর আকাঁড়া।

জনপরিষেবা এমন অবতারলাভ করলে ক্ষমতাবানদের সুবিধা। প্রাপ্যের একাংশ ঘুষ, চুরি বা তোলাবাজিতে হাত-ছাড়া হলে লোকে রাগ করে না, বাকিটা পেয়েই খুশি হয়। হেনস্তা বা দুর্ব্যবহার শিরোধার্য করে। এ-সব উপদ্রব যেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের শামিল: ঝড় বা ভূমিকম্প নিয়ে কি প্রতিবাদ চলে? তবে মধ্যবিত্তের কাছে যা মৃদু ভূমিকম্প, গরিবের ভিটেমাটি তাতেই বিধ্বস্ত হয়। হাওড়ার ওই ৬০০ ছেলেমেয়ের কয়েক জন হয়তো সত্যিই লেখাপড়া শিখে জীবনে উন্নতি করত, সেই রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল।

এ-সব ক্ষেত্রে আমলাকুলের অবস্থান কৌতূহলপ্রদ। তাঁদের কেতাবি দায়িত্ব, রাজনৈতিক দোলাচলের ঝাপটা এড়িয়ে স্থিতিশীল নিয়মনিষ্ঠ প্রশাসন চালানো। নিয়মনিষ্ঠা মানে অন্ধ আমলাতন্ত্র নয়: দ্বিতীয়টি প্রথমটির বিপরীত, স্বৈরাচারেরই নামান্তর। রাজনৈতিক স্বৈরাচারের সঙ্গে তার সহজ সহাবস্থান, উভয় উভয়ের হাতিয়ার। আমলাকুল মেনে নেন, সুষ্ঠু ন্যায্য পদ্ধতির বদলে প্রশাসনের চালিকাশক্তি হবে রাজনৈতিক প্রভুদের গোষ্ঠীস্বার্থ, অদূরদর্শিতা এমনকী খামখেয়াল। আর সেই আজ্ঞাপালনের তাগিদেই আমলাদের দেওয়া হবে প্রজাদের উপর অনুরূপ কর্তৃত্বের অধিকার।

এমন বাণিজ্য সত্ত্বেও ভাল কাজ হতে পারে, হয়তো যথেষ্ট পরিমাণে— গণতন্ত্র, আইন ও প্রশাসনিক কাঠামোর অবশিষ্টটুকুর কল্যাণে, কখনও বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের ‘পিপল-স্যাভি’ নাড়িজ্ঞানে। তার দৃষ্টান্ত কয়েক দশকের তামিলনাড়ু বা আজকের পশ্চিমবঙ্গ। বিপদ এই, এর পিছনে গণতান্ত্রিক নিষ্ঠার চেয়ে বেশি কাজ করে জনতাকে মুগ্ধ ও বশীভূত করার তাগিদ: পরিষেবক ও নাগরিক নয়, দাতা ও গ্রহীতার সম্পর্কস্থাপন, অতএব প্রজার পক্ষে অনুগৃহীতের গ্লানি বা মোহগ্রস্তের বিভ্রান্তি। শেষে এক দিন দুর্বল কাঠামো দৃশ্যত টলে ওঠে: ধরা পড়ে, জনসন্তুষ্টির আড়ালে জনস্বার্থ বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। টাটকা দৃষ্টান্ত আজকের তামিলনাড়ু। বাংলার যেন এমন পরিণতি না হয়।

বিপর্যয়ের বীজ লুকিয়ে থাকে হাওড়ার এই পরিস্থিতির মতো ঘটনায়। ৬০০ শিশু, তাদের ১২০০ বাবা-মা: রাজ্যের জনসংখ্যার হাজার ভাগের ২ শতাংশের কম। ব্যাপারটা বাকিদের গ্রাহ্যে আসে না: ক্ষতিটা অন্য লোকের, ‘আমাদের’ নয়। এই ‘বিচ্ছিন্ন’ স্খলনগুলি কত দূর সামাল, এমনকী প্রশ্রয় দেওয়া চলে সে অঙ্ক বিচক্ষণ রাজনীতিকের সহজাত পাটিগণিত, বিমানসংস্থা যেমন হিসাব করে ক’জন বাড়তি যাত্রী ‘ওভার-বুক’ করা চলে।

অঙ্ক না মিললে বিমানকর্তাদের মতো রাজ্যপাটের কর্তারাও ফেঁসে যান। সেটা তাঁদের চিন্তা। সাধারণ মানুষের সমস্যা, বিন্দু জুড়ে-জুড়ে যেমন রেখা সৃষ্টি হয়, ছিদ্রে-ছিদ্রে জুড়ে হয় বিশাল গহ্বর, গ্রাস করে ক্ষুদ্র প্রাণীদের। উন্নয়নের পাশাপাশি রাজ্যে হিংসা, লোভ ও অনাচারের বিচিত্র প্রকাশ কি সংযত হচ্ছে? দৃষ্টিনন্দন নির্মাণে যতটা, মানবসম্পদ ও পরিচালনায় ততটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কি? উৎসব-উদ্বোধন যত প্রাণবন্ত, পরবর্তী দেখভাল কি সেই অনুপাতে? যদি না-হয়, উন্নয়নই বা কতটা ফলপ্রসূ ও দীর্ঘস্থায়ী হবে?

ভারত জুড়ে উন্নয়নের নামে কোটি কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত ও নিঃসহায় হয়েছে। আমাদের সৌভাগ্য, এ রাজ্যে উন্নয়ন অত চটকদার নয় বলেই তার মানবিক মাত্রা তুলনায় বহাল আছে। হাওড়ার ওই ৬০০ শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে তাই না ভাবলেই নয়।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক

Public service Midday meal মিড-ডে মিল জনপরিষেবা
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy