Advertisement
০৪ মে ২০২৪
ঘায়েল হল কত, শুনি...

এক ‘যুদ্ধ’ জিততেই কি অন্য যুদ্ধের আশ্রয় খোঁজা?

প্রচারে সবচেয়ে আগে যে বিষয়টি ভাবনায় আসে, তা হল ভোটের আবহ। অর্থাৎ কোন পরিস্থিতিতে ভোট হচ্ছে। যেমন গোটা দেশে, তেমনই রাজ্যেও। তবে নির্বাচন যে হেতু লোকসভার, তাই জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপট অবশ্যই সেখানে প্রাধান্য পায়।

ক্ষতি: ভারতীয় বায়ুসেনার বিমানহানার পর বালাকোটবাসী এক তরুণ ধ্বস্ত অঞ্চলের দিকে নির্দেশ করছেন, জাবা গ্রাম, ১ মার্চ। রয়টার্স

ক্ষতি: ভারতীয় বায়ুসেনার বিমানহানার পর বালাকোটবাসী এক তরুণ ধ্বস্ত অঞ্চলের দিকে নির্দেশ করছেন, জাবা গ্রাম, ১ মার্চ। রয়টার্স

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

ভোটের দিন ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। প্রার্থী তালিকাও বেরোচ্ছে। এ বার আসল লড়াই শুরু। কোন দল কাকে কোথায় প্রার্থী করল, কাকে বাদ দেওয়া হল— ভোটের বাজারে এ সব খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এগুলির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বিভিন্ন দলের নিজস্ব রাজনৈতিক ভাবনাচিন্তা, ভোট আদায়ের হিসাব-নিকাশের মতো বিবিধ বিষয়। তালিকা সামনে এলে সাধারণ মানুষ এবং দলীয় কর্মীদের মধ্যে যেমন একটি প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, তেমনই এক দলের প্রার্থীদের দেখে প্রতিপক্ষও নিজেদের কৌশল স্থির করে। তাই প্রার্থী-তালিকা হল ভোট-যুদ্ধের প্রথম রাউন্ড। সবার আগে তালিকা বার করে তৃণমূল এ বারেও সেই রাউন্ডে এগিয়ে রইল। অন্তত প্রার্থীদের নিয়ে প্রচার করার কাজটি তারা এখনই শুরু করে দিতে পারবে।

প্রচারে সবচেয়ে আগে যে বিষয়টি ভাবনায় আসে, তা হল ভোটের আবহ। অর্থাৎ কোন পরিস্থিতিতে ভোট হচ্ছে। যেমন গোটা দেশে, তেমনই রাজ্যেও। তবে নির্বাচন যে হেতু লোকসভার, তাই জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপট অবশ্যই সেখানে প্রাধান্য পায়।

এই মুহূর্তে সেই ছবিটি কেমন?

সন্দেহ নেই, পুলওয়ামা-বিস্ফোরণের ধাক্কা এবং তার পরেই পাকিস্তানের সীমানায় ঢুকে ভারতের ‘যোগ্য’ জবাব দেশের প্রাক-নির্বাচনী আবহে অকস্মাৎ খানিকটা বদল ঘটিয়ে দিতে পেরেছে। এই ঘটনার আগে পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ নানা অভাব-অনিয়ম-অবিচার-দুর্নীতির অভিযোগ নরেন্দ্র মোদীকে জেরবার করে তুলেছিল। কৃষকদের বিক্ষোভ, জাতপাত, ধর্ম সম্প্রদায় নিয়ে রক্তাক্ত রাজনীতি থেকে শুরু করে রাফাল নথি ফাঁস পর্যন্ত একের পর এক ঘটনা সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল। সর্বোপরি বিরোধীদের জোট গঠনের উদ্যোগে মোদী প্রমাদ গুনেছিলেন।

সেই অবস্থায় পুলওয়ামার মর্মান্তিক ঘটনা কেন্দ্র করে ‘দেশপ্রেম’ রাজনীতির মূল স্রোতকে দ্রুত অন্য খাতে বইয়ে দেয়। তার পরেই শত্রুরাষ্ট্রে ঢুকে ভারত যে ভাবে ‘বদলা’ নিয়েছে, সেই কথা ফলাও প্রচার করে সরকার এবং শাসক দল বিজেপি আরও বেশি করে দেশবাসীর মনের আবেগ এবং আগুন দু’টিকেই আরও উস্কে দেয়। তার কিছু রেশ ভোটের বাজারে থাকবে না, বললে হয়তো সত্যের অপলাপ হবে। বিরোধীরাও এটা বিলক্ষণ বোঝেন।

কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ততই বোমা-বারুদের ঘন ধোঁয়ায় কিছু মৌলিক প্রশ্ন কেমন যেন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। অথবা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। আর তার ফলে তৈরি হচ্ছে রহস্য। বাড়ছে সন্দেহ। যা রটে, তার কতটা বাস্তব— সেই দোলাচল কিছুতেই যেন কাটছে না। ভোট-বাজারে শাসক দলের পক্ষে তাই বহু প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না।

পাক-সীমান্ত পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে আমাদের বিমানবাহিনীর বীর যোদ্ধারা যে অভিযান চালালেন, তার জন্য তাঁদের শত-সহস্র কুর্নিশ প্রাপ্য। একা বিমান নিয়ে গিয়ে আমাদের বায়ুসেনার উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান পাকিস্তানের হাতে ধরা পড়ায় আমরা রুদ্ধশ্বাস উদ্বেগ ভোগ করেছি। তার পরে গোটা দেশ তাঁর মুক্তির অপেক্ষায় প্রহর গুনেছে। তিনি ফিরে এসেছেন সমগ্র দেশবাসীর অভিনন্দনের মুকুট মাথায় পরে।

দেশের সেনানীরা আমাদের গর্ব। আমাদের রক্ষাকর্তা। আমাদের নিশ্চিন্ত জীবনযাপনের অন্যতম অবলম্বন তাঁরা। রাজনীতির ঘোলা জলে মাছ ধরার কাজ তাঁদের নয়। কিন্তু তাঁদের কাজ নিয়ে যখন রহস্যের রাজনীতি চলে, তাঁদের কৃতিত্বের সব কথা মানুষ জানতে পারেন না, জানতে দেওয়া হয় না, তখন মনে হয় কোথাও বোধ হয় কিছু ‘লুকোনো’র আছে! আর যাঁরা এ সব করেন, তাঁদের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন জাগে।

ভোটের প্রচারে এই সব প্রসঙ্গ ওঠার সম্ভাবনা ষোলো আনা। আমাদের বাহিনী জঙ্গি-দমনে কী কী করল, কত সন্ত্রাসবাদী ঘায়েল হল, কোথায় কত ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হল কেন তা স্বচ্ছ ভাবে জানানো হচ্ছে না, কেন কেন্দ্রের সরকার ও শাসক দলের এক এক জনের মুখে এক এক রকম কথা ও পরিসংখ্যান শোনা যাচ্ছে, নির্বাচনী প্রচারের ময়দানে সেই প্রশ্ন তোলা হলে শুধু দেশভক্তির কথা বলে তা এড়িয়ে যাওয়া কত দূর সম্ভব এবং সঙ্গত হবে? এ বার বোধ হয় তারও একটি পরীক্ষা।

একই রকম প্রশ্নের সুযোগ করে দিয়েছে রাফাল নথি ফাঁস-কাণ্ড। সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ঘেরাটোপ থেকে এমন নথি যদি ‘চুরি’ হয়, বা বাইরে চলে যায়, তা হলে চোরের চেয়ে বড় দোষী তো চৌকিদার! ওই নথি থেকে রাফাল বিমান কেনা নিয়ে যে ‘তথ্য’ বেরিয়ে এসেছে, তার কথা না-হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু নথি যে ‘সুরক্ষিত’ রাখা যায়নি, এটা পরিষ্কার। প্রচার তাই রাফালকেও ছাড়বে না, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তবে প্রচারের সব ঘি-মাখন একা বিরোধীরা খাবে, সেটাও তো হওয়ার নয়। কোনও লড়াই একতরফা হয় না। জাতীয় ক্ষেত্রের পাশাপাশি রাজ্যস্তরে বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধে বলার কথা বিজেপির অবশ্যই আছে। এই রাজ্যেও তারা যদি পঞ্চায়েত নির্বাচনে সন্ত্রাসের অভিযোগ সামনে আনে, অনুব্রত মণ্ডলের ‘পাঁচন দাওয়াই, নকুল দানা’র আগাম হুমকি, বিভিন্ন আর্থিক কেলেঙ্কারি ইত্যাদির কথা তুলে রাজ্যের শাসক দলকে বিদ্ধ করে, তৃণমূলকে তার মোকাবিলা করতেই হবে। তবে এ ক্ষেত্রে যেটা আরও অর্থবহ তা হল, এই সব অভিযোগের বেলায় একা বিজেপি নয়, একসুর কংগ্রেস এবং সিপিএমেরও। ফলে ভোটের মাঠে ত্রিমুখী আক্রমণ সামলাতে হবে রাজ্যের শাসক দলকে। এর আগেও অবশ্য এই তিনের বিরুদ্ধে একা লড়ে তৃণমূল তার আধিপত্য বজায় রেখেছে। আরও এক বার সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি তারা। কী হবে, তা ভবিষ্যতের গর্ভে।

তবে হ্যাঁ, রাজ্যে ৪২টি কেন্দ্রের জন্য সাত দফার ভোট, মাসখানেক আগে থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানো ইত্যাদি থেকে বোঝা যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যের প্রতি এ বার ‘বিশেষ নজর’ দেওয়া হয়েছে। এর পিছনে রাজনীতি আছে কি না, সেটা বিতর্কের বিষয়। সেই বিতর্ক হচ্ছেও।

আসলে আঞ্চলিক দলগুলির উত্থানের প্রবণতা এ বারের নির্বাচনী প্রেক্ষাপটকে অনেকটাই অন্য চেহারা দিয়ে ফেলেছে। বিজেপি-বিরোধী জোট গড়ে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দেওয়ার জন্য প্রথম উদ্যোগী হয়েছিলেন মমতাই। বিভিন্ন রাজ্যে প্রধান আঞ্চলিক দলগুলিকে নিজ নিজ রাজ্যে মুখ্য ভূমিকায় আনতেও তৎপর হন তিনি। ব্রিগেড সমাবেশ তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কাজ অনেকটা এগিয়ে কয়েক দিন আগে দিল্লিতে ভোটের আগে জোট গড়ার নীতিগত সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেছে কংগ্রেস-সহ সব বিরোধী দল।

তবু বলতেই হবে, জোটের জমাট চেহারাটি এখনও সে ভাবে দেখা যাচ্ছে না। বরং পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ সমেত বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপি-বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলির লড়াই হতে চলেছে। এই রাজ্যে কংগ্রেস এখন খুব শক্তিশালী না হলেও অন্যত্র কিছু রাজ্যে এর পরিণাম কী হবে, তা বলা কঠিন।

তবে পরিণাম যা-ই হোক, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ুর মতো কয়েকটি বড় রাজ্যে বিজেপি-বিরোধী প্রধান শক্তি হিসাবে আঞ্চলিক দলগুলি যে এগিয়ে রয়েছে, সেটা আজ অস্বীকার করার উপায় নেই। ভোট পরবর্তী পরিস্থিতিতে হয়তো এটা আরও অর্থবহ মাত্রা নিতে পারে। সে কথা মাথায় রেখেই মমতা-মায়াবতী-অখিলেশদের কাছে এ বারের নির্বাচন যতটা গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ, বিজেপির কাছে তাঁদের আটকানোর চ্যালেঞ্জটা তার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।

কে না জানে, যুদ্ধে (এবং প্রেমে!) কিছুই ‘অনৈতিক’ নয়। ভোট তো যুদ্ধই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE