Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সহজ রাস্তা নেই, পরিবেশের জন্য চাই দীর্ঘমেয়াদি যৌথ উদ্যোগ

সর্বনাশের পথেই কি চলব

ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-এর বিশেষ প্রতিবেদন। আইপিসিসি-র বিজ্ঞানীদের মতে আগামী দিনে বিশ্বের তাপমাত্রা-বৃদ্ধি প্রাকশিল্পায়ন যুগের তুলনায় ২ ডিগ্রির পরিবর্তে ১.৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখা না হলে ঘোর বিপদে পড়বে মানুষ।

শৌভনিক রায়
শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

পোল্যান্ডের কাটওয়াইশ শহরে শেষ হল ২৪তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির মূল প্রতিপাদ্য ছিল বিভিন্ন দেশের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ প্রশমনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ। সঙ্গে ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলির জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সমস্যার নিরসনে উন্নত দেশগুলির বার্ষিক ১০০০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি। প্যারিস চুক্তি রূপায়ণের নিয়মাবলি প্রণয়ন ও আর্থিক সংস্থানের বিষয়টি পাকা করাই ছিল এ বারের সম্মেলনের মূল লক্ষ্য।

ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-এর বিশেষ প্রতিবেদন। আইপিসিসি-র বিজ্ঞানীদের মতে আগামী দিনে বিশ্বের তাপমাত্রা-বৃদ্ধি প্রাকশিল্পায়ন যুগের তুলনায় ২ ডিগ্রির পরিবর্তে ১.৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখা না হলে ঘোর বিপদে পড়বে মানুষ। বিজ্ঞানীদের মতে, তাপমাত্রা-বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন ডাইঅক্সাইড-সহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ ২০১০-এর অর্ধেক এবং ২০৫০ সালে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। এর অর্থ বনাঞ্চল সৃষ্টির মাধ্যমে ও প্রযুক্তির সাহায্যে ২০৫০ সালে পৃথিবীতে গ্রিনহাউস গ্যাসের উৎপাদন ও অপসারণের সমতা আনতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যা আকাশকুসুম।

রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ কর্মসূচির ২০১৮’র সমীক্ষা জানায়, গ্রিনহাউস গ্যাসের উৎপাদন বিগত বছরগুলির তুলনায় ফের ঊর্ধ্বমুখী। গত দেড়শো বছরে ক্রমোন্নত জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে সিংহভাগ গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদন হয়েছে শিল্পোন্নত দেশগুলিতে। ১৯৯৭ সালের কিয়োটো চুক্তি (যা বলবৎ থাকবে ২০২০ পর্যন্ত, তার পর কার্যকর হবে প্যারিস চুক্তি) অনুসারে এই দেশগুলির বর্ধিত দায়িত্ব আছে ২০২০ সালের মধ্যে এই ক্ষতিপূরণের। কথা ছিল, সুনির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাস উৎপাদন কমিয়ে আনবে তারা। বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে কিয়োটো চুক্তিও মানেনি আমেরিকা। অন্য অনেক শিল্পোন্নত দেশও সফল হয়নি উৎপাদন হ্রাসের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা পূরণে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিগত বছরের তুলনায় চিন ও ভারতের নিঃসরণও বেড়েছে উদ্বেগজনক।

কাটওয়াইশ সম্মেলনে প্রবল বিতর্ক হয়েছে আইপিসিসি-র বিশেষ প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে। তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখার সুপারিশের তীব্র বিরোধিতা করেছে আমেরিকা, রাশিয়া, এবং সৌদি আরব ও কুয়েতের মতো তৈলভাণ্ডার সমৃদ্ধ দেশ। জীবাশ্মজ্বালানি-নির্ভর বিকাশের পথ থেকে সরে না আসার ‘যুক্তি’ দিতে তারা নস্যাৎ করতে চেয়েছে প্রতিবেদনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তিটিকেই। তুমুল প্রতিক্রিয়া হয়েছে উপস্থিত বিজ্ঞানী ও পরিবেশকর্মীদের মধ্যে। চিরাচরিত তর্ক হয়েছে গ্রিনহাউস গ্যাস প্রশমনে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে সমতা ও পৃথক দায়িত্বের বিষয় নিয়ে। গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদনে উন্নত দেশগুলির বর্ধিত দায়িত্বের প্রশ্ন অনেকটা পিছনে চলে গিয়েছে। ঘটনা হল, ঐতিহাসিক ভাবে কার্বন পরিসরের ৭৫ শতাংশ আছে পশ্চিমি দেশগুলির অধিকারে। উন্নয়নের চলতি ধারা ও গ্যাস উৎপাদনের প্রবণতা বজায় থাকলে বৈষম্য আরও বাড়বে। তীব্র সঙ্কটে পড়বে উন্নয়নশীল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জ্বালানি সুরক্ষা, জীবন-মান। আন্তর্জাতিক মঞ্চের দাবি: এই দেশগুলিকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে যাতে তারা গ্যাস প্রশমনে কার্যকর ব্যবস্থা করতে পারে। ভারত ও অন্য কিছু দেশের বক্তব্য, গত তিন বছরে উন্নত দেশগুলি থেকে প্যারিস চুক্তির প্রতিশ্রুতি মতো আর্থিক সহায়তা মেলেনি।

বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহমত ও সহযোগিতার বাতাবরণ তৈরি না হলে উষ্ণায়নের বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া দুষ্কর। তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখতে হলে দুনিয়ার মোট আয়ের ২.৫ শতাংশ বিনিয়োগ জরুরি। ২০১৭ সালে বিশ্বে সামরিক ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ২.২ শতাংশ। প্রশ্নটা অগ্রাধিকারের। নিম্ন আয়ের মানুষের জ্বালানি সুরক্ষা এবং উষ্ণায়নের দ্বন্দ্বের নিরসন না হলে সামাজিক অসন্তোষ অবশ্যম্ভাবী। অনেকগুলি উদাহরণ রয়েছে আমাদের সামনে। কিন্তু উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কেরা কি একমত হবেন? লক্ষণীয়, ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবনে ৮০ লক্ষ মানুষ উষ্ণায়নের ফলে চরম বিপদের সম্মুখীন হলেও আন্তর্জাতিক স্তরে এখনও কোনও দূরপ্রসারী পরিকল্পনা করা হয়নি।

বিপদের মোকাবিলায় ভারতের ভূমিকা কী? উল্লেখ্য, সর্বাধিক কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপাদনকারী ২০টি দেশের মধ্যে ভারত তৃতীয়, অথচ মাথাপিছু উৎপাদনে সে সবার শেষে। আমাদের সমস্যা দ্বিমুখী। তৃতীয় বৃহৎ অংশীদার হওয়ায় সামগ্রিক ভাবে গ্যাস নিঃসরণ কমানোর দায় আছে। অন্য দিকে দেশে মাথাপিছু জ্বালানি ও বিদ্যুতের ব্যবহার সর্বনিম্ন। উন্নত বিশ্বের সব দেশ তো বটেই এমনকী ব্রাজ়িল, ইন্দোনেশিয়ারও পিছনে। হিসাব মতো ২০৩০-এর পরে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা এবং গ্যাসের উৎপাদন সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছবে। এখনই উষ্ণায়নজনিত ক্ষতির পরিমাণ

জিডিপি-র ১.৫ শতাংশ। কৃষিক্ষেত্রে প্রতি বছর গড়ে সাত শতাংশ হারে উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং তাপপ্রবাহের কারণে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে। তাপমাত্রা আরও বাড়লে বাসযোগ্যতা হারাতে পারে দেশের অনেক উপকূল, পাহাড়ি ও কৃষি অঞ্চল। পূর্বাভাস আছে, সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাস্তুচ্যুত হতে পারেন সুন্দরবনের বিপদসঙ্কুল অঞ্চলের প্রায় ৩ লক্ষ পরিবার।

২০০৮ সালে ঘোষণা হয়েছিল জাতীয় পরিকল্পনা ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান অন ক্লাইমেট চেঞ্জ। এর পর বিভিন্ন রাজ্য তৈরি করেছে তাদের পরিকল্পনা। খামতি রয়েছে বিস্তর। পরিকল্পনার কার্যকারিতা যাচাইয়ের নেই কোনও নির্দিষ্ট মানদণ্ড। জাতীয় পরিকল্পনায় আটটি মিশনের প্রস্তাব ছিল। এর মধ্যে দু’টি— ন্যাশনাল মিশন ফর সাস্টেনেব্‌ল হিমালয়ান ইকোসিস্টেম ও ন্যাশনাল মিশন অন সাস্টেনেব্‌ল হ্যাবিটাট। জীববৈচিত্র ও উষ্ণায়নের কেন্দ্রবিন্দু হিমালয় পার্বত্যঞ্চল নিয়ে অনেকগুলি গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্প সরকার অনুমোদন করে হিমালয়ান ইকোসিস্টেম মিশনে। দার্জিলিঙে এই রকম এক প্রকল্পে জড়িত থাকার অভিজ্ঞতা হল, অনেকগুলি গবেষণাপত্র প্রকাশ হলেও সুপারিশগুলি সরকারি নীতি পরিবর্তনে বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। জানা গিয়েছে সব প্রকল্পেই এক অবস্থা। নীতিবৈকল্য ও প্রশাসনিক অদূরদর্শিতা। দ্বিতীয় মিশনটিও গুরুত্বপূর্ণ। ৭০ শতাংশ কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপাদন হয় শহরগুলিতে— পরিবহণ, বাড়ি নির্মাণ, বিদ্যুৎ পরিষেবা ইত্যাদির জন্য। অথচ এই মিশনে অর্থসংস্থান নেই। বাকি ছ’টি মিশনেরও অগ্রগতি ব্যাহত পরিকল্পনা, অর্থ ও মানবসম্পদের অভাবে। রাজ্য পরিকল্পনাগুলির অবস্থা আরও সঙ্গিন। উত্তরাখণ্ড ও কেরল সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের পরে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা তৈরির কাজ শুরু করেছে। ভারতের মতো দেশে উষ্ণায়ন মোকাবিলার বহুমাত্রিক ও সমন্বিত পরিকল্পনার জন্য প্রশাসনিক সদিচ্ছা অত্যাবশ্যক।

শেষে একটি কথা বলব। বর্তমানে দেশে কৃষিঋণ মকুব নিয়ে বোধ হয় কিছুটা সহমত তৈরি হয়েছে। এই মুহূর্তে কৃষকরা যে বিপদের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, তাতে ঋণ মকুব হয়তো জরুরি। কিন্তু কৃষি সমস্যার অন্যতম উৎস জলবায়ুর খামখেয়ালিপনা ও পরিবর্তন। জাতীয় ও বিভিন্ন রাজ্যের পরিকল্পনায় এখনও প্রধান গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সেচের উপর। বাড়তি নজর দেওয়া প্রয়োজন শস্যবৈচিত্র, বৃষ্টিনির্ভর কৃষি ও সুসংহত জলবিভাজিকা প্রকল্পের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দিকে। এতে জলের সাশ্রয় হবে। তৈরি হবে স্থানীয় সম্পদের ভিত্তিতে সুস্থায়ী উন্নয়নের নকশা, যা হতে পারে উষ্ণায়নের বিপদ মোকাবিলায় হাতিয়ার।

আইআইইএসটি (শিবপুর)-এর অধ্যাপক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Environment Earth Pollution Planning
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE