Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

বিশ্বকবির ‘আদিকবি’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ব্যক্তি-বিদ্যাসাগর খুব একটা রম্য অনুভূতি গড়ে তুলতে পারেননি বালক রবীন্দ্রনাথের মনে। কিন্তু সীতার বনবাস, শকুন্তলা, বেতাল পঞ্চবিংশতি, বোধোদয়— এইসব বইয়ের মধ্য দিয়ে যে বিদ্যাসাগরকে সেই বালক কালে পাশে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তার অনুরণন ছিল আজীবন।

তরুণ বয়সে বিদ্যাসাগর

তরুণ বয়সে বিদ্যাসাগর

প্রবীর সরকার
শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:৩১
Share: Save:

তখন চলছিল ‘ঘরের পড়া’। বালক রবীন্দ্রনাথের জীবনে সেটা ছিল গড়ে ওঠার কাল। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে শিক্ষকেরা আসতেন নিয়ম করে এবং তার ব্যতিক্রম হত না বলে দুঃখ হত খুব। বৃষ্টির দিনেও দেখা যেত সমস্ত প্রত্যাশা ভঙ্গ করে “দৈবদুর্যোগে-অপরাহত সেই কালো ছাতাটি দেখা দিয়াছে।” এঁদেরই একজন রামসর্বস্ব পণ্ডিত যিনি একই সঙ্গে ছিলেন ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমী’ তথা মেট্রোপলিটান স্কুলের শিক্ষক এবং রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহশিক্ষক। তাঁর উৎসাহে তাঁরই সঙ্গে “ম্যাকবেথের” অনুবাদ শোনাতে বিদ্যাসাগরের কাছে গিয়েছিলেন বালক রবীন্দ্রনাথ, যার উল্লেখ রয়েছে ‘জীবনস্মৃতি’তে। এই স্কুলের সভাপতি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাই সেকালে লোকের মুখে এটি বিদ্যাসাগরের স্কুল নামেই পরিচিত ছিল।

‘জীবনস্মৃতি’র বর্ণনা অনুযায়ী, সে সাক্ষাৎকার খুব বেশি উৎসাহ ব্যঞ্জক হয়ে ওঠেনি। জীবনের সেই পর্বে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের “শিশুশিক্ষা-১” ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রথম ‘প্রাইমার’, পাশাপাশি, বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়-১ম ভাগও যে পাঠ করেছিলেন তার প্রমাণ রয়েছে নিজের লেখাতেই। “তখ্ন ‘কর’ ‘খল’ প্রভৃতি বানানের তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কূল পাইয়াছি। সেদিন পড়িতেছি ‘জল পড়ে’ ‘পাতা নড়ে’। আমার জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা।”

অবশ্য ঠিক এই কথাগুলি এই ভাবে বিদ্যাসাগর লেখেননি। তৃতীয় পাঠে ‘জল পড়ে’ কথাটি থাকলেও ‘পাতা নড়ে’ কোথাও লেখা নেই, বরং আছে ‘জল পড়িতেছে, পাতা নড়িতেছে’। বর্ণযোজনা শিখতে গিয়েই ‘বর্ণপরিচয়’ পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং পরিচিত হয়েছিলেন শব্দগুলির সঙ্গে। রবীন্দ্র গবেষক প্রশান্ত পালও জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ ‘জল পড়িতেছে, পাতা নড়িতেছে’- এটাই পড়েছিলেন, কিন্তু “ভাবী মহাকবির ‘সমস্ত চৈতন্য’ গদ্যের সেই সাদাসিধে রূপের অন্তরে নিহিত ছন্দটুকু আবিস্কার ক’রে গদ্যের ঘটমান বর্তমানকে কবিতার নিত্য বর্তমানে পরিণত করেছে।”

অনেক পরে লেখা একটি গানে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘তুমি আদিকবি, কবিগুরু তুমি হে...’। কে জানে, বিদ্যসাগরের কথাও মনে ছিল কি না!‎

হয়ত ব্যক্তি-বিদ্যাসাগর খুব একটা রম্য অনুভূতি গড়ে তুলতে পারেননি বালক রবীন্দ্রনাথের মনে। হতে পারে, বিদ্যাসাগরের এক জাতীয় গম্ভীর শিক্ষক-মূ্র্তি আগে থেকেই বাসা বেঁধেছিল বালক রবীন্দ্রনাথের মনে, যা স্কুল পালানো ছেলের কাছে প্রিয় হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু মানুষ বিদ্যাসাগর নন, সীতার বনবাস, শকুন্তলা, বেতাল পঞ্চবিংশতি, বোধোদয়— এইসব বইয়ের মধ্য দিয়ে যে বিদ্যাসাগরকে সেই বালক কালে পাশে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তার অনুরণন ছিল আজীবন। ঘরের পড়ার সেই যুগে অনেক কিছুই মনে হত অত্যাচার, কিন্তু তার পাশাপাশি মুগ্ধতাও জাগিয়ে রেখেছিলেন কেউ কেউ। তাঁদের সবার আগে ছিলেন বিদ্যসাগর। শিল্পীর কলমে লেখা বলে তাঁর বইগুলি কেবল বই হয়ে নয়, ছবি ও গান হয়ে ধরা পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধ চেতনায়।

তারপর সূদীর্ঘ কাল ধ’রে সেই মুগ্ধতা লুকিয়ে ছিল মনে গহনে। মাঝে মাঝে কিছু বিচ্ছিন্ন প্রকাশ দেখা গেলেও জীবনের অন্তিম সময়ে এসে চূড়ান্ত এবং স্পষ্ট ক’রে বিদ্যাসাগরের কাছেই আত্মসমর্পণ করলেন রবীন্দ্রনাথ। ৭৮ বছর বয়সে মেদিনীপুরে বিদ্যসাগর স্মৃতিমন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন করতে গিয়ে মুক্তকণ্ঠে বললেন, “বঙ্গসাহিত্যে আমার কৃতিত্ব দেশের লোকে যদি স্বীকার করে থাকেন, তবে আমি যেন স্বীকার করি, একদা তার দ্বার উদঘাটন করেছেন বিদ্যাসাগর।”

না, বিহারীলাল নন, বঙ্কিমচন্দ্র নন, মধুসূদন তো একেবারেই নন, শেষ পর্যন্ত বিদ্যাসাগরকেই গুরুর ভূমিকায় বরণ ক’রে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ কোনও সাময়িক আবেগের তাৎক্ষণিক প্রকাশ নয়। একটু সন্ধান করলেই দেখব, এর মধ্যেও রয়েছে ধারাবাহিকতা। রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাসাগর-মূল্যায়ণে সবচেয়ে চেনা কথাগুলির প্রথমেই আছে বাংলা গদ্যের স্থপতিকে স্মরণ “তাঁহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা।... তিনিই প্রথম বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন।... বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা দান করিয়াছেন। .. তাঁর শিল্পীজনোচিত বেদনাবোধ ছিল।”

শিল্পীমনের এই যোগসূত্রটি স্মরণ করে কবিতাও লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ: “ভাষার প্রাঙ্গণে তব আমি কবি তোমারি অতিথি

ভারতীর পূজা তরে চয়ন করেছি আমি গীতি

সেই তরুতল হতে যা তোমার প্রসদা সিঞ্চনে

মরুর পাষাণ ভেদি প্রকাশ পেয়েছে শুভক্ষণে।” (২৪ ভাদ্র ১৩৪৫)

বিদ্যাসাগর রচনাবলির প্রথম খণ্ডটি রবীন্দ্রনাথের হাতে আসে কালিম্পং প্রবাসে, মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে (১৯৩৯)। খুশি হয়ে একটি চিঠি লিখেছিখেন মেদিনীপুরের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিনয়রঞ্জনকে, “বিদ্যাসাগরের বেদীমূলে নিবেদন করার উপযুক্ত এই অর্ঘ্য রচনা।”

জীবনের শেষ পর্বে এসে একটি আত্মজীবনী রচনায় হাত দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর, নাম “আত্মজীবনচরিত”। কিন্তু শেষ ক’রে যেতে পারেননি। মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ আত্মজীবনীর আদর্শ বলে গ্রহণ করেছিলেন এই অসম্পূর্ণ রচনাটিকেই, এমনকি নিজের আত্মজীবনীর (জীবনস্মৃতি) ভূমিকায় সাহিত্যের এই মাধ্যমটি সম্পর্কে একদা যে মতপ্রকাশ করেছেন, সেই ধারণাটিকেই বদলে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন বিদ্যাসাগরের আত্মজীবনী পাঠ করে!

সত্যি, আগে কখনও মনে হয়নি, বিদ্যাসাগরের ছায়া এতটা দীর্ঘ ছিল রবীন্দ্রনাথের উপরে!

লেখক নিস্তারিণী কলেজের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Ishwar Chandra Vidyasagar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE