প্রতীকী ছবি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত ব্যবধানে একটি করিয়া হইহই তুলিয়া দেওয়া হয়। মানুষেও সেই আহ্লাদে গা ভাসাইয়া বহু আমোদ করিয়া লন। যে হেতু ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপেই এখন বহু মানুষের জীবনের প্রধান অংশটিই অতিবাহিত হয়, ফলে ওই দেশে যে উৎসব হইবে তাহাতে শামিল না হইলেই তাঁহাদের হীনম্মন্যতা জন্মে, নিজেদের সমাজ-বিচ্ছিন্ন বলিয়া মনে হয়। তাই যখন কেহ বলেন, এই হইল প্রিয় দশটি বইয়ের তালিকা, অমনি সকলে হুড়াহুড়ি করিয়া নিজের প্রিয় বইয়ের তালিকা পোস্ট করিতে থাকেন। কেহ বলিলেন, বরফশীতল এক বালতি জল নিজ গাত্রে ঢালিয়া দেখান তো দেখি, অমনি কয়েক জন বিখ্যাত মানুষ তাহা করিলেন এবং সাধারণ মানুষের লাইন পড়িয়া যাইল, বালতি হস্তে। এমনি করিয়া বহু ‘চ্যালেঞ্জ’ মানুষের সম্মুখে উপস্থিত হইতেছে। কখনও বলা হইল, ভারতীয় নারীগণ একশত শাড়ি পরুন এক বৎসরের মধ্যে এবং তাহার প্রতিটির ছবি দিন। কখনও বলা হইল, পুরুষগণ দাড়ি কামাইবেন না এক মাস এবং তাহার ছবি দিবেন। এখন প্রবল উৎসাহে পালিত হইতেছে দশ বৎসরের চ্যালেঞ্জ। অর্থাৎ, যে কেহ তাঁহার দশ বৎসর পূর্বের একটি ছবি দিবেন আর এখনকার একটি ছবি দিবেন, অন্যেরা দেখিয়া চুকচুক করিয়া সমবেদনা প্রকাশ করিবেন ও বলিবেন, মা কী ছিলেন ও কী হইয়াছেন! খেলাটিতে জয়ী নিশ্চয়ই তাঁহারা হইবেন যাঁহাদের রূপ এই দশ বৎসরে বাড়িয়া উঠিয়াছে বা অপরিবর্তিত থাকিয়াছে। আর যাঁহারা দশ বৎসর পূর্বে যৌবনরাজ্যের অন্তর্গত ছিলেন এবং এখন সেই নাগরিকত্ব হারাইয়াছেন, তাঁহাদের তিক্ত দীর্ঘশ্বাসের পার্শ্বে একটি মধুর হ্রস্বশ্বাসও উৎপন্ন হইতেছে, যাহা স্মৃতিমেদুর ও মহাকালের ধর্ম বিষয়ক দর্শনে ঋদ্ধ। এই চ্যালেঞ্জ লইয়া রসিকতাও শুরু হইয়াছে। সম্প্রতি বিবাহিতা এক ভারতীয় নায়িকা, যিনি বয়সে বেশ কনিষ্ঠ এক পুরুষকে বিবাহ করিয়াছেন, তাঁহার দশ বৎসর পূর্বের এক ছবির ক্রোড়ে এক শিশুর ছবি দিয়া বুঝানো হইতেছে, সেই শিশুই কি আজ স্বামী! কোথাও মহেঞ্জোদড়োর শ্মশ্রুবিশিষ্ট পুরুষমূর্তির ছবি দিয়া ও পার্শ্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মুখ দিয়া লিখা হইতেছে, ইহা পাঁচ সহস্র বৎসরের চ্যালেঞ্জ!
কেহ কেহ চ্যালেঞ্জটিকে ব্যবহার করিয়া বাস্তবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকেও নজর টানিতেছেন। কেহ দশ বৎসর পূর্বের পরিবেশের সহিত এখনকার অধিক দূষিত পরিবেশের পার্থক্য স্মরণ করাইয়া দিয়া, পরিবর্তিত সমুদ্রতল বা গলিত হিমবাহের ছবি দিয়াছেন। কেহ এই মুহূর্তে যুদ্ধধ্বস্ত দেশের ছবি পোস্ট করিয়া বলিয়াছেন, দশ বৎসর পূর্বে এই দেশে সুসময় ছিল। সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাকের ছবি এই সূত্রে পোস্ট করা হইয়াছে। সিরিয়ার আট বৎসর ব্যাপী গৃহযুদ্ধের কথা স্মরণ করাইয়া দিয়া কেহ লিখিয়াছেন, দশ বসর পূর্বে কে কেমন দেখিতে ছিলেন, তাহার হুজুগে অনেকেই হয়তো উপেক্ষা করিয়া যাইতেছেন, দশ বৎসরে কিছু রাষ্ট্র কেমন করিয়া অমূল্য জীবন ও সংস্কৃতি ধ্বংস করিয়াছে। ইরানের এক অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী, যিনি মহিলাদের ফুটবল খেলা দেখিবার নিষেধের বিরুদ্ধে সরব হইয়াছিলেন, তিনি তাঁহার প্রতিবাদধর্মী প্ল্যাকার্ড হস্তে ছবি দিয়া যাহা লিখিয়াছেন, তাহার মর্ম: দশ বৎসর পূর্বেও নারীর অধিকারের জন্য লড়িতাম, এখনও লড়িতেছি। কোনও কোনও সমকামী বা রূপান্তরকামী তাঁহাদের দশ বৎসর পূর্বের বিষণ্ণ মুখ ও বর্তমানের সুখী মুখের ছবি দিয়া লিখিয়াছেন, সংগ্রাম চলিতেছে, কিন্তু গত দশকে তাঁহাদের অধিকার সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি পাইয়াছে বলিয়া তাঁহারা আনন্দিত। ইহাও সমাজমাধ্যমের এক বৈশিষ্ট্য, যদি কোনও কিছু নিতান্ত হুজুগ হিসাবে শুরুও হয়, তথাপি সেইটিকে ব্যবহার করিয়া যথার্থ গুরুত্বপূর্ণ বার্তা সরবরাহ করিবার মানুষও এই মাধ্যমে বহু রহিয়াছেন। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জাতি যদি এই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করে, বেশ ঝামেলায় পড়িবে। কারণ এই এক জাতি, যাহার কোনও প্রকৃত পরিবর্তন কখনওই হয় না। যথা পূর্বং তথা পরং মানিয়া এই জাতি একই মুখমণ্ডল দুইটি ক্ষেত্রেই সাঁটিয়া দিতে পারে। বাঙালি হলফ করিয়া বলিতে পারে, সে দশ বৎসর পূর্বের ন্যায়ই অলস পরশ্রীকাতর বাক্সর্বস্ব হীনবল ক্ষীণপ্রাণ থাকিয়া গিয়াছে, এবং এই চ্যালেঞ্জটিকে প্রসারিত করিয়া সে গর্বের সহিত হাঁকিতে পারে, দশ বৎসর পরেও একই রকম থাকিবে, তাই সেই ভবিষ্যৎ-স্বচিত্রও এখন হইতেই দিবার যোগ্যতা এই বিশ্বে কেবলই তাহারই রহিয়াছে!
যৎকিঞ্চিৎ
ব্রিগেডে বিরাট জনসভা, কলকাতা জুড়ে উৎসবের মেজাজ। অর্ধেকই বেরয়নি, বাড়িতে টিভি দেখছে, যারা বেরিয়ে ধর্মতলা চত্বরে যাচ্ছে, সকলকেই হাঁটতে হচ্ছে; শীতের সকালে ব্যায়ামে ফাঁকি পড়ে যায়, সে অভাব মিটে যাওয়ার আনন্দে সবাই উদ্ভাসিত। কেউ খাচ্ছে, কেউ বিনিপয়সার ট্যাঙ্ক থেকে বোতলে জল ভরছে, কেউ দোকানে জিনিস দেখছে, অনেকে স্লোগানরত। যুগে যুগে ব্রিগেড পিকনিক-আমোদ জুগিয়ে আসে, ভোটের ফল যা-ই হোক, ব্রিগেডের ফল সদা মিষ্ট!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy