Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

জরুরি অবস্থা

সরকারি কর্তারা প্রজ্ঞাবান। তাঁহারা জানেন, নূতন আঘাতের বেদনায় পুরাতন ব্যথা বিস্মৃত হইবে। কিন্তু মৃতপ্রায় মানুষের অপমান ভুলিতে পারেন না রাজ্যবাসী। জুনিয়র ডাক্তারদের উপর যে রোষ আছড়াইয়া পড়ে, তাহা বস্তুত বিবেকহীন, অপরিণামদর্শী, রাজনৈতিক পোষণদুষ্ট এক অমানবিক ব্যবস্থার প্রতি রাজ্যবাসীর ক্ষোভ।

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

সরকারি হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে যাহা ঘটিতেছে, তাহাতে রক্ত হিম হইতে বাধ্য। গাড়ি দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত তরুণকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ পাঠাইল বেসরকারি হাসপাতালে। যুক্তি, ‘পরিকাঠামো নাই।’ ইমার্জেন্সি বিভাগ হইতে বক্ষ বিভাগ, সেখান হইতে ফের ইমার্জেন্সিতে ফিরিবার পথে এক রোগীর মৃত্যু হইল মেডিক্যাল কলেজে। বাইক দুর্ঘটনায় আহত উত্তরবঙ্গের যুবক কলিকাতার চারটি মেডিক্যাল কলেজ ঘুরিয়া স্থান পাইলেন একটিতে। ইহাই কি আপৎকালীন পরিষেবা? মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারদের সহিত মৃতের আত্মীয়দের হাতাহাতি হইয়াছে। চিকিৎসকদের উপর আক্রমণ নিন্দনীয়। কিন্তু যন্ত্রণাকাতর রোগী চিকিৎসার অপেক্ষা করিতে করিতে মারা গেলে আত্মীয়দের ক্ষোভ উৎপন্ন হইবে, তাহা আশ্চর্য নহে। আশ্চর্য বরং ইহাই যে, যে-সকল সমস্যা অতি পুরাতন, অতি পরিচিত, যাহার সমাধানের সূচনা একাধিক বার ঘোষিত হইয়াছে, আজও তাহার সম্মুখীন হইতে হয় রাজ্যবাসীকে। যেমন এক হাসপাতাল হইতে অন্য হাসপাতালে রোগীকে ‘রেফার’ করিবার প্রবণতা। মেডিক্যাল কলেজ চিকিৎসাব্যবস্থার শীর্ষে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলিতে সকল ব্যবস্থা মিলিবে না কেন? কেন অন্যত্র পাঠাইতে হইবে রোগীকে? এখনই চিকিৎসা না করিলে বাঁচিবার আশা সামান্য, জানিয়াও মেডিক্যাল কলেজগুলি রোগীকে অন্যত্র রেফার করিতেছে। ইহা চিকিৎসকদের দক্ষতার অভাব, অথবা দায় এড়াইবার ইচ্ছা, না কি বাস্তবিকই মেডিক্যাল কলেজগুলিতে প্রত্যাশিত ব্যবস্থা নাই, তাহা কে বলিবে?

রেফার করিবার বিধির সূচনা হইয়াছিল বাম আমলেই। তাহা হইল, কোন হাসপাতালে জায়গা মিলিবে, তাহা জানিবার আগাম ব্যবস্থা, এবং সেই অনুসারে রোগী রেফার করিবার নিয়ম। আজও তাহা কার্যকর হয় নাই। ফলে রক্তবমনরত রোগীকে চারটি মেডিক্যাল কলেজ হইতে প্রত্যাখ্যাত হইতে হইল। কিন্তু যাহা সর্বাধিক অমানবিক, তাহা হাসপাতালের অভ্যন্তরে এক বিভাগ হইতে অপর বিভাগে রোগীকে পাঠাইবার অব্যবস্থা। যেগুলি জরুরি প্রয়োজন, সেই সকল পরীক্ষা কেন ইমার্জেন্সি বিভাগেই হইবে না? কেন আপৎকালীন প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সেই ভবনেই আসিবেন না? সর্বোপরি, অপর ভবনে রোগীকে লইয়া যদি যাইতেই হয়, সেই দায় কেন রোগীর আত্মীয়দের উপর চাপানো হইবে? খাতায়-কলমে ট্রলি এবং তাহার বাহক থাকিলেও কাজের বেলা যে দুইটিই প্রায়ই অনুপস্থিত, তাহা কি কর্তৃপক্ষের চোখে পড়ে না? রোগীর আত্মীয়েরা শোরগোল বাধাইলে তবে কি তাঁহাদের টনক নড়ে? এই সব সমস্যার কারণ অর্থাভাব নহে। কারণ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাব, কর্মীদের শাসন করিবার সাহসের অভাব।

অভাব দায়বদ্ধতারও। এমন অব্যবস্থা দীর্ঘ দিন চলিবার প্রধান কারণ, সহজে দায় এড়াইতে পারে মেডিক্যাল কলেজ। বারংবার তদন্তের শূন্য আশ্বাস দিয়া অচিকিৎসিত রোগীমৃত্যু ধামাচাপা দিয়াছে হাসপাতাল, আড়াল হইতে তাল মিলাইয়াছে স্বাস্থ্য দফতর। গত ছয় বৎসর পর-পর অনেকগুলি অবিশ্বাস্য চিকিৎসা-বিভ্রাট ঘটিয়াছে নানা সরকারি হাসপাতালে। তাহার কতগুলিতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হইয়াছে, কতগুলিতেই বা পরিকাঠামোর দুর্বলতা সংশোধিত হইয়াছে, সে তথ্য কখনও প্রকাশ করে নাই স্বাস্থ্য দফতর। সরকারি কর্তারা প্রজ্ঞাবান। তাঁহারা জানেন, নূতন আঘাতের বেদনায় পুরাতন ব্যথা বিস্মৃত হইবে। কিন্তু মৃতপ্রায় মানুষের অপমান ভুলিতে পারেন না রাজ্যবাসী। জুনিয়র ডাক্তারদের উপর যে রোষ আছড়াইয়া পড়ে, তাহা বস্তুত বিবেকহীন, অপরিণামদর্শী, রাজনৈতিক পোষণদুষ্ট এক অমানবিক ব্যবস্থার প্রতি রাজ্যবাসীর ক্ষোভ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

emergency department Hospital Liability
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE