Advertisement
E-Paper

সংস্কার? কোথায় সংস্কার?

আজ শতবর্ষ পরে ২০১৭ সালে ভারতের চিত্রপটটি কী? তাসখন্দে ১৯২০ সালে মানবেন্দ্রনাথ রায়, তার পর ১৯২৫ সালে ভারতে কমিনটার্নের শাখা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম।

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৭ ০০:০০
দিশারি: অর্থনীতির পুনর্গঠন বিষয়ক আলোচনাসভায় দেশের অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। আছেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও। কলকাতা, জানুয়ারি ১৯৯২

দিশারি: অর্থনীতির পুনর্গঠন বিষয়ক আলোচনাসভায় দেশের অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। আছেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও। কলকাতা, জানুয়ারি ১৯৯২

১৯২০ সালের কথা। সোভিয়েত দেশে লেনিনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন এক বিশিষ্ট মার্কিন শিল্পপতি ভান্ডেরলিপ। বিশ্বযুদ্ধ থেকে গৃহযুদ্ধ— সোভিয়েত ইউনিয়ন চূড়ান্ত আর্থিক সঙ্কটে। খাদ্য নেই। কারখানা বন্ধ। পশ্চিমের এই পুঁজিপতির প্রস্তাব, লগ্নি করতে চাই। যন্ত্রপাতিহীন কারখানায়। বরফচাপা রাস্তাঘাট আর ভেঙে পড়া সব বাড়ির জন্য। লেনিন রাজি হননি। তিনি শুধু হেসেছিলেন। করমর্দন করে শুধু বুঝদার হাসি উপহার দিয়েছিলেন ভান্ডেরলিপকে। সোভিয়েত লেখিকা লারিসা লাতিনিনা এই বৈঠকের এক চমৎকার রিপোর্ট লেখেন। পরবর্তী কালে চেক সাহিত্যিক জুলিয়াস ফুচিক ফাঁসির আগে ‘লেনিনের হাসি’ শীর্ষক একটি ব্যঙ্গাত্মক রচনায় বলেন, মুচকি হাসি দিয়ে আসলে লেনিন মার্কিন পুঁজিপতিকে বলতে চান, পুঁজিবাদের সঙ্গে কোনও আপস নয়। সমাজতন্ত্র জিন্দাবাদ!

আজ শতবর্ষ পরে ২০১৭ সালে ভারতের চিত্রপটটি কী? তাসখন্দে ১৯২০ সালে মানবেন্দ্রনাথ রায়, তার পর ১৯২৫ সালে ভারতে কমিনটার্নের শাখা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম। তার পর কত বিভাজন। সংসদ থেকে সংসদের বাইরে। আজ কমিউনিস্ট পার্টিগুলি তো বটেই, সমাজতন্ত্রী দলগুলি মৃতকল্প হলে কী হবে, ভারতে তথাকথিত কংগ্রেস-বিরোধী প্রধান শক্তি ২৮২টি আসন পাওয়া শাসক দলই আজ সমাজতন্ত্রের প্রধান মুখপাত্র হয়ে উঠছে? এখন মোদী বলছেন, সমাজতন্ত্র জিন্দাবাদ? একেই কি বলে অদৃষ্টের পরিহাস?

কেউ কথা রাখে না। ২০১৪ সালে জগদীশ ভগবতীর সুরে সুর মিলিয়ে কত অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, কংগ্রেসের দীর্ঘ-শাসনে উদার পুঁজিবাদের খোলাবাজারের কথা বললেও আসলে সংস্কার-বিরোধী সমাজতন্ত্রেরই স্টিম রোলার চালানো হয়েছে। এ বার মোদীর নেতৃত্বে আসছে প্রকৃত সংস্কারবাদী অর্থনীতি। ২০১৪ সালের ভোটের আগে মোদী বার বার আমাকে বলেছিলেন, ‘মানুষকে বাদ দিয়ে সংস্কার নয়। উন্নয়নকে মানুষের আন্দোলনে পরিণত করতে হবে।’ ভেবেছিলাম, মানুষের বিপুল সমর্থন নিয়ে মোদী মানুষকে বোঝাতে পারবেন কেন ভর্তুকিনির্ভর অর্থনীতি ভাল নয়। সমাজতন্ত্রী-বামপন্থীদের প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করেই বিগ টিকিট রিফর্ম করবেন। সনিয়া গাঁধী-মনমোহনের জমানায় বিজেপির শীর্ষ নেতারাই ঠাট্টা করে বলতেন, ‘৯১ সালের সংস্কারবাদী মনমোহন, সমাজতন্ত্রী হয়ে গেলেন। সনিয়া গাঁধীও কাঁধে ঝোলা নিয়ে এনজিও-টাইপ রাজনীতি করছেন।’ তেমনই এক বিজেপি নেতাকে সে দিন বললাম, ‘মশাই, আপনারা তো এখন ঝোলাওয়ালা হয়ে গিয়েছেন।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘বিগ টিকিট রিফর্ম, বিগ ব্যাং অর্থনীতি এ সব তোমাদের সম্পাদকীয় স্তম্ভে লেখার জন্য ভাল। কিন্তু রাজনীতিতে থাকতে গেলে ভোট করতে হয়। প্রত্যেক বছরই কোনও না কোন রাজ্যে ভোট হচ্ছে। ভোট জিততে হবে।’

পাশাপাশি, আর্থিক বৃদ্ধির হার হ্রাস পাওয়ায় দেশবিদেশের বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। অনেকে বলছেন, নোট বাতিলের সিদ্ধান্তর জন্যই এমনটা হয়েছে। কর্পোরেট লেখক গুরুচরণ দাস তো বলেই ফেলেছেন, ‘২০১৪ সালে জীবনে প্রথম বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলাম, কিন্তু এখন নিজেকেই প্রশ্ন করছি কাজটা ঠিক করেছিলাম কি না।’ কারণ? শুধু বৃদ্ধির হার হ্রাস পাওয়া নয়, গোটা দেশে চাকরির সুযোগ গড়ে উঠল কোথায়? তার বদলে তো দেখছি সর্বস্তরে ছাঁটাই।

নরেন্দ্র মোদী অবশ্য এ বার বিদেশে গিয়ে আবার আশ্বাস দিয়েছেন যে আর্থিক সংস্কারে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব নেই। গত তিন বছরে আর্থিক সংস্কারের লক্ষ্যে মোদী কোনও কাজই করেননি এমন কথা আমি বলছি না। বহু অচল হয়ে যাওয়া প্রাচীন প্রায় ১২০০ আইন তিনি বাতিল করেছেন। পণ্য পরিষেবা কর ক্ষেত্রে গোটা দেশে অভিন্ন কর পরিষেবা হবে— মোদী সরকার এটিকেও বৃহৎ সংস্কার বলতে চাইছেন। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বাজার খুলছে এ সরকার। নতুন ব্যাঙ্করাপসি কোড চালু করছে। কিন্তু এর পাশাপাশি দেখছি প্রতিদিন দেশের কোনও না কোনও প্রান্তে সাম্প্রদায়িক হিংসার রাজনীতি। জাতপাতের সংঘর্ষ। ‘রোমিয়ো-বিরোধী’ অভিযান। গবাদি পশু সংক্রান্ত আইন। গরুকে জাতীয় পশু করা না-করা নিয়ে বিতর্ক। পশ্চিমবঙ্গে হনুমানজয়ন্তী, রামনবমীর পর এ বার রথযাত্রার কর্মসূচি। এ সব ঘটনায় সৃষ্ট আবহ, আর যা-ই হোক, দেশের আর্থিক সংস্কারের জন্য আধুনিক মানসিকতার প্রকাশ বলা যায় না।

১৯৪৭ থেকে ১৯৮০ সাল, এই সময়কালকে ভারতের অর্থনীতির গঠনের প্রথম পর্ব বলা হয়। পঞ্চাশের দশকে ভারী শিল্প এবং ভূমি সংস্কার ছিল নেহরুর অগ্রাধিকার। নেহরু নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলতেন। ফেবিয়ান সোশ্যালিজমের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন। গাঁধীর আর্থিক মডেল অনেকটাই বর্জন করে নেহরু দেশের উন্নয়নের জন্য শিল্পায়নকে অগ্রাধিকার দেন। কিন্তু খোলাবাজারের অর্থনীতির বদলে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার নিয়ন্ত্রণেই অর্থনীতিকে রাখতে চান তিনি। ষাটের দশকে ইন্দিরা ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করেন। সংবিধানের প্রস্তাবনাতে ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটি যুক্ত করেন ভারতীয় রাষ্ট্র চরিত্র নির্মাণে।

১৯৮০ থেকে ২০১১— এই সময়কে দেশের আর্থিক সঙ্কট থেকে বেরোনোর জন্য আর্থিক সংস্কারের পথ গ্রহণের পর্ব বলা হয়। রাজীব গাঁধী কম্পিউটার-মোবাইল প্রযুক্তি বিপ্লব করেছিলেন। সে দিন তা নিয়ে অনেক হাসাহাসি হয়— কম্পিউটার সর্বরোগহরা বটিকা? রাজীবকে আজ আর্থিক সংস্কারের অন্যতম দিশারি বলা হয়। এর পরে মনমোহন সিংহের অর্থমন্ত্রিত্বের সময়েই (১৯৯১-৯৬) হল সবচেয়ে বেশি আর্থিক সংস্কার।

এই সমস্ত পর্বেই নানা আর্থিক সমস্যা দেখা গিয়েছে। কখনও আর্থিক ঘাটতি বেড়েছে। কখনও বিদেশ থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। কিন্তু কখনওই শাসক দল দেশের বহুত্ববাদ ও সহিষ্ণুতার রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সচেতন ভাবে ধ্বংস করেনি। এমনকী জোটের বাধ্যতার জন্যই হোক আর বাজপেয়ীর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের দৃঢ়তার জন্যই হোক, দেশেবিদেশে তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বেও (১৯৯৮-২০০৪) সরকারের ভাবমূর্তি ‘একনায়কতন্ত্র’ বলে পরিচিত হয়নি।

নরেন্দ্র মোদীর দল কিছু অত্যাধুনিক ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’-এর সাহায্যে দেশের মধ্যবিত্ত ও সম্পন্ন সমাজের কাছে ঘোষণা করেছিল, বিজেপির এই নয়া অবতার দক্ষিণপন্থী সংস্কারবাদী জনপ্রিয়তার রাস্তা নেবে। শক্তিশালী রাষ্ট্র ও খোলাবাজারের এক আশ্চর্য সমন্বয় হবে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর রাষ্ট্রভাবনায় যে দেশের অার্থিক নীতি ফিরে আসবে পুরনো সমাজতন্ত্রী স্লোগানে, আর রাজনীতির উত্থান হবে উগ্র জাতীয়তাবাদে, সেটা এ ভাবে আমিও ভাবিনি। শ্রম সংস্কার করেননি নরেন্দ্র মোদী, উল্টে শ্রমিক সম্মেলনে গিয়ে নতুন স্লোগান দিয়েছেন ‘শ্রম এব জয়তে’। শুনে মনে হয়, যেন আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সম্মেলনে ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগানেরই অনুসরণ।

জে কে গ্যালব্রেথ ১৯৫৮ সালে বলেছিলেন, ভারতের কট্টরতম পুঁজিপতিও বলে ফেলেন যে তিনি ভিতরে ভিতরে আসলে সমাজতন্ত্রী। তাই মোদীর মতো ব্যক্তির সমাজতন্ত্রীর নামাবলি গায়ে দেওয়ায় বিস্মিত হচ্ছি না। শুধু এটুকু বলতে পারি, উন্নয়নের প্রধান লক্ষ্য যদি মানুষের মৌলিক স্বক্ষমতা এবং তার প্রসার হয়, তবে মোদী সে কাজে কতটুকু সফল হলেন? আয়বৃদ্ধি আর উন্নয়নের পারস্পরিক সম্পর্ক মাথায় রেখে মোদী কি তিন বছরে সেই ভারত গড়তে সক্ষম হলেন, যেখানে বঞ্চনা ও অন্যায় অনেক কম? আয়বৃদ্ধি শুধু নয়, এই সামাজিক উন্নয়নের আবহ, চিন বা অতীতের সোভিয়েত দেশের মতো প্রচারের ঢক্কানিনাদ যতটা, বাস্তবতা কি ততটা? ধনীবিরোধী ভাবমূর্তি রচনার জন্য কোটি কোটি টাকা বিজ্ঞাপনে খরচ করার কৌশল নেওয়া হলেও, বাস্তবে দারিদ্র আর অসাম্য ঘুচছে কোথায়?

Manmohan Singh Financial reform Narendra Modi নরেন্দ্র মোদী কমিউনিস্ট পার্টি মনমোহন সিংহ
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy