—ফাইল চিত্র।
উনবিংশ শতাব্দীর সেই সময় এক দিকে সামন্ততান্ত্রিক-চিন্তা, জড়তা কুুসংস্কার, কূপমণ্ডুকতার ঘন অন্ধকার; অন্য দিকে, পশ্চিমের গবাক্ষপথে আগত নতুন চিন্তার আলোর ঝলক। পুরাতন সংস্কারকে যুক্তির কশাঘাতে ছিঁড়ে ফেলছিল ডিরোজিওর ‘ইয়ংবেঙ্গল সোসাইটি’। ডিরোজিওর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আধুনিক শিক্ষার আলোকবর্তিকা নিয়ে মুর্শিদাবাদের নিজামত কলেজে (বর্তমান নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশন) ইংরেজির শিক্ষক (১৮৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দ) এবং পরবর্তীতে ১৮৩৭ সালের শেষ দিকে রাজা কৃষ্ণনাথের গৃহশিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন হিন্দু কলেজের ছাত্র দিগম্বর মিত্র।
মরা গাঙে জোয়ারের মতো আধুনিকতার স্পর্শে উজ্জীবিত হন রাজা কৃষ্ণনাথ। সমাজকে উদ্ভাসিত করার মাধ্যম হিসাবে তিনি বেছে নিলেন মফস্সল জেলায় সংবাদপত্র প্রকাশের মতো এক যুগান্তকারী অভিনব পন্থা। তখন কৃষ্ণনাথের বয়স মাত্র ১৬ বছর ৬ মাস।
যখন ভারতীয় সংবাদপত্রের শৈশবস্থা, সেই সময় মুর্শিদাবাদ জেলার কাশিমবাজার থেকে ১৮৩৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হল ইংরেজি ভাষার সংবাদপত্র ‘Murshidabad News’। এটি অবিভক্ত বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষের মফস্সল এলাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম ইংরেজি সংবাদপত্র। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন উইলিয়াম স্টিফেন ল্যামব্রিক। তিনি ছিলেন কৃষ্ণনাথের সরকার নিযুক্ত অবিভাবক। কৃষ্ণনাথ তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ল্যামব্রিককে ৩০,০০০ টাকা প্রদান করেন এবং একটি ছাপাখানা চালানোর গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন। কৃষ্ণনাথের আগ্রহে, উৎসাহে ও অর্থানুকুল্যে সেই ছাপাখানা থেকে ‘Murshidabad News’ নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় নির্ভীক ভাবে শাসকের সমালোচনা করা হত। ফলস্বরূপ মাত্র ১১ মাস পরে ১৮৩৯ সালের জুলাই পর্যন্ত চালিয়ে পত্রিকাটিকে বন্ধ করে দিতে হয়। কারণ, প্রকাশের পূর্বে সরকারকে নোটিস দেওয়া হয়নি। ফলে কোম্পানির সরকারের আমলারা রেগে সেই কাগজ এবং প্রেসটি বন্ধ করে দেন। শুধু তাই নয় ওই সংবাদপত্রের মুদ্রাকরকে ১৯ জুলাই কোনও কারণ না দেখিয়ে গ্রেফতার করে ২০ জুলাই প্রেসে তালা দিয়ে দেওয়া হয় এবং ১৫ অগস্ট মুদ্রাকরের কারাদণ্ড ও ৫০০ টাকা জরিমানা হয়। বন্ধ করার কয়েক মাস আগে আবার সরকারের অনুমতি নিয়ে সেটি প্রকাশ করার চেষ্টা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি।
এই ঘটনার দশ মাস পরে রাজা কৃষ্ণনাথের ঐকান্তিক আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৪০ সালের ১০ মে গুরুদয়াল চৌধুরীর সম্পাদনায় মুর্শিদাবাদ থেকেই প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষার সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘মুর্শিদাবাদ সম্বাদপত্রী’। এটাও বৃহৎবঙ্গে কলকাতার বাইরে মফস্সল থেকে বাঙালির দ্বারা প্রকাশিত প্রথম মুদ্রিত বাংলা সংবাদপত্র।
এর প্রকাশ সম্পর্কে 'Calcutta Monthly Journal' এর প্রতিবেদনে বলা হয়— ‘Moorshedabad sumbad puttree- A weekly newspaper in the Bengally language and Character, under the above title, made its appearance on the 10th of may, in Moorshedabad. It's opinions are liberal and clothed in pure Bengally.’
এই সংবাদপত্রের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার চার দিন পরে ১৪ মে কলকাতা থেকে G.H.Huttmann কর্তৃক প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক ‘Calcutta courier’ পত্রিকার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ‘Indian News’ শিরোনামে লেখা হয়— ‘A new Bengally news paper-The first number of new Bengally paper, called the ‘Moorshedabad sungbadputri’ has just made it appearance. It is we believe, published under the auspices of KOWER KISSENNAUTH ROY of Moorshidabad .’
মাত্র এক বছর এই সংবাদপত্রটি চলার পরে তার নির্ভীক ও নিরপেক্ষ মতামতের জন্য কোম্পানির আমলাদের অসহযোগিতা ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কোপে এর প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। তখন কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন পিয়ার্স টেলর এবং মি. হ্যারি এলিয়ট। প্রকাশ রহিত সম্পর্কে ১৮৪১ সালের ১০ এপ্রিল সংখ্যায় ‘সম্বাদ ভাষ্কর’ পত্রিকায় ৬১০ পৃষ্ঠায় ‘সংবাদমুক্তাবলী’ শিরোনামে লেখা হয়— ‘কলিকাতা নগরে সমাচারপত্র অনেক হইয়াছে, পল্লিগ্রামে অধিক হয় নাই, রাজা কৃষ্ণনাথ বাহাদুর সর্ব্বাগ্রে স্বকীয় রাজধানীতে ‘মুর্শিদাবাদ সম্বাদপত্রী’ নামে এক সংবাদপত্র করিয়াছিলেন, মুর্শিদাবাদের ম্যাজিস্ট্রেটের কোপে উক্ত রাজা বাহাদুরের বর্ত্তমানেই তাহার প্রাণ বিয়োগ হয় ...।’
রাজা কৃষ্ণনাথ ছিলেন প্রগতিশীল, স্বাধীনচেতা কিন্তু একটু ভাবপ্রবণ। তিনি বিনয়ের অবতার হতে পারেননি। সে জন্য তিনি দেশি-বিদেশি আমলাদের অনুগ্রহভাজন হতে পারেননি। ফলে ‘মুর্শিদাবাদ সম্বাদপত্রী’ পুনঃপ্রকাশের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া রাজা কৃষ্ণনাথের সঙ্গে তৎকালীন কালেক্টর মি. পিয়ার্স টেলরের সম্পর্ক ও সুমধুর ছিল না। ১৮৩৭ সালে Pierce Taylor কৃষ্ণনাথ সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন ‘... an idiot or else the most obstinate young man of rank that ever drove a tutor to despair...’। কিন্তু সত্যিই কি তাই! তা হলে ছাত্র কৃষ্ণনাথ শিক্ষাগুরু ল্যামব্রিককে কেনই বা পত্রিকা সম্পাদনার গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন? ল্যামব্রিকও জনশিক্ষা কমিটির নিকট তাঁর ছাত্রের শিক্ষায় অগ্রগতি সংক্রান্ত প্রতিবেদনে সামগ্রিক সন্তুষ্টির কথা উল্লেখ করেন। আসলে রাজা কৃষ্ণনাথের পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত সংবাদপত্র দু’টিতে ইংরেজ শাসন কালের এমন কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা পরিবেশিত হত যা শাসকের মনে ভীতির সঞ্চার করে। গবেষকদের অনুমান, কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোনোর ভয়েই সংবাদপত্র দু’টির অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। তবে উনিশ শতকের সমাজ-শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চায় মফস্সল জেলার প্রথম দুই পথ-ফলক এ কালেও দৃষ্টান্ত বহন করে চলেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy